অর্থমন্ত্রী কবি শামসুর রাহমানের অবিরল জলভ্রমি গ্রন্থের ‘ধন্য সেই পুরুষ’ কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি দিয়ে এবারের বাজেট শুরু করেন। কবিতার সেই ‘পুরুষ’ ধূসর পটে পরিবর্তনের কান্ডারি। অর্থমন্ত্রী কি সেই কান্ডারি হতে চেয়েছেন? যাহোক, এই ক্রান্তিকালের বাজেটে তিনটি বিষয় বেশি আলোচিত হয়েছে—মূল্যবৃদ্ধি, নগদের অভাব এবং ঋণ বৃদ্ধি। অনালোচিত থেকে গেছে বেশ কয়েকটি বিষয়।
নতুন দারিদ্র্য বেড়ে যেতে পারে
জীবনযাত্রার ব্যয়সংকট বাজেটে সুরাহা করা হয়নি। প্রায় সব পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৬ শতাংশ ছাপিয়ে প্রথম ১০ মাসে মূল্যস্ফীতি গড়ে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ। সরকার এখনো ক্রমাগত মূল্যস্ফীতির জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করছে। মূল্যস্ফীতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমে আসবে, এমন ধারণা নিয়ে চলছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে বিভিন্ন পণ্য তথা সয়াবিন তেল, পাম তেল, চিনি, আটা, গম, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, ছোলা ইত্যাদির দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও ভোক্তাদের স্বস্তি নেই। দীর্ঘদিন ৭০-৮০ ডলার হলেও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জ্বালানি তেলের দাম কমার লক্ষণ নেই। সরকার কর সমন্বয় করে দাম কমাতে পারত। ভোক্তারা শক্তিশালী মধ্যস্বত্বভোগীদের নেক্সাসের হাতে জিম্মি থাকলেও বাজেটে বাজারব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কারের কোনো প্রস্তাব নেই। নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের কর্মসংস্থান, আয় ও সঞ্চয় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের খরচ কমিয়ে দিতে হয়েছে।
কাজের বিনিময়ে খাদ্য এবং খোলাবাজারে বিক্রির মতো খাদ্য বিতরণ কর্মসূচিতে চলতি অর্থবছরের ৩২ দশমিক ৮২ লাখ টন থেকে আগামী বছর খাদ্য কম থাকবে (৩০.৯২ লাখ টন )। বাজেটে খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় যেমন বাসাভাড়া, পরিবহন এবং স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বৃদ্ধিতে সরকারি হস্তক্ষেপের কথা উল্লেখ করা হয়নি। বাসনপত্র, টিস্যু, কলম, স্যানিটারি ন্যাপকিন ইত্যাদি দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসের ওপর উচ্চ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ধার্য হলে ন্যূনতম বেঁচে থাকা দুর্বিষহ হবে। সমস্যা এতটাই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, ২০২২ সালে ঢাকার মোট দরিদ্রের ৫১ শতাংশই নতুন দরিদ্র।
বাজেটে যে পদ্ধতির প্রস্তাব করা হয়েছে, তা দরিদ্র ও নিঃস্ব মানুষের সমস্যার কোনো টেকসই সমাধান দেবে না। সরকার মনে করে যে দরিদ্র জনগোষ্ঠী অনেকাংশে কমে গেছে এবং অতিদরিদ্র মানুষ দেশে নেই বললেই চলে। কিন্তু প্রকৃত চিত্র ভিন্ন।
