জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে এশিয়া টাইমস-এ এক মতামতে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অধীন ২০২৩ সালটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাজে একটি বছর হতে চলেছে। নতুন বন্ধু তৈরিতে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনের দারুণ সাফল্যের বিপরীতে বাইডেন প্রশাসনের সাফল্যহীনতার ওপর ভিত্তি করেই আমি সেই লেখার উপসংহার টেনেছিলাম।
তিন মাস পর এসে বিশ্বজুড়ে ঘটনাপ্রবাহের যে গতিপ্রকৃতি তা থেকে আমি নিজেকে বলতেই পারি, আমার সেই ভবিষ্যদ্বাণী কতটা সত্য হতে চলেছে।
জানুয়ারি মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিং পিংকে সৌদি আরব লালগালিচা অভ্যর্থনা দেয়। চীনের সঙ্গে ২৫ বিলিয়ন ডলারের তেল চুক্তি করে। সৌদি আরবের আয়োজনে মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশ নিয়ে গঠিত গালফ করপোরেশন কাউন্সিলের সম্মেলনে অতিথি হিসেবে ছিলেন সি চিন পিং। তেল বিক্রি এবং অবকাঠামো নির্মাণে সহযোগিতার ব্যাপারে সি চিন পিংয়ের সঙ্গে আলোচনা করেন মধ্যপ্রাচ্যের নেতারা।
দুই বছর আগে ইরানের সঙ্গে চীন ২৫ বছরের কৌশলগত সহযোগিতা চুক্তি করেছিল। এভাবেই ঐতিহাসিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দুই শত্রুরই বন্ধু হয়ে যায় চীন।
এরপর মার্চ মাসে, বেইজিংয়ে সৌদি আরব ও চীনের সঙ্গে চার দিনের বৈঠক শেষে চীন ঘোষণা দেয় যে চিরশত্রু দেশ দুটি পরস্পরের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় রাজি।
আমাদের সময়ের শান্তিচুক্তি
সৌদি আরব ও চীনের চুক্তিটি বড় একটা চুক্তি। পুরো বিশ্বকে সেটা বিস্মিত করেছে। সুন্নি অধ্যুষিত সৌদি আরব ও শিয়া অধ্যুষিত ইরানের মধ্যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শত্রুতা চলে আসছে। চীন এ ক্ষেত্রে সৎ মধ্যস্থতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং দুই পক্ষকে একত্রে বসিয়েছে।
শান্তি স্থাপনে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চীনের ভূমিকা সঠিক। চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিশালী পরাশক্তি। চীন তাদের থেকে কম শক্তির কোনো দেশের সঙ্গে গুন্ডামি করে না। সবার সঙ্গেই মানিয়ে চলার পথ খোঁজে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চীন তিনটি নীতির ওপর জোর দেয়। অন্য দেশের জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা এবং যৌথ স্বার্থ ও পারস্পরিক লাভের ওপর ভিত্তি করে যৌথ উন্নয়নের পথ অনুসন্ধান করা।
সম্প্রতি সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক বিপর্যয়ের ঘটনাটি এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি কঠিন এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়াতে বাধ্য হয়। নীতি সুদহার বাড়ানোর মানে হচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব বিলের অবমূল্যায়ন ঘটানো। ব্যাংক কম সুদহারে সেটা কিনেছিল। সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের জমাকৃত সম্পদের মূল্যমান কমে যাওয়ায় ব্যাংকটি নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায়।
সৌদি-ইরান কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই মস্কোয় সি চিন পিং তাঁর ভালো বন্ধু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার সংঘাত নিরসনে ১২ দফার শান্তি পরিকল্পনা পেশ করেন।
পশ্চিমা বিশ্ব খুব দ্রুত এই পরিকল্পনাকে অসাড়, অস্পষ্ট এবং ইউক্রেনের পুরো ভূখণ্ড থেকে রাশিয়ান সৈন্য প্রত্যাহারের শর্ত না থাকায় রাশিয়ার পক্ষের বলে তকমা সেঁটে দেয়।
কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব একটা বিষয় খুব স্পষ্ট করে এড়িয়ে যাচ্ছে আর সেটা হলো, তারা যে শর্ত দিয়েছে, সেই অনুযায়ীই শান্তি আলোচনা শুরু করতে হবে—সত্যিকারের মধ্যস্থতা এভাবে শুরু হয় না।
চীনের মধ্যস্থতা স্বাগত জানাতে পারেন জেলেনস্কি
এর আগে একটি লেখায় আমি ব্যাখ্যা করেছিলাম, চীনের শান্তি পরিকল্পনা কেন ভলোদিমির জেলেনস্কির কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে। জেলেনস্কি দেখছেন যে এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে সহায়তা করার ক্ষেত্রে পশ্চিমা মিত্ররা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাদের সেই সহায়তা ছাড়া জেলেনস্কির আশা পূরণ হওয়ার নয়।
ওয়াশিংটনের দূত হিসেবে কিয়েভে গিয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা যখন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দিয়ে এসেছেন, তখন জেলেনস্কি জনসমক্ষে শান্তিচুক্তির ক্ষেত্রে চীনের মধ্যস্থতাকে স্বাগত জানিয়েছেন। সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে চুক্তি দেখে নিশ্চিতভাবেই আশ্বস্ত হয়েছেন জেলেনস্কি।
সি চিন পিং যখন বিশ্বনেতা হিসেবে নিজের মর্যাদা উঁচুতে নিয়ে যাচ্ছেন, শান্তি প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন, সে সময় জো বাইডেন কী করছেন?
আগামী দিনের ইতিহাসে দেখা যাবে যে ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসে বাইডেন প্রশাসন এমন দুটি বাজে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার ফলাফল সুদূরপ্রসারী। পুরো বিশ্বের জন্যই তা বিপদ তৈরি করছে।
বাইডেন প্রশাসন রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রে থাকা রাশিয়ার সব ডলার বাজেয়াপ্ত করেছে। রাশিয়াকে নতজানু করার জন্য এ দুটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওয়াশিংটন যেটা প্রত্যাশা করেছিল রাশিয়ার অর্থনীতি তার থেকেও অনেক ভালো অবস্থায় রয়েছে।
ডলারকে অস্ত্রে পরিণত করা
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশ থেকে বাণিজ্য খাতে বাধা পাওয়ার পর চীন, ভারত, পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ বিশ্বে বাণিজ্য বাড়িয়েছে চীন। এ বছরে চীনের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্য ২০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে এবং চীনের মুদ্রা রেনমিনবির মাধ্যমে লেনদেন করতে রাজি হয়েছে রাশিয়া।
চীনের কাছে তেল বিক্রি করে প্রচুর পরিমাণে ইয়ান কামাচ্ছে রাশিয়া। এ অবস্থায় অন্যান্য দেশ দেখছে যে রাশিয়ার সঙ্গে ইয়ানে বাণিজ্য করা তাদের জন্য সুবিধাজনক। নিজস্ব মুদ্রা ডলারে রূপান্তর করতে যে অতিরিক্ত খরচ হয়, সেটা এড়াতে পারছে।
ডলারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে বাইডেন প্রশাসন অন্যান্য দেশের ওপর সফল (!) একটি ধারণা বপন করে দিয়েছে। সেটা হলো, অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বুঝতে পারছে, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে ডলার নির্ভরযোগ্য মুদ্রা নয়।
সম্প্রতি আসিয়ান দেশগুলো ডলার, ইউরো অথবা ওন ব্যবহার না করে কীভাবে লেনদেন করা যায়, এ বিষয়ে আলোচনা করেছে। যদি সত্যি সত্যি তারা ডলার, ইউরো, ওন বাদ দেয়, তাহলে বিকল্প কী? সে ক্ষেত্রে ইয়েন অথবা তাদের নিজেদের মুদ্রা বিকল্প হতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে চীন, এমনকি জাপান তাদের ডলারের মজুত কমিয়েছে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চীন ও রাশিয়া সোনার প্রধান ক্রেতা, নিঃসন্দেহে ডলার ছেড়ে দিয়েই তারা সোনা কিনছে।
সম্প্রতি সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক বিপর্যয়ের ঘটনাটি এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি কঠিন এক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়াতে বাধ্য হয়। নীতি সুদহার বাড়ানোর মানে হচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব বিলের অবমূল্যায়ন ঘটানো। ব্যাংক কম সুদহারে সেটা কিনেছিল। সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের জমাকৃত সম্পদের মূল্যমান কমে যাওয়ায় ব্যাংকটি নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ ব্যাংকই সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের কায়দাতেই পরিচালিত হয়। তারা ভাগ্যবান যে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয় খুব দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে এবং তারল্যের জোগান দিয়ে বিপর্যয় ঠেকিয়েছে।
জর্জ কো চীনের কৌশল ও ব্যবসা পরিচালনা করে এমন একটি উপদেষ্টা ফার্মের সাবেক উপদেষ্টা
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে নেওয়া অনূদিত