হাসিনা-পরবর্তী যে সংকটময় মোচড়ে বাংলাদেশ

নির্দলীয় ছাত্র আন্দোলন জনপ্রিয় বিদ্রোহে পরিণত হয়, একজন স্বৈরশাসককে উৎখাত করেছবি: প্রথম আলো

শেখ হাসিনা ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশকে লৌহমুষ্টি দিয়ে শাসন করেছেন। কিন্তু ৫ আগস্ট রাজধানী ঢাকায় লাখ লাখ মানুষ মিছিল করেন এবং তাঁর বাসভবনে হামলা চালানো হয়। এর মাধ্যমে তাঁকে পদত্যাগ করতে এবং দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করা হয়।

একদম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শেখ হাসিনা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর দমন–পীড়নের শেষ চিহ্ন হিসেবে তাঁর ক্ষমতার শেষ কয়েক দিনে কমপক্ষে ৪৪০ জন নিহত হয়েছেন। সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের বিরুদ্ধে একটি নির্দলীয় ছাত্র আন্দোলন দিয়ে ঘটনার শুরু হয়েছিল। সেটি পরে একটি জনপ্রিয় বিদ্রোহে পরিণত হয় এবং সেটি শেষ পর্যন্ত একজন স্বৈরশাসককে উৎখাত করে।

এখন দেশটিতে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তার নেতৃত্বে আছেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি ২০০৭ সালে ‘নাগরিক শক্তি’ নামের একটি রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলেন। সে কারণে দীর্ঘদিন ধরে তিনি হাসিনা সরকারের বিচারিক হয়রানির শিকার হয়েছিলেন।

নতুন সরকারের অন্যান্য সদস্যের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদসহ মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ ও ছাত্র আন্দোলনকারী, সেনাবাহিনী ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। ১৯৯০ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসনের পতনের পর দেশকে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে নেওয়ার জন্য প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল। এই ব্যবস্থাকে সে সময় ব্যাপকভাবে সফল পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়েছিল।

সে কারণেই একটি সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বলা যায় আনুষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছিল। এই সংশোধনীই ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৬ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর ভিত্তি দিয়েছিল।

কিন্তু ২০১১ সালে হাসিনার সংসদ সংবিধানে সংশোধনী আনে এবং তার মাধ্যমে তারা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে বিরোধী দলগুলো পরের নির্বাচনগুলো বর্জন করে, যা বাংলাদেশকে অঘোষিত একটি একদলীয় রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করে।

দেশটি এখন সত্যিকার অর্থেই সংকটময় সময় পার করছে। একদিকে এই আশাবাদ সবার মধ্যে জেগে উঠেছে যে এই অভ্যুত্থান থেকে আবির্ভূত নতুন প্রজন্মের নেতারা দেশকে এমন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাবেন, যা সব নাগরিকের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষা করবে।

অন্যদিকে এটি খুবই চিন্তার বিষয় যে ক্ষমতার শূন্যতাকে পুঁজি করে বাংলাদেশের বৃহত্তম ইসলামি দল জামায়াতে ইসলামীসহ রক্ষণশীল ধর্মীয় দলগুলো বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা করবে। এটি বাংলাদেশকে এমন একটি পথে নিয়ে যেতে পারে, যেখানে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু এবং নারীর অধিকার সংকুচিত হয়ে পড়তে পারে।

ভিন্নমতের লোকেরা যাতে সুরক্ষা পান, সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এখানে এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে দলগুলো বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিতে প্রলুব্ধ না হয়। এটি নিশ্চিত করতে পারলেই শুধু ভবিষ্যৎ সরকার হাসিনার নৃশংসতার শাসন ফিরিয়ে আনার সাহস পাবে না।

বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের বেশি মুসলমান। তারা ঐতিহ্যগতভাবে মধ্যপন্থী অর্থাৎ উদার ঘরানার ইসলাম অনুসরণ ও অনুশীলন করে আসছে, যা কিনা আধ্যাত্মিক সুফি ঐতিহ্যের সঙ্গে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত। কিন্তু কয়েক বছর ধরে সৌদি আরব মসজিদ-মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামভিত্তিক এনজিওগুলোকে অর্থায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে ধর্মতান্ত্রিক ‘ওহাবি’ ইসলাম প্রচার করে আসছে।

এ ছাড়া যুক্তরাজ্যে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিরা, বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল থেকে যাওয়া প্রবাসীরা (যাঁরা বিশ্বব্যাপী একটি মুসলিম পরিচয় তৈরি করেছেন) দেশের মানুষের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক ধরে রেখেছেন। হাসিনার শাসনামলে ধর্মভিত্তিক বিরোধী দলগুলোর শত শত নেতা-কর্মীকে নির্মমভাবে দমন করা হয়েছে এবং বেআইনিভাবে আটক করেছে।

এমন হতে পারে যে হাসিনা সরকার ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ওপর দমন–পীড়ন চালানোর কারণে ধর্মীয় দলগুলোর জনসমর্থন বেড়েছে।

১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকে জামায়াতে ইসলামীর ভোটের হার কমতে থাকে। সর্বশেষ বারের মতো দলটি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল ২০০৮ সালে। তারা মাত্র ৪.৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল এবং জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে তারা ২টি আসন পেয়েছিল।

মাঝখানে অনেকটা সময় কেটে গেছে। সময়ের এই ব্যবধানের কারণে বাংলাদেশের ধর্মীয় দলগুলোর জনসমর্থন কী অবস্থায় আছে, তা ঠিকভাবে মাপা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে হাসিনার পতনের পর তাঁর আওয়ামী লীগের সমর্থক কিছু সংখ্যালঘু পরিবারের বাড়িতে লুটপাট ও ভাঙচুরের ব্যাপক খবর পাওয়া গেছে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে, যদিও এ–সংক্রান্ত অনেক অপতথ্যও ছড়িয়ে পড়েছে।

এই খবরের পর সারা দেশের মানুষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে রক্ষার জন্য জড়ো হন। #HindusAreSafeInBangladesh এবং #MinoritiesAreSafeInBangladesh হ্যাশট্যাগ দিয়ে ছাত্র, স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং জনসাধারণের মন্দির এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি রক্ষার ছবি এক্স হ্যান্ডলসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

যেসব স্থাপনায় ভাঙচুর চালানো হয়েছে, সেখানে হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতায় লেগে গেছে এবং ক্ষয়ক্ষতি মেরামত করতে সহায়তা করেছে। জাতীয় সংসদ ভবনের আশপাশ পরিষ্কার করার জন্য মূলধারার স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদেরও একযোগে কাজ করতে দেখা গেছে। এমনকি ছাত্রনেতারা সংসদ ভবনের অস্ত্রাগার থেকে চুরি হওয়া ৪০টি আগ্নেয়াস্ত্র খুঁজে বের করে ফেরত দিয়েছেন।

এই কাজগুলো আশাব্যঞ্জক হলেও, বাংলাদেশকে সব নাগরিকের অধিকার রক্ষায় সক্ষম একটি রাষ্ট্র হিসেবে পুনর্গঠন করা যাবে কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কারণ, গত মাসের ঘটনাগুলোই দেখিয়েছে, বাংলাদেশের মূল প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা রাজনৈতিকভাবে দলদাসে পরিণত হয়েছে। সরকারের ইচ্ছানুযায়ী চাকরির কোটা নিয়ে বিচার বিভাগের একেক সময় একেক মত দেওয়া বেশ হতাশাব্যঞ্জক ছিল।

বিক্ষোভকারীরাও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, অপহরণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে রাইফেল, সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি পুলিশ হেলিকপ্টার থেকে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি ছুড়েছে।

এখন অন্তর্বর্তী সরকারকে সংখ্যালঘুসহ বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের সুরক্ষা দেওয়া সবচেয়ে জরুরি।

একই সঙ্গে নাগরিকের মানবাধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

ভিন্নমতের লোকেরা যাতে সুরক্ষা পান, সেই পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এখানে এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে দলগুলো বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিতে প্রলুব্ধ না হয়। এটি নিশ্চিত করতে পারলেই শুধু ভবিষ্যৎ সরকার হাসিনার নৃশংসতার শাসন ফিরিয়ে আনার সাহস পাবে না।

  • রাশাদ শাবাব ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের ইকোনমিকসের রিডার

    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