শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দলের অনেক এমপি–মন্ত্রী–নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সেই সব মামলায় অনেকে গ্রেপ্তারও হয়েছেন। আদালতে আনা–নেওয়ার পথে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের কেউ কেউ আদালত প্রাঙ্গণে হামলার শিকার হয়েছেন। কোথাও কোথাও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইনজীবীরাও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার যা ঘটেছে তা আগের সব দৃষ্টান্তকে ছাড়িয়ে গেছে।
গত বুধবার বেলা দেড়টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডির একটি বাসা থেকে সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুকে গ্রেপ্তার করার কথা জানায় পুলিশ। বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আমুকে আদালত প্রাঙ্গণে আনা হয়। এরপর আদালতের এজলাসে তুলে তাঁকে ১০ দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে পুলিশ। শুনানিতে আমুর আইনজীবী স্বপন রায় চৌধুরী কথা বলতে শুরু করেন। একপর্যায়ে তাঁকে মারধর করে আদালত থেকে বের করে দেন একদল আইনজীবী। (প্রথম আলো অনলাইন, ৮ নভেম্বর ২০২৪)
গত বুধবার বেলা দেড়টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডির একটি বাসা থেকে সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুকে গ্রেপ্তার করার কথা জানায় পুলিশ। বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আমুকে আদালত প্রাঙ্গণে আনা হয়। এরপর আদালতের এজলাসে তুলে তাঁকে ১০ দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে পুলিশ। শুনানিতে আমুর আইনজীবী স্বপন রায় চৌধুরী কথা বলতে শুরু করেন। একপর্যায়ে তাঁকে মারধর করে আদালত থেকে বের করে দেন একদল আইনজীবী। (প্রথম আলো অনলাইন, ৮ নভেম্বর ২০২৪)
আমির হোসেন আমু গত স্বৈরাচারী সরকারের একজন নেতা ছিলেন, সেই হিসেবে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠা ও মামলা হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। মামলা হওয়ার পর তাঁর বিচারের বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়া অনুসারে হওয়ার কথা। এ ক্ষেত্রে অন্য যেকোনো সন্দেহভাজন অপরাধীর মতো তাঁরও আইনজীবীর সহায়তা পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু তাঁর আইনজীবীকে কথা বলতে না দিয়ে বা মারধর করে আইনি প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে।
২০২৪–এর ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান আমাদের নিশ্চিতভাবেই আশাবাদী করেছে। এ রকম একটি ঐতিহাসিক ঘটনার পর ‘মবের মুল্লুক’ চলতে থাকলে তা গণ–অভ্যুত্থানের স্পিরিট বা চেতনাকে দিন দিন দুর্বল করবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি এবং গণ–অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিকে তাই অতি দ্রুত ‘মবের মুল্লুক’ থামাতে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
যে ঘটনাটি ঘটেছে তা স্পষ্টতই বেআইনি এবং মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এ ঘটনার পর কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার তো পরিবর্তনের কথা বলেছিল, আইনের শাসনের কথা বলেছিল, কিন্তু এ ঘটনাগুলো কি আইনের শাসনের পরিপন্থী নয়? এখন হয়তো কেউ জোরেশোরে কিছু বলছে না, কিন্তু এ ধরনের ঘটনা পরবর্তী সময়ে পুরো বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করতে পারে।
আদালতে হামলার কয়েকটি ঘটনা থেকে দেখা যাচ্ছে, হামলাকারীদের কেউ কেউ নিজেরাই আইনজীবী। আদালতে মক্কেলের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য অন্য একজন আইনজীবীকে কোনোভাবে বাধা দেওয়া বা শারীরিক বা মৌখিকভাবে লাঞ্ছিত করা—একটা গুরুতর পেশাগত অসদাচরণ। কিন্তু হামলাকারী আইনজীবীরা অবলীলায় সেই কাজটি করেছেন। এটা একই সঙ্গে দুঃখজনক ও লজ্জাকর বিষয়।
আমির হোসেন আমুর আইনজীবীকে আদালতের ভেতরে মারধরের ঘটনার আগেও আদালত প্রাঙ্গণে একই ধরনের ঘটনা আরও ঘটেছে। এ ঘটনাগুলোকে ‘মব ট্রায়াল’ বা ‘মব জাস্টিস’ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। কিন্তু যখন একজন মানুষ আইনের আশ্রয়ে থাকেন, তখন এ রকম মব ট্রায়াল বা মব জাস্টিস হওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এ ঘটনাগুলো স্পষ্টতই আদালতের প্রতি অপমান বা অবমাননা। এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে শক্ত হাতে ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনের শাসন এবং আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। এ রকমটা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে যে কেউ এই অবস্থার শিকার হতে পারেন।
আদালতের এজলাসে আইনজীবীকে মারধরের ঘটনায় বিচারকের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। ঘটনা যেহেতু বিচারকের সামনেই ঘটেছে, তাঁর উচিত ছিল সে বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু তিনি কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে জানা যায়নি।
দেশের বিভিন্ন স্থানে আদালতে বিচারকদের সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রেও চাপের মুখে পড়তে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অতীতের অনেক স্পর্শকাতর মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষেত্রে যেমন চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে, তেমনি হত্যা মামলায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকার পরও রিমান্ড মঞ্জুর করতে আইনজীবীরা প্রভাব বিস্তার করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। (বিবিসি বাংলা, ১ নভেম্বর ২০২৪)
এসব কারণে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, বিচারকরা কি ভয়ের ঊর্ধ্বে উঠে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন?
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, গণ–অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ছিল গণতন্ত্র, বাক্স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ইত্যাদি বিষয়। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে এখন অনেকের প্রধান প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘মবোক্রেসি’ বা ‘মবের মুল্লুক’ অর্থাৎ ‘জোর যার মুল্লুক তার’। এই ‘মবোক্রেসি’ ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্রের জন্য একটি বড় বাধা।
২০২৪–এর ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান আমাদের নিশ্চিতভাবেই আশাবাদী করেছে। এ রকম একটি ঐতিহাসিক ঘটনার পর ‘মবের মুল্লুক’ চলতে থাকলে তা গণ–অভ্যুত্থানের স্পিরিট বা চেতনাকে দিন দিন দুর্বল করবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি এবং গণ–অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিকে তাই অতি দ্রুত ‘মবের মুল্লুক’ থামাতে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক