গত ২৮ জুলাই সন্ধ্যায় রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা নির্ভুল লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম, এ রকম ক্ষেপণাস্ত্রের সাহায্যে ইউক্রেনের নিপ্র অঞ্চলের কমান্ড পোস্টে বা নিয়ন্ত্রণকেন্দ্রে হামলা চালিয়েছে। রোস্তভ প্রদেশের তাগানরগ অঞ্চলের কমান্ড পোস্টে ইউক্রেনের হামলার বদলা হিসেবে এ হামলা চালায় রাশিয়া।
রুশ কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, তারা ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করলেও সেটা শহরের ভবনগুলোর ওপর বিধ্বস্ত হয়। এর মধ্যে একটা শিল্প জাদুঘরও রয়েছে। ইউক্রেনীয়রা যে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে, সেটা এস-২০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্রের রূপান্তরিত সংস্করণ। ভূমিতে হামলা করার মতো সক্ষম করে তোলা হয়েছে।
হামলার মাত্র এক দিন আগে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি নিপ্রো কমান্ড পোস্ট সফর করেন। সেখানে তিনি ইউক্রেনের সেনাপ্রধান ভ্যালেরি জালুঝনির সঙ্গে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে অংশ নেন। ইউক্রেনে সেনা গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানসহ বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করেন।
রাশিয়ার গোয়েন্দারা খুব নিবিড়ভাবে জেলেনস্কিকে অনুসরণ করে চলেছেন। নিপ্রো কমান্ড পোস্টে তাঁর আগমন এবং ইউক্রেনের জেনারেল, কমান্ডার ও সেনা গোয়েন্দাপ্রধানদের সঙ্গে সাক্ষাতের স্থানে এ হামলা সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
ইউক্রেনের সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, রুশদের হামলার লক্ষ্যস্থল ছিল নিপ্রো কমান্ড পোস্টের কাছাকাছি একটি ভবন। কিন্তু পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য হচ্ছে, রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ঠেকাতে গিয়ে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র ভবনটির ওপর গিয়ে বিধ্বস্ত হয়েছে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, এই যুদ্ধ শিগগিরই আরও নিষ্ঠুর যুদ্ধে রূপান্তর লাভ করতে পারে। ইউক্রেন ভূখণ্ডের বাইরে চলে আসায় যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে আসতে পারে। নিজেদের ভূখণ্ডে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে, এমন কোনো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয় ইউরোপ। বড় সংকট এড়াতে কিছু প্রচেষ্টা ও পদক্ষেপ প্রয়োজন।
কিছু ভিডিও ও ছবিতে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনের কমান্ড পোস্টে আঘাত করতে দেখা যাচ্ছে। তাতে কিছু ক্ষয়ক্ষতির চিত্রও দেখা যাচ্ছে। এ হামলায় কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেটা জানা যায়নি। খবরে বলা হয়েছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে মানুষ চাপা পড়েছে। হাসপাতাল থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের রক্ত দেওয়ার আবেদন জানানো হয়েছে। ফলে বোঝা যাচ্ছে, হতাহতের সংখ্যা কম নয়।
এখন পর্যন্ত জানা যায়নি, ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানার সময় ইউক্রেনের কমান্ড পোস্টে সেনা কমান্ডাররা ছিলেন কি না। থাকলে তাঁদের মধ্যে কেউ হতাহত হয়েছেন কি না, জানা যায়নি।
রাশিয়ার ভূখণ্ডে ইউক্রেন এখন হামলা শুরু করেছে। ফলে যুদ্ধ এখন ইউক্রেনের সীমান্তের বাইরেও বিস্তৃত হয়েছে। গত সপ্তাহে মস্কোয় আরেক দফা ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইউক্রেন। রাশিয়া দাবি করেছে, ড্রোনগুলো তারা ভূপাতিত (যদিও সেগুলোর কারণে ভূমিতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে) করেছে।
যাহোক, রাশিয়ার তাগানরগ কমান্ড পোস্টে হামলা রাশিয়ার দিক থেকে বিবেচনা করলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কেননা এমন এক সেনাছাউনি লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে, যেখানে জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমভ ও অন্য উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা আগে সমবেত হয়েছিলেন। ইউক্রেনের কাছে কি বিশেষ গোয়েন্দা তথ্য ছিল যে রাশিয়ার পদস্থ সেনা কর্মকর্তারা সেখানে সমবেত হবেন? ইউক্রেনের হামলায় কোনো সেনা কমান্ডার হতাহত হয়েছেন কি না, সেটাও স্পষ্ট নয়।
ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ অভিযান চলমান এবং দুই পক্ষের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু ইউক্রেনের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি। মার্কিন ও ব্রিটিশ সমর পরিকল্পনাবিদেরা এই পাল্টা আক্রমণের পরিকল্পনা করেছেন। এর উদ্দেশ্য হলো চকিত হামলার মাধ্যমে রাশিয়ান বাহিনীকে হতচকিত করে দেওয়া। এ অভিযানে ইউক্রেনের মাঝারি মাপের কিছু অর্জন থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই রাশিয়া তা পুনরুদ্ধার করে নিচ্ছে।
রুশরা এটা দেখতে পাচ্ছে যে ইউক্রেন তাদের সবচেয়ে সেরা প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ সেনাদের পাল্টা অভিযানে অংশ নিতে পাঠিয়েছে। তাঁরা অত্যন্ত উঁচু মানের পেশাদারি দেখাচ্ছেন। ন্যাটোর কাছে প্রশিক্ষণ পাওয়া এই সেনাদের নৈতিক মানও অত্যন্ত উঁচু। যাহোক, কৌশলগত কম গুরুত্বের একটি অভিযানে সেরা সেনাদের হারানো শেষ পর্যন্ত ইউক্রেন সরকারকে কতটা লাভবান করছে, সেটা তাদের পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।
ওয়াশিংটনের এখন বড় উদ্বেগের কারণ হলো এই যুদ্ধ ইউক্রেনের বাইরেও শিগগিরই বিস্তার লাভ করবে কি না। যুদ্ধের সম্ভাব্য হটস্পট হতে পারে পোল্যান্ড। রুশ ও পোলিশ—দুই পক্ষই সক্রিয়ভাবে প্ররোচনামূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। বেলারুশে ভাগনার গ্রুপের সেনাদের পাঠিয়েছে রাশিয়া, অন্যদিকে বেলারুশ ও ইউক্রেন সীমান্তে সাঁজোয়া যান পাঠিয়েছে পোল্যান্ড।
ইউরোপে যদি যুদ্ধের পরিসর বাড়ে, তাহলে নতুন যুদ্ধকে সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রে বাজে অবস্থায় রয়েছে ন্যাটো। সেনা, গোলাবারুদ, সাঁজোয়া যান ও আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা—সবকিছুর ঘাটতিতে রয়েছে ন্যাটো।
রাশিয়া এখন বড় আকারের সেনা নিয়োগের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এ ঘটনা প্রমাণ করে, বড় পরিসরে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। রাশিয়া শুরু থেকেই বলে আসছে, তারা ন্যাটোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। পোল্যান্ডের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হলে তাদের এ দাবি শক্ত ভিত্তি পাবে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, এই যুদ্ধ শিগগিরই আরও নিষ্ঠুর যুদ্ধে রূপান্তর লাভ করতে পারে। ইউক্রেন ভূখণ্ডের বাইরে চলে আসায় যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে আসতে পারে। নিজেদের ভূখণ্ডে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে, এমন কোনো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয় ইউরোপ। বড় সংকট এড়াতে কিছু প্রচেষ্টা ও পদক্ষেপ প্রয়োজন।
স্টিফেন ব্রায়েন সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসির জ্যেষ্ঠ ফেলো
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত