শেখ হাসিনার ব্যাপারে ভারতকে কড়া বার্তা দিতে হবে

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সোমবার সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রিছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্র। শেখ হাসিনার ক্ষমতা থেকে বিদায়ের পরে দুই দেশের সম্পর্ক একটা শীতল পর্যায়ে চলে গেছে এবং সেটির উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না; বরং দিন দিন আরও অবনতি হচ্ছে। বলা চলে, সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে একটা টানাপোড়েন চলছে। 

ইদানীং কিছু ঘটনা এই টানাপোড়েনকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে। ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা হয়। এটা ভিয়েনা চুক্তির পরিপন্থী। এ ছাড়া ভারতের গণমাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিদ্বেষমূলক লেখালেখি চলছে। ভারতীয় টেলিভিশনে বাংলাদেশ নিয়ে ভুল ও উসকানিমূলক তথ্য পরিবেশন করা হচ্ছে। এটা বিদ্যমান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

‘বর্ষা বিপ্লব’-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আমূল পরিবর্তন এসেছে। এই ঐতিহাসিক পরিবর্তনকে ভারত সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারে না। এ কারণে তারা বাংলাদেশের নতুন পরিস্থিতিকে এখন পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারেনি। 

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কটা যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখব ১৬ বছর ধরে ভারত বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও এর নেতা শেখ হাসিনাকে এককভাবে সমর্থন দিয়ে আসছিল। অনেকটা এই সমর্থনের কারণেই শেখ হাসিনা তাঁর ১৬ বছরের স্বৈরশাসন চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন। অথচ পর্যবেক্ষক পর্যায়ে আমরা বারবার বলে এসেছি, দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুই দেশের জনগণকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। 

ভারতের নীতিনির্ধারকদের ভুল নীতির কারণে দেশটি সম্পর্কে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে সার্বিক একটি বিরূপ ধারণা গড়ে উঠেছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের একে অপরের সঙ্গে বসবাস করতে হবে, এই ভৌগোলিক বাস্তবতা পরিবর্তন সম্ভব নয়। দুই দেশের জনগণ ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থে একটি কার্যকর ও মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক থাকাটা একেবারে বাঞ্ছনীয়। এর কোনো বিকল্প রাস্তা আমরা দেখি না। বিশেষ করে বর্তমান আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় নতুন নতুন যে চ্যালেঞ্জ আসছে, সেখানে প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক যাতে আরও বৃদ্ধি পায়, সেদিকে নজর দেওয়া উচিত।

এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দিক থেকেও পদক্ষেপ নেওয়ার আছে। ভারতে বাংলাদেশের দূতাবাস ও উপদূতাবাসের মাধ্যমে যে ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার ছিল, কার্যত সেই পদক্ষেপ দেখছি না। ভারতে প্রচারিত ভুল তথ্য মোকাবিলা করার উদ্যোগ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। বর্তমানে দিল্লিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে কোনো হাইকমিশনার নেই। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি দূতাবাসে যদি নেতৃত্বের অভাব থাকে, তার একটি প্রভাব পড়া তো স্বাভাবিক। 

কূটনীতির বাইরে গিয়েও দুই দেশের রাজনৈতিক পর্যায়ে নতুন করে যোগাযোগ ও আলাপ-আলোচনা হতে পারে। সেটি ঢাকা বা দিল্লিতে কিংবা তৃতীয় কোনো দেশেও হতে পারে।

