বাংলাদেশে সামষ্টিক অর্থনীতি তথা সামগ্রিক অর্থনীতির চর্চায় বহু সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, কোনো কিছুর গভীরে না গিয়ে ওপরে ওপরে থেকে আমাদের মন্তব্য–প্রবণতা; দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সনাতনী অর্থনীতি পঠন-পাঠনের গতি-প্রকৃতি; তৃতীয়ত, অর্থনীতির পর্যালোচনা বা গবেষণায়ও নির্মোহ না থাকতে না পারার ব্যর্থতা অর্থাৎ এখানেও প্রাপ্ত তথ্যের চাইতে আপাত জনপ্রিয়তাকে অধিকতর গুরুত্ব প্রদান আর সর্বোপরি অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনীতির প্রচণ্ড বাড়াবাড়ি। অন্যদিকে এ দেশে একে অপরের সঙ্গে প্রায় ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত থাকার কারণে বেশির ভাগ সময় চাইলেও কেউ ঝেড়ে কাশতে পারেন না।
অর্থ মন্ত্রণালয়কে ধর্তব্যে না আনলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেকেরই ধারণা, অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন তা করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে বরং অদক্ষতা কিংবা ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
নিউইয়র্কভিত্তিক গ্লোবাল ফিন্যান্স ম্যাগাজিন সম্প্রতি একটি র্যাংকিং প্রকাশ করেছে। যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর মহোদয়কে ‘ডি গ্রেড’ দেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ হয়তো যথার্থই বলছেন, এর মাধ্যমে বোঝা যায় যে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভালো অবস্থানে নেই কিংবা কোথাও কোথাও বড় রকমের চিড় ধরেছে।
বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি অনেকটা লাগাম ছাড়া, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতির দিকে, ডলার–সংকট এবং ডলারের বিপরীতে টাকার ধারাবাহিক দরপতন ঘটছে। এসব পরিস্থিতি অর্থনীতিকে জটিল করে তুলেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি কমানো, মুদ্রার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আনা এবং খেলাপি ঋণ কমানো—এই তিন বিষয় ব্যাংকিং খাত ও দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এসব ক্ষেত্রেই আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অদক্ষতা কিংবা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এ পরিস্থিতির জন্য ‘রাজনৈতিক চাপ ও সরকারের নিয়ন্ত্রণ’ বড় ভূমিকা পালন করেছে বলেও তাঁদের অনেকেই মনে করেন।
অনেক দিন ধরেই আমাদের বাজারে ডলারের তীব্র সংকট তৈরি হয়ে আছে এবং কোনোভাবেই বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষেত্রে বাজারে স্থিতিশীলতা আনা যাচ্ছে না। আবার ডলারের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখনকার যে নীতি তা রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করছে বলেও মনে করেন অনেকে।
অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বলেছেন, বিনিময় হার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটানা ১০-১২ বছর প্রায় বসেই ছিল এবং এটাকে বাজারভিত্তিক করার ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন না আনায় একটা সংকট তৈরি হয়েছে। আবার ইচ্ছেমতো টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ধার দেওয়ার কারণেও বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে রেকর্ড পরিমাণ মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ ও ব্যাংকের অনুমোদন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ম্যানেজ করতে আগে পারেনি ও এখনো পারছে না।
তবে কী কারণে প্রচুর হুন্ডি হচ্ছে, কেন জোর করে অনেক দিন বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাড়তে দেওয়া হয়নি, কেন অন্য অনেক সমপর্যায়ের দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়ালেও আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক জোর করে সুদের হার কমিয়ে রেখেছে কিংবা তারা কেন চিহ্নিত অর্থ পাচারকারী বা দুষ্ট ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে কোনো নৈতিক অবস্থান নিতে পারে না, সেই প্রশ্নগুলোর উত্তরও তাদের কেউ দিতে পারছেন না। উত্তর নেই, তারা কেন ছোটখাটো ব্যাপারেও সরকারের সর্বোচ্চ অফিসের দিকে তাকিয়ে থাকে সেই প্রশ্নেরও।
অনেকেই মনে করেন, বাজারে ডলারের মূল্য নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কার্যকর ও স্থিতিশীল কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। অনেকেরই ধারণা ডলারের মূল্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে সেটা বাজার অর্থনীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। পৃথিবীর অনেক দেশ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে সাফল্য দেখালেও বাংলাদেশ সেটা পারছে না। সরকারি হিসাবে আগস্ট মাসে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রায় ১০ শতাংশ। শুধু খাদ্য মূল্যস্ফীতি আলাদা করলে এর হার ১২ দশমিক ৫ শতাংশ।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা ও বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেমন সফলতা পায়নি, তেমনি নিজেদের ঘোষিত মুদ্রানীতি বাস্তবায়নেও তারা সাফল্য পায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিন্তা করা উচিত, যেন তাদের নীতিটা বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়। মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে ও যে মুদ্রানীতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষণা করেছে, সেগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা আছে, তা দূর করার ক্ষেত্রে প্রচুর অদক্ষতা এমনকি সীমাবদ্ধতাও আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট ও রিজার্ভ ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে, এসব বিষয়ে যে নীতিগুলো এখন তারা অনুসরণ করছেন সেগুলোতেও দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
ব্যাংকগুলোতে নানাবিধ সংকটের চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে গণমাধ্যমে। ব্যাংক খাতের এ দুরবস্থা নিয়ে কখনোই কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থনীতিবিদেরা ইতিমধ্যেই বলেছেন, ব্যাংক খাতকে তদারকিতে রাখার ক্ষেত্রে সফল হতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং একই সঙ্গে মুদ্রানীতিতে যেসব নীতিমালা ঘোষণা করা হয়েছিল, সেগুলো বাস্তবায়নেও সফলতা নেই তাদের। মুদ্রানীতিতে অনেক ভালো কথা বলা হয়েছে; কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। কিংবা বাস্তবায়ন কার্যক্রম নিয়ে সঠিক নজরদারি নেই।
আমরা অনেক দিন থেকেই শুনে আসছি, ব্যাংকিং খাতসহ অনেক বিষয়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত আসে রাজনৈতিক দিক থেকে। এর জন্য শুধু গভর্নরকে দোষ দেওয়া সঠিক হবে না বলেও সম্প্রতি মন্তব্য করেন সাবেক এক গভর্নর। অনেকেরই ধারণা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বরং ওই স্বাধীনতাই নেই। এ কারণে তাঁদের পেশাদারিও তৈরি হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের অদক্ষতার মূলেই রাজনৈতিক চাপ এবং এটি সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে এর সাফল্য–ব্যর্থতা নির্ভর করে নজরদারির ক্ষেত্রে সরকারের নীতি-সিদ্ধান্ত কতটা ভালো তার ওপর। সেই সঙ্গে গড়পড়তা জ্ঞানের অধিকারী সরকারি কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষিপ্রতা এবং অপরাপর দেশের আলোকে গুণগত নীতি-সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো শিক্ষা-দীক্ষাও প্রয়োজন।
বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন সবার জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে আর আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যে ইঙ্গিত দিচ্ছে, তাতে চলতি বছরের শেষ নাগাদ রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি কমেছে এবং এর জের ধরে ব্যাংকে সঞ্চয় কমে গেছে। সমস্যা তৈরি হয়েছে লেনদেনের ভারসাম্যের ক্ষেত্রেও। রাজস্ব বাড়ছে না; বরং আনুপাতিক হারে কমে যাচ্ছে। রেমিট্যান্স আসছে না। বাড়ছে না রিজার্ভ। আবার রাজনৈতিক কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ন্যূনতম সংস্কারের কাজেও হাত দিতে পারেনি।
পত্রিকান্তরে দেখেছি,কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, তাঁরা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন, সেগুলো সবার কাছে যথাযথ না–ও মনে হতে পারে; কিন্তু পরিস্থিতি ও বাস্তবতা বিবেচনা নিয়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি প্রণয়ন করেছে। সম্প্রতি আমরা দেখছি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের নীতি ও করণীয় সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণও শুরু করেছেন। যার মূল লক্ষ্য হয়তো দ্রুত মূল্যস্ফীতি হ্রাস করে অর্থনীতিতে আবার গতি সঞ্চার করে।
গ্লোবাল ফিন্যান্স ম্যাগাজিন তাদের প্রতিবেদনে মূলত বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মূলত এসব দুর্বলতার কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে ‘ডি গ্রেডে’ রাখা হয়েছে। এর আগে ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ‘সি গ্রেড’- এ ছিলেন। ২০১৫ সালে ‘বি মাইনাস’ গ্রেডেও উন্নীত হয়েছিলেন তখনকার গভর্নর। পরে আট কোটি ডলার রিজার্ভ চুরির ঘটনার জের ধরে সেই গভর্নরকে আবার পদত্যাগও করতে হয়েছিল। এরপর দায়িত্ব নেওয়া গভর্নর কখনো ‘বি’, কখনো ‘সি’ আবার কখনো ‘ডি’ গ্রেডভুক্ত হয়েছিলেন।
মুদ্রানীতি করার আগেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের মতামত নিয়েছিল এবং এখন তারা আবার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করে বিশ্লেষণ করে দেখছেন, কোথাও ব্যাংক ভুল করেছে কি না, কিংবা যে পথে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এগোচ্ছে, সেটি ঠিক আছে কি না। আমরা জানতে পেরেছি, তিনটি চ্যালেঞ্জ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন কাজ করছে—মূল্যস্ফীতি কমানো, বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা ও মন্দ ঋণ।
অনেকের মতে, অর্থনীতিতে কোনো সংকটের সরাসরি ওষুধ নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবকিছু বিশ্লেষণ করে নীতি প্রণয়ন করে। সেটি কারও মতের সঙ্গে মিলতে পারে, আবার কারও সঙ্গে না–ও মিলতে পারে। যখন যেটি ভালো মনে হয়, সেটিই করার চেষ্টা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অগ্রাধিকার হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং সেটি নিয়েই কাজ চলছে বলে পত্রিকান্তরে দাবি করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কেউ কেউ।
তবে কী কারণে প্রচুর হুন্ডি হচ্ছে, কেন জোর করে অনেক দিন বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার বাড়তে দেওয়া হয়নি, কেন অন্য অনেক সমপর্যায়ের দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়ালেও আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক জোর করে সুদের হার কমিয়ে রেখেছে কিংবা তারা কেন চিহ্নিত অর্থ পাচারকারী বা দুষ্ট ঋণগ্রহীতাদের বিরুদ্ধে কোনো নৈতিক অবস্থান নিতে পারে না, সেই প্রশ্নগুলোর উত্তরও তাদের কেউ দিতে পারছেন না। উত্তর নেই, তারা কেন ছোটখাটো ব্যাপারেও সরকারের সর্বোচ্চ অফিসের দিকে তাকিয়ে থাকে সেই প্রশ্নেরও। এমনকি কেউ নির্দিষ্ট করে বলতেও পারছেন না, একটি প্রায় বাজার-অনভিজ্ঞ ও জনবিচ্ছিন্ন নাগরিক সমাজ বা আমলানির্ভর রাজনৈতিক ব্যবস্থার পক্ষে অর্থনীতির মৌলিক সমস্যার সমাধান সত্যিকার অর্থেই সম্ভব কি-না।
● মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক