দীর্ঘদিনের রেওয়াজ অনুযায়ী ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের সরকারি বাসভবনের বাইরে দাঁড়িয়ে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে প্রথম ভাষণটি দিয়ে থাকেন। লিজ ট্রাস সেই রেওয়াজ ভেঙে মঙ্গলবার বিকেলে ভাষণ দিয়েছেন ডাউনিং স্ট্রিটের স্টেট রুম থেকে।
বিরূপ আবহাওয়ার কারণে তিনি হয়তো এটি করতে বাধ্য হয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু সেন্ট্রাল লন্ডনে বজ্রপাতের পূর্বাভাস এখন শুধু আবহাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, কারণ ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি এবং চড়া বিদ্যুৎ বিল লাখ লাখ পরিবার ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে যে যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে দিয়েছে, তার কারণে নতুন প্রধানমন্ত্রী একটি ভয়াবহ অর্থনৈতিক ঝড়ের মুখোমুখি হচ্ছেন।
মাত্র এক মাস আগে লিজ ট্রাস ৬০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক চাপের মধ্য দিয়ে যাওয়া পরিবারগুলোকে সাহায্য করার সর্বোত্তম উপায় হিসেবে ‘থোক বরাদ্দ’ দেওয়ার ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এর বদলে তিনি ট্যাক্স কমানো এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
এখন পর্যন্ত তিনি সেই অভিমতের প্রতি অটল আছেন। কিন্তু অর্থনীতিতে তাঁর এই ‘থ্যাচারাইট’ (ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের নীতি অনুসরণ অর্থে) দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা এখন বাস্তবতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দেখা দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় নতুন প্রধানমন্ত্রীকে দুটি বিকল্পের একটিকে বেছে নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। একটি হলো বিদ্যুৎ বিলে বিশাল অঙ্কের প্রাইসট্যাগ লাগাতে হবে, অন্যটি হলো বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে গিয়ে জেরবার হওয়া পরিবারগুলোকে বড় অঙ্কের থোক অর্থসহায়তা দেওয়া।
যদি তিনি তা অর্জনে ব্যর্থ হন বা যদি জনসমর্থনে পিছিয়ে পড়েন, তাহলে তাঁর ইতিমধ্যেই অস্থির হয়ে পড়া দলটি তাঁর বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে। এতে তাঁর অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। ফলে ট্রাসের মাথার ওপরে জমতে থাকা রাজনৈতিক ঝড়ের মেঘ শিগগিরই সরার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
বিরোধী লেবার পার্টি ইতিমধ্যেই ট্রাসকে শ্রমিকদের অধিকার ক্ষুণ্ন করার, তাঁদের সুবিধাদির পরিসর কমানোর উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের মতো পরিষেবা প্রতিষ্ঠানে দেওয়া নগদ সহায়তা সংকুচিত করার জন্য দায়ী করা শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই তারা লেবার পার্টির সমর্থক অধ্যুষিত শহরগুলোতে বিলবোর্ড টাঙিয়ে ট্রাসবিরোধী বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু করেছে। সেই বিলবোর্ডে লিজ ট্রাসের ছবি দিয়ে, সেখানে জনতার উদ্দেশে স্লোগান লিখে দিয়েছে, ‘তিনি (ট্রাস) আপনার পাশে নেই’।
অবশ্য ট্রাসের মিত্ররা দাবি করছেন, ট্রাস বাস্তবতা বুঝে চলা যৌক্তিক মেজাজের রাজনীতিবিদ। তাঁর পূর্বসূরি বরিস জনসনের মতোই তিনি পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। তাঁরা বলছেন, ট্রাস প্রথম জীবনে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির কট্টর সমর্থক ছিলেন এবং সেখান থেকে ডানপন্থী টোরিদের সংস্কৃতিযোদ্ধায় পরিণত হন।
তিনি প্রথমে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বিচ্ছিন্ন হওয়া অর্থাৎ ব্রেক্সিটের ঘোর বিরোধী ছিলেন। সেই তিনিই পরে একজন আবেগপ্রবণ ব্রেক্সিট সমর্থকে নিজেকে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা দেখিয়েছেন। ট্রাসের মিত্ররা মনে করছেন, গদিতে থাকাকালে তিনি এই দক্ষতাকে কাজে লাগাতে সক্ষম হবেন।
কিন্তু দৃশ্যত সময় ট্রাসের পক্ষে নয়। জরিপে আগে থেকেই টোরিরা জনপ্রিয়তায় লেবারদের থেকে ১০ পয়েন্ট পিছিয়ে ছিল। ট্রাসের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ঘোষণার পর সেই পয়েন্ট আরও পড়ে গেছে।
গত সোমবার ইউগোভ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ১৯ শতাংশ লোক বলেছেন, তাঁরা ট্রাসের জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহের নীতিতে ভরসা রাখতে পারছেন। কিন্তু ৬৭ শতাংশ লোক বলেছেন, তাঁরা নতুন প্রধানমন্ত্রীর ‘কস্ট অব লিভিং পলিসি’র ওপর একেবারেই ভরসা করতে পারছেন না।
টোরিদের অভ্যন্তরীণ লোকেরা বিশ্বাস করেন, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শুধু জীবনযাত্রার ব্যয়সংক্রান্ত সংকটই নয়, অন্যান্য ঘরোয়া চ্যালেঞ্জ তাঁর সামনে দাঁড়াবে। নতুন নেতারা সাধারণত শুরুতে একটি ভালো জনসমর্থন পেয়ে থাকেন।
যদি তিনি তা অর্জনে ব্যর্থ হন বা যদি জনসমর্থনে পিছিয়ে পড়েন, তাহলে তাঁর ইতিমধ্যেই অস্থির হয়ে পড়া দলটি তাঁর বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে। এতে তাঁর অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। ফলে ট্রাসের মাথার ওপরে জমতে থাকা রাজনৈতিক ঝড়ের মেঘ শিগগিরই সরার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
পিপ্পা ক্রেরার দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার পলিটিক্যাল এডিটর