গত কয়েক মাসে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ঢিলেঢালাভাবে কাজ করতে দেখছি। একটি বিপ্লবোত্তর বাস্তবতায় আমাদের পররাষ্ট্রনীতি যে রকম গতিশীল হওয়া দরকার ছিল, সেখানে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। তাদের কাজের ধারা এখনো গতানুগতিক, নতুন উদ্যোগ নেওয়ার চিহ্ন দেখা যায়নি। আমাদের উচিত হবে, পররাষ্ট্রনীতি ও পররাষ্ট্রবিষয়ক কার্যক্রম (বিশেষ করে যেসব রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ) আরও গতিশীল করা।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে আস্থার ঘাটতির মধ্যেই ঢাকায় দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ে একটি বৈঠক হয়ে গেল। আমরা আশা করব, এই উদ্যোগ যেন এগিয়ে নেওয়া হয়। দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগ অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। আমি এর আগে গণমাধ্যমে বলেছিলাম, ভারতের পক্ষ থেকে যদি কোনো বিশেষ দূতকে বাংলাদেশে পাঠানো হয়, তাহলে দুই দেশের সম্পর্কে যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে, সেটি উত্তরণে সহায়ক হবে। একইভাবে বাংলাদেশের বিশেষ দূত ভারতে গিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক গতিশীল করতে প্রচেষ্টা চালাতে পারেন।

সম্প্রতি আমরা দেখছি, ভারতীয় নেতারা নানা ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। এর কারণে দুই দেশের সম্পর্ক একটি তিক্ততার পর্যায়ে চলে যেতে বসেছে। এই পরিস্থিতিতে যেকোনো সময় যেকোনো ভুল পদক্ষেপ আসতে পারে। সে কারণেই আমাদের কূটনীতিটা আরও গতিশীল, উদ্ভাবনমূলক ও শক্ত হওয়া প্রয়োজন। আমাদের জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখে, আমাদের মর্যাদা বজায় রেখে কূটনৈতিক সম্পর্কটা বাড়ানো প্রয়োজন।

কূটনীতির বাইরে গিয়েও দুই দেশের রাজনৈতিক পর্যায়ে নতুন করে যোগাযোগ ও আলাপ-আলোচনা হতে পারে। সেটি ঢাকা বা দিল্লিতে কিংবা তৃতীয় কোনো দেশেও হতে পারে।

ভারতের পররাষ্ট্রসচিবকে আমাদের সমস্যাগুলো, উদ্বেগগুলো জানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এগুলোকে কতটুকু গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, সেটি নির্ভর করবে ভারতের ওপর। তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এ বৈঠক নিয়ে যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, সেটি খুব সাদামাটা। সেখানে বলা হয়েছে, বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারছি, সীমান্ত হত্যা, নদীর পানি, উসকানিমূলক বক্তব্য, ভুল ও অপতথ্য, ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনার বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড—এসব নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এর কোনোটিই সঠিকভাবে উল্লেখ করা হয়নি।

বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং রাজনৈতিক মহলে যেভাবে অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে, সেগুলোকে মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। রাস্তায় স্লোগান দিয়ে কিংবা বিবৃতি দিয়ে অপতথ্য মোকাবিলা করা যায় না। এর একটি বৈজ্ঞানিক উপায় রয়েছে। অথচ অপতথ্যকে মোকাবিলা করার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা সরকারের দিক থেকে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ আমরা দেখছি না। 

বর্ষা বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান নিয়ে নানা বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছেন। শেখ হাসিনা যদি ভারতে অবস্থান করে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে অপপ্রচার চালান, সেটি বন্ধ করার জন্য আমাদের শক্ত অবস্থান নিতে হবে। ভারতকে খুব স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে, শেখ হাসিনার এ ধরনের অপকর্ম আমাদের কাছে মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। শেখ হাসিনা ভারতে থেকে বাংলাদেশে তাঁর নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যেভাবে যোগাযোগ করছেন, সেটি আমাদের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য হুমকি। এটা বন্ধে ভারতকে অবশ্যই পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাংলাদেশ-ভারত পারস্পরিক সম্পর্ক ভালো থাকলে তাতে দু্ই দেশই লাভবান হতে পারে। আস্থার যে সংকট তৈরি হয়েছে, সেই আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুই দেশের জনগণকে প্রাধান্য দিতে হবে।

মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