দেশে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে আমাদের মতো আমজনতাও এখন খোঁজখবর রাখতে শুরু করেছেন। কারণ, তাঁরা জেনেছেন, রিজার্ভে টান পড়ার কারণে জ্বালানির আমদানি কমাতে হয়েছে। সে কারণে লোডশেডিং শুরু হয়েছে। আবার দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে রেকর্ড পরিমাণ। জনগণের পকেটে এসব কতটা টান তৈরি করেছে, তা তাঁরা হাড়ে হাড়ে টের পেতে শুরু করেছেন। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে চিন্তিত জনগণ এখন দেশের মুদ্রা বিদেশে পাচার নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই আগের চেয়ে বেশি কৌতূহলী। তাঁরা এখন জানেন যে গত ১৪ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার। দেশে যখন রিজার্ভে টান পড়েছে, তখন তাঁরা এই খবরও জেনেছেন যে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থের পরিমাণ গত বছরের তুলনায় এ বছর (২০২২) ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। এসব তথ্য জনগণের গায়ে জ্বালা ধরানোর জন্য যথেষ্ট।
এ–ই যখন পরিস্থিতি, তখন বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাতালি চুয়ার্ড স্পষ্ট করে বললেন, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের জমা করা অর্থের বেশির ভাগই অবৈধ পথে আয় করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্য তিনি দিয়েছেন, তা হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত সুইস ব্যাংক বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে যথাযথ প্রক্রিয়ায় এ ব্যাপারে কোনো তথ্য চায়নি। সুইস রাষ্ট্রদূতের এমন মন্তব্যে যে প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা, তা–ই হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সুইস রাষ্ট্রদূত অসত্য কথা বলেছেন। অন্যদিকে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রাষ্ট্র ও দুদকের কাছে জানতে চেয়েছেন, সরকার সুইস কর্তৃপক্ষের কাছে আদৌ বাংলাদেশিদের অর্থের ব্যাপারে কোনো তথ্য জানতে চেয়েছি কি না। গত রোববার এর জবাব দিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদক। তারা আদালতকে বলেছে, সুইস রাষ্ট্রদূত যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা সঠিক নয়। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মাধ্যমে ৬৭ জনের তথ্য চাওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ১ জনের তথ্য পাওয়া গেছে।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের এই বক্তব্যে কি বিভ্রান্তি কাটল? সুইস রাষ্ট্রদূত যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাকে কি তবে অসত্য বলে ধরে নেব? আসুন, রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের বক্তব্যের পর তাদের আইনজীবীদের উদ্দেশে আদালত যা বলেছেন, তা বিবেচনায় নিই। আদালত বলেছেন, ‘তাঁর (রাষ্ট্রদূতের) বক্তব্যে বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আপনাদের (রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদক) বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বিভ্রান্তি দূর হবে। অর্থ জমাদানকারীদের বিষয়ে আপনারা তথ্য চেয়েছেন, তারা দিচ্ছে না। দিলেও শর্ত সাপেক্ষে। আপনারা তথ্য চেয়েছেন ও পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন, পরিষ্কার করেছেন। মানুষ মূল্যায়ন করবে, সত্যি বলেছেন কি না।’
হাইকোর্ট যেহেতু ‘সত্যি’ মূল্যায়নের ভার মানুষের, মানে আমাদের মতো জনগণের ওপরও কিছুটা ছেড়েছেন, তাই সেই সূত্রে কিছু কথা বলাই যায়। রাষ্ট্রপক্ষ বা দুদকের বক্তব্যে আমাদের বিভ্রান্তি আসলে কাটেনি; বরং কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। আসলে ৬৭ জনের তথ্য চাওয়াসংক্রান্ত যে জবাব রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদক দিয়েছে, তা নতুন নয়। আমাদের অনেকেরই মনে আছে, ‘বাংলাদেশে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিএফআইইউর ২০ বছর’ শিরোনামে গত জুন মাসে একটি সেমিনার হয়েছে। সেখানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিলেন বিএফআইইউর অতিরিক্ত পরিচালক মো. কামাল হোসেন। তিনি তখন বলেছিলেন, বিভিন্ন সময়ে সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের কাছ থেকে বাংলাদেশের ৬৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচার সম্পর্কে বিএফআইইউ তথ্য পেয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গত রোববার প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক লেখায় লিখেছেন, বাংলাদেশ যদি কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড (সিআরএস) পদ্ধতিতে যুক্ত হয়, তবে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে দেশে-বিদেশে সব ধরনের লেনদেনের তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে পেয়ে যাবে। শুধু সুইস ব্যাংক নয়, সিআরএস–ভুক্ত অন্য সব বিদেশি ব্যাংকে লেনদেনের তথ্যও পাওয়া যাবে। কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার রোধে এটা এক কার্যকর পদ্ধতি। দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ ভারত, পাকিস্তানসহ বিশ্বের ১২০টি দেশ এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত।
৬৭ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তথ্য চাওয়ার খবরটি নতুন নয়। তবে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের আইনজীবী সূত্রে নতুন যা জানলাম, তা হলো মাত্র একজন সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে এবং এটা বিএফআইইউর অতিরিক্ত পরিচালকের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রশ্ন হচ্ছে, বাকিদের সম্পর্কে কি তথ্য দেওয়া হয়নি, নাকি তাদের সম্পর্কে দেওয়ার মতো কোনো তথ্য সুইস কর্তৃপক্ষের কাছে ছিল না? রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের আইনজীবীদের বক্তব্যে কিন্তু বিষয়টি পরিষ্কার হয়নি।
আমাদের মনে যে প্রশ্ন এখন বাস্তব কারণে জেগেছে, তা হলো এই ৬৭ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কারা? আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, দুদকের মতো প্রতিষ্ঠান কিছু দুর্নীতির তদন্ত ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় বটে, কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের কেউ বা তাঁদের অনুগ্রহভাজন কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো নজির তাদের নেই। এ কারণেই আমাদের মনে আরও প্রশ্ন জাগে, কিসের ভিত্তিতে এই ৬৭ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা হয়েছিল? এসব ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা যেহেতু সব সময়ই প্রশ্নের মুখে, তাই রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনা বা পক্ষপাত ছাড়া কাজটি হয়েছে, এমন মনে করা কঠিন। সরকার কি আদৌ প্রকৃত সন্দেহভাজনদের ব্যাপারে তথ্য চেয়েছিল? যঁাদের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে, সেই তালিকায় কি সরকারি দলের সঙ্গে যুক্ত বা ঘনিষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত কারও নাম আছে? তা ছাড়া সুইস রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য অনুযায়ী যে প্রক্রিয়ায় আবেদন করলে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশি নাগরিকের অর্থ জমা বা লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায়, বাংলাদেশ কি সেই প্রক্রিয়া মেনে তথ্য চেয়েছে?
সুইস ব্যাংক বা বিদেশের ব্যাংকে টাকা রাখা অপরাধের কিছু নয়, সেই অর্থ বৈধ কি না বা বৈধ পথে পাঠানো হয়েছে কি না, সেটা হচ্ছে আসল কথা। লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেলেই সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায়। বাংলাদেশ সরকার সুইস কর্তৃপক্ষের কাছে তার পছন্দমতো কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের তথ্য না চেয়ে নিয়ম মেনে সব বাংলাদেশি নাগরিকের অর্থ লেনদেনের তথ্য চাচ্ছে না কেন? শুধু ৬৭ জনের কেন?
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গত রোববার প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক লেখায় লিখেছেন, বাংলাদেশ যদি কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড (সিআরএস) পদ্ধতিতে যুক্ত হয়, তবে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে দেশে-বিদেশে সব ধরনের লেনদেনের তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে পেয়ে যাবে। শুধু সুইস ব্যাংক নয়, সিআরএস–ভুক্ত অন্য সব বিদেশি ব্যাংকে লেনদেনের তথ্যও পাওয়া যাবে। কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার রোধে এটা এক কার্যকর পদ্ধতি। দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ ভারত, পাকিস্তানসহ বিশ্বের ১২০টি দেশ এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সিআরএসে বাংলাদেশ যুক্ত হচ্ছে না কেন? সুইস ব্যাংক বা বিদেশি ব্যাংকগুলোতে কারা টাকা রেখেছেন এবং তা বৈধ কি না, সেটা বাংলাদেশ আসলেই জানতে চায় বা চেয়েছে—এ দাবির সত্যতা নিয়ে তাই সংশয় কাটে না।
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক