দক্ষিণ কোরিয়া: ভঙ্গুর গণতন্ত্র সারাইয়ের পথ কী

দক্ষিণ কোরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হান ডাক-সু

এ মাসে দক্ষিণ কোরিয়ায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো—বিশেষত ৩ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলের সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য জারি করা সামরিক আইনের ঘোষণা দেশটির গণতন্ত্রের অসাধারণ স্থিতিস্থাপকতা এবং ভেতরকার ভঙ্গুরতা উভয়কেই স্পষ্ট করে দিয়েছে।

সরকারব্যবস্থাটি এবারের মতো টিকে গেছে বটে, কিন্তু যদি গণতন্ত্র বারবার এমন কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হয়, তাহলে সেখানকার গণতন্ত্র কখনোই নিরাপদ থাকবে না।

প্রথমত, এটি ভালো খবর যে দেশটির পার্লামেন্ট বা জাতীয় পরিষদ দ্রুত প্রেসিডেন্ট ইউনের সামরিক আইন বাতিলের জন্য একটি প্রস্তাব পাস করেছে। তা ছাড়া লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে ইউনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছে এবং ক্ষমতাসীন পিপলস পাওয়ার পার্টির (পিপিপি) আইনপ্রণেতাদের তাঁর অভিশংসন সমর্থনের জন্য চাপ সৃষ্টি করেছে।

তাঁদের প্রচেষ্টা সফল হয়েছে। প্রথম অভিশংসন ভোটে পিপিপি প্রতিনিধিরা জাতীয় পরিষদ থেকে ওয়াকআউট করলেও দ্বিতীয়বারের সময় তাঁরা প্রস্তাবটি সমর্থন করেছেন এবং এটি পাস হয়েছে।

ইউন এখন বরখাস্ত এবং তাঁর অভিশংসন বহাল থাকবে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাঁকে সংবিধান আদালতের সিদ্ধান্তের জন্য ছয় মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। যদি আদালত অভিশংসন বহাল রাখে, তাহলে ৬০ দিনের মধ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

তবে অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হান ডাক-সুর সিদ্ধান্ত এই অস্থির সময়কে আরও অনিশ্চিত করেছে। সেখানে তিনি ৯ সদস্যের আদালতে ৯ জন বিচারক নিয়োগে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এর জের ধরে হান নিজেই এখন অভিশংসনের মুখোমুখি হয়েছেন।

এই চলমান নাটক দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক দুর্বলতাগুলোকে সামনে এনেছে। ১৯৮৭ সালের সংবিধান সংশোধন একটি এক মেয়াদি পাঁচ বছরের প্রেসিডেন্সি প্রবর্তন করে।

নাগরিকেরা সরাসরি জনপ্রিয় ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অধিকার পেয়ে এতটাই আনন্দিত হয়েছিল যে তখন প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা নিয়ে খুব বেশি প্রশ্ন তোলা হয়নি। তবে পরবর্তী সময়ে স্পষ্ট হয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়ার সাংবিধানিক কাঠামোতে যথেষ্ট ভারসাম্য এবং নিয়ন্ত্রণের অভাব রয়েছে।

যদিও সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের নিয়োগ বা অপসারণের সুপারিশ করার দায়িত্ব দিয়েছে, তবে একের পর এক প্রেসিডেন্টরা এই ক্ষমতাগুলো একতরফাভাবে ব্যবহার করে আসছেন।

রাজনৈতিক সংকটের এ চক্র ভাঙতে, ভালো শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে এবং নীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে দক্ষিণ কোরিয়াকে এমন একটি নতুন রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করতে হবে, যেখানে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য থাকবে এবং ক্ষমতার সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা হবে।

এর পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলগুলো কার্যত প্রেসিডেন্ট অফিসের সম্প্রসারণ হিসেবেই কাজ করেছে; স্বাধীন সত্তা হিসেবে কার্যকর নজরদারি করার ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারেনি। এমনকি বিচার বিভাগও প্রেসিডেন্টের প্রভাবের শিকার হতে পারে।

কার্যত কোনো প্রতিষ্ঠানই নির্বাহী ক্ষমতাকে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ভাষ্যকার দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যবস্থাকে ‘সাম্রাজ্যবাদী প্রেসিডেন্সি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

যদিও দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণ সরাসরি ভোটের মাধ্যমে তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে; তবে এ প্রক্রিয়াটি প্রায়ই দলীয় প্রভাব ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দ্বারা প্রভাবিত হয়। ইউটিউব চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো এ সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

এর ফলে অযোগ্য বা কর্তৃত্ববাদী নেতাদের ক্ষমতায় আসা সহজ হয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে চারজন প্রেসিডেন্ট কারাগারে গেছেন, একজন আত্মহত্যা করেছেন এবং তিনজন অভিশংসনের মুখোমুখি হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে ইউনও আছেন।

প্রেসিডেন্টকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, এমন শক্তি হলো বিরোধী দল। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থা (যেখানে বিজয়ীরা সব সুবিধা নিয়ে নেয় আর পরাজিতরা কিছুই পায় না) চরম বিরোধিতা এবং ক্ষমতার লড়াইকে উসকে দেয়।

দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনীতিতে দুটি প্রধান দল—পিপিপি এবং ডেমোক্রেটিক পার্টি প্রধান আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। এর একটি কারণ হলো, দেশটির একক-সদস্য নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক ভোটিং সিস্টেম, যেখানে প্রতিটি এলাকায় একজনই নির্বাচিত হয়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০২০ সালের আইনসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দল মিলে পার্লামেন্টের ৯০ শতাংশ আসন দখল করে, যদিও তারা মোট ভোটের মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ (প্রায় ৬৬ শতাংশ) পেয়েছিল।

এর মানে হলো, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভোটার কোনো প্রতিনিধিত্বই পায়নি; কারণ, তাদের ভোট অন্য ছোট দল বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে ছিল, যারা আসন জিততে পারেনি।

দুই দলীয় ব্যবস্থার আরেকটি সমস্যা হলো, বিরোধী দলগুলো প্রায়ই সরকারের এমন উদ্যোগগুলোও প্রত্যাখ্যান করে যেগুলো যৌক্তিক বা ভালো। কারণ, তারা মনে করে, এগুলো সফল হলে ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয়তা বেড়ে যাবে যা তাদের ভবিষ্যৎ নির্বাচনে বিরোধীদের ক্ষতি করতে পারে। এতে সরকারের কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি হয় এবং রাজনৈতিক অগ্রগতি আটকে যায়।

দক্ষিণ কোরিয়ার দুই দলীয় ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত বিরোধই মূলত প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলের সামরিক আইন জারির যুক্তির ভিত্তি ছিল।

১২ ডিসেম্বর এক ভাষণে ইউন বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন, ‘তারা অসংখ্য সরকারি কর্মকর্তার অভিশংসনের চেষ্টা করছে, যাঁরা কোনো অপরাধ না করেও তাঁদের দায়িত্ব থেকে দীর্ঘ সময় বরখাস্ত হয়ে আছেন।’

ইউন তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেছিলেন, তাঁর নির্বাচনের পর থেকে তাঁর পদত্যাগ বা অভিশংসনের দাবিতে বিরোধী দল ‘১৭৮টি প্রতিবাদ সমাবেশ’ করেছে।

যদিও এটি ইউনের সামরিক আইন জারির সিদ্ধান্তকে ন্যায়সংগত বলে প্রমাণ করে না, তবে এটি প্রমাণ করে যে ১৯৮৭ সালের সংবিধান এখন আর কার্যকর নয়।

আসলে এই চরম মেরুকরণ শুধু অভ্যন্তরীণ শাসনকেই ব্যাহত করে না, বরং এটি ক্ষমতা পরিবর্তনের সময় প্রতিবারই পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনে দেয়, যা রাষ্ট্রের উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

যদি ইউনের অভিশংসন বহাল থাকে, তাহলে তাঁর প্রধান কূটনৈতিক পদক্ষেপ (দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মধ্যে সম্পর্ক উন্নত করা এবং জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শক্তিশালী জোট গঠন) দুর্বল হয়ে যেতে পারে বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

এতে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে, বিশেষত যখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে ফিরে আসা এই অঞ্চলের অনিশ্চয়তাকে আরও বাড়িয়ে দেবে। চীন, রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়া এই অস্থিতিশীলতা বা বিরোধের সুযোগ নিতে পারে।

রাজনৈতিক সংকটের এ চক্র ভাঙতে, ভালো শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে এবং নীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে দক্ষিণ কোরিয়াকে এমন একটি নতুন রাজনৈতিক কাঠামো তৈরি করতে হবে, যেখানে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য থাকবে এবং ক্ষমতার সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা হবে।

উদাহরণস্বরূপ, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের কাজ পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। আর দেশের অভ্যন্তরীণ শাসন প্রধানমন্ত্রীর হাতে দেওয়া যেতে পারে।

যদি সময়ের সঙ্গে একটি স্থিতিশীল দলীয় ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তাহলে দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণ আরও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব এবং সংসদীয় পদ্ধতির দিকে যেতে পারবে।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • ইউন ইয়ং-কোয়ান দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমানে আসান ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজের চেয়ারম্যান।