১৯৬৫ সালে লেখক পান্নালাল দাশগুপ্তের কাছে এক চিঠিতে কবি, সাহিত্যিক ও চিন্তক অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন, ‘গণতন্ত্রে যে দুটি জিনিস একান্ত আবশ্যক—যে দুটি না হলে ওটা গণতন্ত্রই নয়—সে দুটির একটি হচ্ছে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন, অপরটি নির্বিবাদে ক্ষমতা হস্তান্তর।’ প্রায় ৬০ বছর আগে অন্নদাশঙ্কর রায় এ কথা লিখেছিলেন দুবছর পরে অনুষ্ঠিত ভারতে চতুর্থ লোকসভার সাধারণ নির্বাচনের কথা ভেবে। ভারত রাষ্ট্রটির বয়স তখন মাত্র ১৮ বছর। সেই নবীন রাষ্ট্রের গণতন্ত্র নিয়ে লেখকের মনে কোনো শঙ্কা জেগেছিল, তাই হয়তো এ কথা লিখেছিলেন।
১৮ বছর বয়সী ভারত এখন ৭৬ বছরে এসে দাঁড়িয়েছে। অন্নদাশঙ্কর রায় যদি বেঁচে থাকতেন, তিনি এখন ভারতের গণতন্ত্র নিয়ে কী বলতেন, জানি না। তবে ভারতের ২৪ বছরের কনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে বসে সেই উক্তি এখন অনেকেই উচ্চারণ করছেন একই শঙ্কা নিয়ে। পৃথিবী এগিয়ে যায়, দেশ-কাল-মানচিত্র পাল্টায়, প্রযুক্তি পাল্টায়; কিন্তু গণতন্ত্র নিয়ে মানুষের শঙ্কা যায় না। তার রোগ কিংবা ত্রুটি সারে না। এটা কী গণতন্ত্রের দুর্বলতা, নাকি গণতন্ত্রের রথের সারথিরাই চিরকাল দুর্বলই থেকে যায়।
গণতন্ত্রের দুর্বলতা নিয়ে অন্নদাশঙ্কর রায় সেই চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘গণতন্ত্রের দুর্বলতা হচ্ছে এইখানে যে সব কটা দল খেলার নিয়ম না মানে, কয়েকটা দল যদি খেলায় ফাউল করতে বদ্ধপরিকর হয়, জনগণ যদি উদাসীন বা বিভ্রান্ত হয়, নির্বাচনে যদি জনগণের ইচ্ছা প্রতিফলিত না হয়, অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যদি নির্বাচন স্থগিত থাকে, সাহসিক সিদ্ধান্ত নিতে যদি শাসক দল গড়িমসি করে, জনপ্রিয়তা হারাবার ভয়ে যদি নেতারা ভুল নেতৃত্ব দেন, তাহলে মানুষ তিক্তবিরক্ত হয়ে বলে, কী হবে এমন গণতন্ত্র নিয়ে?’
কী আশ্চর্য! গণতন্ত্র নিয়ে ৬০ বছর আগের কথাগুলো যেন এই মাত্র কোনো এক চায়ের আড্ডা থেকে তুলে আনা। হুবহু না হলেও গণতন্ত্র নিয়ে এমন হতাশার কথাই আমরা শুনি ও শুনে আসছি। গণতন্ত্র অনুশীলনের প্রধান প্রক্রিয়া ভোটের সময় এলেই কথাগুলোর উচ্চারণ আরও বেশি বেড়ে যায়। কয়েক মাস পর দেশে আরেকটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচন কেমন হবে? এর প্রক্রিয়া কেমন হবে?
দেশের চলমান ঘটনাপ্রবাহে মানুষের মনে শুধু আশঙ্কা আর প্রশ্নই জমা হচ্ছে। মূল নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে অগুরুত্বপূর্ণ একটি উপনির্বাচনে যখন কোনো প্রার্থী মারধরের শিকার হন, তখন মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে—সেই পুরোনো প্রশ্ন—‘এটা কিসের গণতন্ত্র?’ যখন দলগুলো পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করে, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়, যখন প্রতিটি দলই নিজের নিজের অবস্থানে পাথরের মূর্তির মতো অনড় হয়ে থাকে, যখন সংঘর্ষ বাঁধে তখন শঙ্কিত মানুষ বলে, গণতন্ত্র বিপন্ন হয়েছে। আর সেই বিপন্ন গণতন্ত্র বিপর্যস্ত করে মানুষের জীবন। আসলে কি তা-ই? মানুষের শান্তির জীবনে অশান্তির ঝড় আনে কি দুর্বল গণতন্ত্র? দলে দলে দলাদলি করে, ক্ষমতামত্ত কিছু মানুষ দেশটাকে কুরুক্ষেত্র বানায়। ভাঙচুর, পেট্রলবোমা, গুলি ছুড়ে, মানুষ গুম করে সুস্থির জীবনকে অস্থির করে তোলে কি গণতন্ত্র? নাকি মানুষ করে। আমরা নিজেরা দোষ করি। আর বলি গণতন্ত্রের দোষ।
এটা ইতিহাসের দায়। আমাদের দেশে উভয় দলের কোটি কোটি সমর্থক, কর্মী। দলের নেতৃত্ব যদি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেন, তবে কোটি কোটি মানুষের মনে কালো দাগ তৈরি করে। সেই দাগ কলঙ্কের। সেই দাগ যুগ যুগ ধরে রয়ে যায়। একটি নতুন সূত্র ঐতিহাসিক প্রয়োজনে আমাদের খুঁজে বের করতে হবেই। মানুষ গণতন্ত্রে নিজেকে সম্পৃক্ত অনুভব করে একমাত্র নির্বাচনেই। আর সেই নির্বাচন থেকে যদি কোনো কারণে সে বাদ পড়ে যায়, তবে তার স্বাধীনচেতা মন অন্য সব পাওনাকে তুচ্ছ মনে করে।
গণতন্ত্র আসলে একটি স্বপ্নমাত্র। মানুষ তার সব পাওনার অধিকার থেকে গণতন্ত্রের বোধ তৈরি করে। কিন্তু সে তার সব পাওনা কখনো পায়নি। প্রকৃত গণতন্ত্র কখনো দেখা দেয়নি। হয়তো কখনো দেখা দেবেও না। একদম রূপকথার পরির মতো। মানুষ কখনো পরি দেখেনি। অথচ পরি বলতেই তার চোখে ভাসে অনিন্দ্যসুন্দরী ডানাযুক্ত সুখকর একটা কিছু। গণতন্ত্রও ঠিক তা-ই। এটার কথা ভাবলেই মানুষের মনে আসে সুখানুভূতি। মানুষ ভাবে যেখানে গণতন্ত্র থাকে, সেখানে রাষ্ট্রক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করে না কেউ। সেখানে দলগুলো পরমতসহিষ্ণু হয়। হিংসা আর বলপ্রয়োগ থাকে না।
যেখানে গণতন্ত্র থাকে, সেখানে টেবিলের এপার-ওপার দুই পাড়ের মানুষের কান সজাগ থাকে, অপর পক্ষ কী বলে তা শোনার জন্য। গণতন্ত্র যেখানে থাকে, সেখানে দলগুলো নিজেরা অংশগ্রহণ না করে ভোটকে একতরফা বলে চিৎকার-চেঁচামেচি করবে না।
আন্দোলনের নামে মানুষের জীবনকে বিপন্ন করবে না। যেখানে সব দলের, সব লোকের নির্ভয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচন হয়। যেখানে মানুষ কথা বলতে পারে এবং মানুষ সত্য কথা বলার জন্য শাস্তি পায় না, সেটাই গণতন্ত্র। সেই গণতন্ত্র আসলেই পরির মতো, যা কখনো মানুষ দেখেনি। যার স্বাদ এ দেশের মানুষ কখনো পায়নি।
একটা অপুষ্ট গণতন্ত্রের ভেতর থেকে অদেখা গণতন্ত্রের স্বপ্নে মানুষ দাবি করে—এটা চাই, ওটা চাই। মানুষের মর্যাদা চাই, সংবাদপত্রের নির্ভেজাল স্বাধীনতা চাই, নারীর অধিকার চাই, সম্পদের সুষম বিকাশ চাই ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই রকম গণতন্ত্রের স্বপ্ন থেকেই চলমান সংকট থেকে পরিত্রাণ চায় মানুষ। একটা সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন হোক আমাদের দেশে। অবকাঠামো উন্নয়নের বিপুল উত্থানের মতো গণতন্ত্রেরও বিকাশ হোক এই দেশে। অন্ধ, কানাগলির মতো একমুখো পথে আমাদের গণতন্ত্র চলতে চলতে যেন পথ হারিয়ে না ফেলে।
গণতন্ত্রে ভিন্ন মত ও আদর্শের অনুসারীদের মধ্যে মতদ্বৈততা ও অমিল থাকবেই। কিন্তু পরস্পর মুখ ঘুরিয়ে রেখে পৃষ্ঠপ্রদর্শনে লিপ্ত থাকলে আর যা-ই হোক, গণতন্ত্রের কোনো সমস্যার সমাধান হবে না। ঠিক এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির উভয় দলের দায়িত্ব নিজেদের অবস্থান থেকে সরে এসে একটা তৃতীয় পথ বা উপায় খুঁজে বের করা।
এটা ইতিহাসের দায়। আমাদের দেশে উভয় দলের কোটি কোটি সমর্থক, কর্মী। দলের নেতৃত্ব যদি কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেন, তবে কোটি কোটি মানুষের মনে কালো দাগ তৈরি করে। সেই দাগ কলঙ্কের। সেই দাগ যুগ যুগ ধরে রয়ে যায়। একটি নতুন সূত্র ঐতিহাসিক প্রয়োজনে আমাদের খুঁজে বের করতে হবেই। মানুষ গণতন্ত্রে নিজেকে সম্পৃক্ত অনুভব করে একমাত্র নির্বাচনেই। আর সেই নির্বাচন থেকে যদি কোনো কারণে সে বাদ পড়ে যায়, তবে তার স্বাধীনচেতা মন অন্য সব পাওনাকে তুচ্ছ মনে করে। মানুষ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে চায় নিজের প্রিয় প্রার্থীকে। কিন্তু ভোট দিতে যদি সে অপারগ হয়? আবার যদি সে দেখে তার পছন্দের দলটি ভোটেই অংশ নেয়নি, তবে কোটি কোটি সমর্থককে তারা বঞ্চিত করল।
অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর চিঠির একপর্যায়ে লেখেন, ‘দেশের পক্ষে যেমন স্বাধীনতা, ব্যক্তির পক্ষে তেমনি ভোট। একজন ব্যক্তির সবচেয়ে বড় সম্পদ, বড় অধিকার তার ভোট।
সেটি কেড়ে নিলে ভবিষ্যৎ তাকে ক্ষমা করবে না। আবার ভোট বর্জন করে সমর্থকদের ভোট দেওয়া থেকে বঞ্চিত করবে যে দল, তাদেরও ইতিহাস ক্ষমা করবে না।’
ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিসের বার্তা সম্পাদক