সামগ্রিক বাজেট এবং জিডিপি উভয় অনুপাতে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী খাতে বরাদ্দ কমছে। ৫০ থেকে ১০০ টাকা বৃদ্ধি অপর্যাপ্ত। অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের জন্য পেনশন স্কিমের মতো বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পেনশন স্কিম প্রস্তাবিত বাজেটের নেট বরাদ্দের ২২ শতাংশ। সরকার খণ্ডিত, অন্তর্ভুক্তি ও বর্জন ত্রুটিযুক্ত সামাজিক সুরক্ষাজাল কর্মসূচিগুলোতে কোনো পরিবর্তন আনেনি। ডেটাবেজ, ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম এবং সুবিধাভোগী নির্বাচনের জন্য বিশেষভাবে তহবিল বরাদ্দ করে নেই। সাংবিধানিক অনুজ্ঞা, ‘প্রত্যেকের কাছ থেকে তার ক্ষমতা অনুযায়ী, প্রত্যেকের কাজ অনুযায়ী’ সর্বজনের কাছে নগদ সরবরাহ করতে পূর্ণ জীবনচক্রভিত্তিক সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা চালু করেনি।
একইভাবে সামাজিক ব্যয় তথা স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়েনি। বিদায়ী বছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে বাজেট বরাদ্দের অংশ হ্রাস করায় জনগণ সেবাগুলোর বর্ধিত ব্যয় থেকে কোনো স্বস্তি পাবে না।
বাজেটে যে পদ্ধতির প্রস্তাব করা হয়েছে, তা দরিদ্র ও নিঃস্ব মানুষের সমস্যার কোনো টেকসই সমাধান দেবে না। সরকার মনে করে যে দরিদ্র জনগোষ্ঠী অনেকাংশে কমে গেছে এবং অতিদরিদ্র মানুষ দেশে নেই বললেই চলে। কিন্তু প্রকৃত চিত্র ভিন্ন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ব্যবহৃত দারিদ্র্যের সংজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন সত্ত্বেও উক্ত জরিপ অনুযায়ী, দারিদ্র্য হ্রাসের গতি কমেছে। মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি কম হারে বাড়ায় নতুন দরিদ্র তৈরি হচ্ছে। বর্তমানে প্রচলিত দারিদ্র্যবিমোচন কৌশল বহিঃস্থ আঘাত নিরসনে সক্ষম নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান তৈরির ব্যর্থতা। কর্মে নিয়োজিত আছে; কিন্তু দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানকারী মানুষ বাড়ছে। আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থানের অনুপস্থিতিতে টিকে থাকতে, আত্মকর্মসংস্থানে বাধ্য হচ্ছে। বিআইডিএসের জরিপ জানাচ্ছে, ২০১৯ সালের ৩৩ দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে বেড়ে দরিদ্রদের মধ্যে আত্মকর্মসংস্থানের হার ২০২২ সালে ৩৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
কাঠামোগত বড় ব্যাধি তথা বৈষম্য নিরোধের কৌশল বাজেটে অনুপস্থিত। পক্ষপাতমূলক নীতিকাঠামো আয় ও সম্পদের বৈষম্য বাড়াচ্ছে। ১২ বছর ধরে গিনি সহগ ঊর্ধ্বমুখী। ২০২২ সালে শূন্য দশমিক ৪৯৯ পৌঁছেছে।
বিনিয়োগ স্থবিরতার অগস্ত্যযাত্রা
প্রস্তাবিত বাজেটে স্থানীয় শিল্পের উন্নয়নে কোনো দৃশ্যমান প্রণোদনা না থাকলেও অতিরিক্ত ভ্যাট প্রস্তাব করা হয়েছে। ডেটাবেজ, অপারেটিং সিস্টেম, অ্যান্টিভাইরাস, ওয়ার্ড প্রসেসর, স্প্রেডশিট ইত্যাদির মতো প্রয়োজনীয় সফটওয়্যারের জন্য ৫ থেকে ২৫ শতাংশ কর বাড়লে আইসিটি শিল্প কীভাবে রক্ষা হবে? চতুর্থ শিল্পবিপ্লব তথা স্মার্ট বাংলাদেশের সক্ষমতাকে কেন ব্যয়বহুল করা হচ্ছে?
স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ উল্লেখ ছাড়া পরবর্তী প্রস্তুতির কোনো পদক্ষেপ বাজেটে নেই। বিশিল্পায়ন নিরোধ, বহুমুখীকরণ, উৎপাদনশীলতা ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির কৌশল অনুল্লেখিত। বর্তমানের ভোগ ব্যয়কেন্দ্রিক জিডিপি বৃদ্ধির মডেল থেকে বেরিয়ে দেশীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগকেন্দ্রিক টেকসই সবুজ প্রবৃদ্ধির কাঙ্ক্ষিত অগ্রযাত্রা অধরাই থেকে গেল।
ঋণ-দায় অনালোচিত
বাজেট ঘাটতিকে আইএমএফের সীমায় সীমিত করার মরিয়া প্রচেষ্টায় অস্বাভাবিক উচ্চ রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। ধনীদের দাতব্য প্রসারিত করে জীবনযাত্রার ব্যয়-সংকটে নিপতিত মধ্যবিত্তের ওপর ন্যূনতম দুই হাজার টাকা কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে।
অন্যদিকে চার কোটি টাকা পর্যন্ত মোট সম্পদের ওপর কোনো সারচার্জ দিতে হবে না। বিনিয়োগের ট্যাক্স ক্রেডিট নিয়মের পরিবর্তন প্রস্তাব উচ্চ আয়কারীদের উপকৃত করবে। কর ফাঁকি, কর ছাড় এবং কর পরিহারসংক্রান্ত কোনো সংস্কার কর্মসূচির ঘোষণা নেই। বাড়তি বিদ্যুৎ ভর্তুকি কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তা স্পষ্ট করা হয়নি। এটা কি ক্যাপাসিটি চার্জে যুক্ত হবে? শ্রীলঙ্কার পরে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে খেলাপি ঋণে ন্যুব্জ ব্যাংকিং খাত শুকিয়ে যাওয়ায় গোষ্ঠীতন্ত্র বাজেটের মাধ্যমে স্বজনতোষী পৃষ্ঠপোষকতার সংস্কৃতি বেড়েই চলবে?
বাজেটের একটি বড় অংশ ব্যাংকঋণ ও বৈদেশিক সহায়তায় অর্থায়ন করা হবে। উন্নয়ন অংশীদারদের জন্য ধার্য করা লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বিধায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ বাড়বে। মুদ্রাস্ফীতির আগুনকে আরও উসকে দেবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নেওয়ায় নতুন টাকা ঢুকবে। বাংলাদেশে অর্থ গুণক পাঁচ গুণের মতো হওয়ায় ৬৯,২০৮ কোটি টাকা ৩,৪৬,০৪০ কোটি টাকা হতে পারে। এই অতিরিক্ত অর্থ পণ্যের অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি করে দাম বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি ঘটাবে।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় অনালোচিত থেকেছে। সাম্প্রতিক কালে সার্বিক লেনদেন ভারসাম্যের ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতি বেড়েই চলেছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন বন্ধ না–ও হতে পারে। সভরেন গ্যারান্টি দেওয়া বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ২৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সাড়ে সাত বছরে বৈদেশিক ঋণ ১২৮ শতাংশ বেড়ে ৯৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৫-১৬ পর্যন্ত ঋণের পরিমাণ ৪১ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার হলেও গত সাড়ে সাত বছরে ৫২ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ নিয়েছে। সরকারের ঋণ-জিডিপি অনুপাত ২০১৪ সালের ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৩ সালে ৪২ দশমিক ১ শতাংশ। ঋণ দায় পরিশোধ মাথাব্যথার কারণে পরিণত হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গর্বের দুই স্থানেই আঘাত পড়েছে। নিয়ন সাইনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঘোষিত হতো। ওয়েবসাইটের স্ক্রলে আন্তর্জাতিক ঋণমান রেটিং দেখানো হতো। মুডিস দেশের রেটিং অবনমনের পর সাতটি বেসরকারি ব্যাংকেরও রেটিং অবনমন করেছে। ঋণমান অবনমনের বিরূপ প্রভাব দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। অবনমনের উল্লিখিত তিনটি কারণ তথা বাহ্যিক দুর্বলতা, তারল্যঝুঁকি এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা অভ্যন্তরীণ সৃষ্টি; অন্যকে দোষ চাপানোর সুযোগ নেই।
● ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান