বাংলাদেশের বিমা খাত অনেক পিছিয়ে আছে। মানবসম্পদের দক্ষতা, সেবা পণ্যের সমারোহ, ন্যূনতম মুনাফা আর প্রযুক্তির ব্যবহারে অনেক পিছিয়ে আছে এই খাত। অথচ মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিমা খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৯০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে নিবন্ধিত বিমা প্রতিষ্ঠানের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি অনুমোদন পেয়েছে গত সরকারের আমলে। ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশে ৭২টি বিমা প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হয়েছে। এর মধ্যে ৬০টি প্রতিষ্ঠানই নিবন্ধিত হয়েছে বিগত সরকারের আমলে।
প্রতিবেশী ভারতে ৫৭টি, পাকিস্তানে ৪০টি ও শ্রীলঙ্কায় ২৮টির বিপরীতে বাংলাদেশে মোট বিমা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮২। বাংলাদেশে বর্তমানে কার্যক্রম পরিচালনাকারী বিমা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটিমাত্র আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আছে। এ ছাড়া আরেকটি প্রতিষ্ঠান কয়েক বছর ধরে জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি হিসেবে এই দেশে ব্যবসা করছে। দেশে প্রয়োজনের তুলনায় বেশিসংখ্যক ইনস্যুরেন্স কোম্পানি থাকার কারণে এই খাতে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। এর ফলে এই খাতে একধরনের অস্থিরতা লেগেই আছে।
বাংলাদেশের বিমা খাতের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ২০১৩ সালে। ওই সময়ে একই সঙ্গে ১৩টি জীবনবিমা কোম্পানিকে ব্যবসার জন্য অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তখন বলা হয়েছিল যে এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কিন্তু বাস্তবে কিছু কর্মসংস্থান হলেও পুরো খাতটিই পঙ্গু হয়ে গেছে। বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের উচিত, যে কোম্পানিগুলো দুর্বল হয়ে গেছে, তাদের বোর্ড ও ম্যানেজমেন্টকে ডেকে চূড়ান্ত একটা সিদ্ধান্ত দিয়ে দেওয়া। কারণ, ওই কোম্পানিগুলোর গ্রাহকেরা তাঁদের টাকা আর ফেরত পাবেন না। সন্দেহ নেই বাজারে বিমা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি হলে তা অনৈতিক চর্চাকেও উৎসাহিত করে।
পণ্য সরবরাহের ব্যাপ্তি বা বৈচিত্র্য না থাকায় সবাই একই জায়গায় প্রতিযোগিতা করছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষে এত প্রতিষ্ঠানের তদারকি করা কঠিন। বহুল কালোটাকা আর ‘ইজি মানি’র এই দেশে অনেকে একটি বিমা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বা পরিচালক পদে থাকাকে মর্যাদাপূর্ণ বলে মনে করেন। তাই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী অনেকে প্রতিষ্ঠান করলেও অনেক সময় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও দুর্বল নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার কারণে এই খাতের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়েনি; বরং কমেছে। এই খাতে পেশাদারত্বের অভাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গত ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোকে বিমা পণ্য চালুর অনুমতি দেয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিশ্বাস, ব্যাংকগুলো বিমার ওপর জনসাধারণের আস্থা ফেরাতে সহায়তা করতে পারে।
আমাদের দেশে বিমা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের প্রয়োজন নয়, এমন বিমা পণ্যও বিভিন্নভাবে বিক্রয় করে। এর ফলে তামাদি পলিসির সংখ্যাও বাড়ছে। অনেকে গ্রাহকের দায় পরিশোধের কথা বিবেচনা না করে বড় অঙ্কের প্রিমিয়াম অর্জনের দ্রুত উপায় হিসেবে এই খাতকে দেখেন।
বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থা ২০১৩ সালে জীবনবিমা সলভেন্সি মার্জিন রেগুলেশনের খসড়া প্রকাশ করে। তবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষে এই বিধিমালা ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বাস্থ্য মূল্যায়ন করা কঠিন। যদি এটি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে কিছু প্রতিষ্ঠান সম্ভবত দেউলিয়া হয়ে যাবে বা একীভূতকরণের আগ্রহ দেখাবে। কারও কারও মতে, বিমা প্রতিষ্ঠান অর্থ পাচারের একটি পথ। এসব প্রতিষ্ঠানকে লুটপাটে ব্যবহার করা হয়। এ কারণেই নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে দুর্বল করা হয়েছে। অনেকের ধারণা, দেশের অর্থনীতি ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে ৬ থেকে ১০টি জীবনবিমা প্রতিষ্ঠান থাকা উচিত।
আমাদের দেশে বিমা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের প্রয়োজন নয়, এমন বিমা পণ্যও বিভিন্নভাবে বিক্রয় করে। এর ফলে তামাদি পলিসির সংখ্যাও বাড়ছে। অনেকে গ্রাহকের দায় পরিশোধের কথা বিবেচনা না করে বড় অঙ্কের প্রিমিয়াম অর্জনের দ্রুত উপায় হিসেবে এই খাতকে দেখেন।
এখানে একটি কোম্পানি নিবন্ধনের জন্য মাত্র ১৮ কোটি টাকা প্রয়োজন। নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি এই খাতের সমস্যা আরও বাড়িয়ে তুলেছে। সলভেন্সি মার্জিন নীতি বাস্তবায়নের কথা তুলে ধরে অনেকে বিমা নিয়ন্ত্রণ সংস্থাকে শক্তিশালী করার বিষয়ে পূর্ববর্তী সরকারের অবহেলার বা অনীহারও সমালোচনা করেন।
বাংলাদেশের জিডিপিতে বিমা খাতের অবদান মাত্র শূন্য দশমিক ৪৬ শতাংশ, যেখানে ভারতে ৪ দশমিক ২ শতাংশ এবং পাকিস্তানে শূন্য দশমিক ৯১ শতাংশ। আইডিআরের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৭১ লাখ ১০ হাজার মানুষ বিমা করেছেন। বিপুলসংখ্যক বিমা প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও দেশের গড় বিমা দাবি নিষ্পত্তির অনুপাত বৈশ্বিক মান ৯৭-৯৮ শতাংশ থেকে অনেক পিছিয়ে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারতে গড় বিমা দাবি নিষ্পত্তি অনুপাত ছিল প্রায় ৯৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এর বিপরীতে ২০২৩ সালে দেশে বিমা নিষ্পত্তির হার ছিল ৬৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। গত মার্চ পর্যন্ত এখানে প্রায় ১০ লাখ বিমাকারীর সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার দাবি বিচারাধীন। ২৯টি জীবনবিমা প্রতিষ্ঠান তীব্র তারল্যসংকটে পড়েছে।
গত ১৪ বছরে বিমাকারীদের আর্থিক অবস্থার অবনতি, সচেতনতার অভাব ও এজেন্টরা বিমা পণ্যের সুবিধা-অসুবিধাগুলো সঠিকভাবে ব্যাখ্যা না করায় ২৬ লাখের বেশি পলিসি বাতিল হয়েছে। ২০০৯ সালে মোট পলিসি ছিল প্রায় ১ কোটি ১২ লাখ। ২০২৩ সালে তা কমে হয়েছে ৮৫ লাখ ৮০ হাজার। গত ডিসেম্বরে ব্যাপক অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের কারণে আর্থিক সক্ষমতা হারানো বেশ কয়েকটি বিমা প্রতিষ্ঠান একীভূতকরণের সুপারিশ করে আইডিআরএ। প্রতিবেদনে বলা হয়, দাবি নিষ্পত্তিতে ব্যর্থতা বিমা খাতের প্রতি জনগণের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
সমস্যাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স, পদ্মা ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স, প্রাইম ইসলামী লাইফ ইনস্যুরেন্স, গোল্ডেন লাইফ ইনস্যুরেন্স, হোমল্যান্ড লাইফ ইনস্যুরেন্স ও প্রগ্রেসিভ লাইফ ইনস্যুরেন্সের নাম রয়েছে। তবে এ বিষয়ে এরপর আর কোনো অগ্রগতি জানা যায়নি।
সরকার রুগ্ণ কোম্পানিগুলোকে একীভূত করার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে। বিমাসহ দেশের পুরো আর্থিক খাতেই প্রয়োজনের তুলনায় বেশি প্রতিষ্ঠান আছে। এটি খাতটিকেই অস্বাস্থ্যকর বাজার প্রতিযোগিতার দিকে পরিচালিত করছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা খাতটিকে কার্যকরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেও হিমশিম খাচ্ছে। হয়তো বাতির নিচেই অন্ধকার। তাই এখানেও সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই।
মামুন রশীদ, অর্থনীতি বিশ্লেষক