বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও আসিয়ান দেশগুলোর কূটনীতিকদের রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতি দেখাতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সর্বশেষ পদক্ষেপটি বেশ চমকপ্রদ। এসব দেশের কূটনীতিকদের ৯ মার্চ রাখাইন রাজ্যের মংডু ও সিতওয়েতে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁদের বলা হয়, মিয়ানমার সরকার দ্রুতই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে চায়।
অবশ্য তারা কোনো তারিখ দেয়নি, কিন্তু হঠাৎ করেই কক্সবাজারে একটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছে হাজারখানেকের কিছু বেশি রোহিঙ্গার নাগরিকত্ব যাচাইয়ের জন্য। পরে জানা গেল, এ উদ্যোগের পেছনে চীন সরকারেরও কিছু ভূমিকা আছে এবং ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদূত প্রকাশ্যে এ প্রক্রিয়ায় তাঁর সরকারের সমর্থনের কথা জানিয়েছেন।
স্মরণ করা দরকার, ২০১৭ সালের নভেম্বরে, রাখাইন থেকে রোহিঙ্গারা বিতাড়িত হওয়ার তিন মাসের মধ্যে, অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বেসামরিক সরকার তাদের ভাষায় বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে একটি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সই করেছিল।
তখনো চীন সেই চুক্তির জন্য মিয়ানমারকে উৎসাহিত করেছিল। এরপর জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামে যতবারই রোহিঙ্গা গণহত্যা এবং মিয়ানমার থেকে তাদের বিতাড়নের জন্য মিয়ানমারের সরকারের নিন্দা জানিয়ে এবং তাদের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ব্যবস্থা নিতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, ততবারই চীন তার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে, নয়তো ভোটদানে বিরত (সম্ভবত একবার) থেকেছে।
আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গাম্বিয়ার দায়ের করা গণহত্যার মামলার শুনানিতে আমি শুনেছি মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির উল্লেখ করে দাবি করা হয়েছিল যে আদালত মিয়ানমারের ওপর নির্দেশনা জারি করলে তা প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত করবে। আইসিজে সে যুক্তি গ্রহণ করেননি। তবে ভিন্নমত পোষণকারী বিচারক যুক্তিটি গ্রহণ করেছিলেন। ওই মামলায় গাম্বিয়ার পেশ করা বিশদ আরজির বিপরীতে আগামী ২৪ এপ্রিলের মধ্যে মিয়ানমারকে তার জবাব পেশ করতে হবে। কথিত পরীক্ষামূলক (পাইলট) প্রত্যাবাসন আদালতকে বিভ্রান্ত করার কৌশল নয় তো?
তাদের যুক্তি, নিষেধাজ্ঞা এবং কোনো জবাবদিহির ব্যবস্থার পরিবর্তে বিষয়টি দ্বিপক্ষীয় স্তরে ছেড়ে দেওয়া উচিত। ২০১৭ সালের চুক্তি অনুসারে, প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়ার প্রথম ধাপটি ২০১৮ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের নির্ধারিত সময়সীমা, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। তারপর ২০১৯ সালে আরও একবার চীন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে মিয়ানমারকে রাজি করানোর চেষ্টা চালালেও তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
সেই ব্যর্থ দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ছয় বছর পর, চীনের তৃতীয় মধ্যস্থতার উদ্যোগ। কিন্তু এর মধ্যে বাস্তবতা অনেক বদলেছে। মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী একটি নির্বাচনের ফলাফল নাকচ করে দিয়ে এবং বেসামরিক প্রশাসনকে অস্ত্রের মুখে হটিয়ে দেশটির ক্ষমতা দখল করেছে। দুই বছর আগে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে, সামরিক শাসন জারির পর তারা হাজার হাজার ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যা করেছে। নতুন করে বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর প্রায় ১৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
২০২০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) সদস্যরা জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি) নামে প্রবাসী সরকার গঠন করেছেন। অনেক পশ্চিমা সরকার এই এনইউজিকেই বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
রোহিঙ্গাদের দুর্দশা ছাপিয়ে মিয়ানমারে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অগ্রাধিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিবর্তনে মন্দের ভালো যেটুকু হয়েছে, তা হলো গণহত্যার অভিপ্রায়ে রোহিঙ্গাদের প্রতি বৈষম্য ও নিপীড়নের নীতি অনুসরণের জন্য এনএলডি তাদের দায়িত্ব ও ভুল স্বীকার করেছে এবং তাদের পূর্ণ নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাৎ কেন মিয়ানমারের জান্তা সরকার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে তাদের সদিচ্ছা দেখাতে এতটা উৎসুক হলো? অনেকের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্র সরকার গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনে জান্তার বিরুদ্ধে শক্তিশালী এবং সমন্বিত বৈশ্বিক পদক্ষেপের মাধ্যমে যে চাপ তৈরি করছে, তা মোকাবিলায় এমন কিছু করা, যাতে সে চাপ কিছুটা কমে। ১ ফেব্রুয়ারি জান্তার ক্ষমতা দখলের দ্বিতীয় বার্ষিকী উপলক্ষে, ওয়াশিংটন তার নিষেধাজ্ঞার তালিকা প্রসারিত করেছে এবং ছয় ব্যক্তি এবং তিনটি সত্তাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে, যা দেশটির আয় কমানো ও অস্ত্র সংগ্রহ কঠিন করে তুলবে।
গত বছরের ২২ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতনের নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ একটি প্রস্তাব গ্রহণে সক্ষম হয়। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের পর এটি ছিল মিয়ানমারের ওপর নিরাপত্তা পরিষদে প্রথম প্রস্তাব। পর্যবেক্ষকদের মতে, প্রস্তাবটিতে মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত মিয়ানমার জান্তার ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতার প্রতিফলন ঘটেছে।
কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা, নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব এবং ২৩ ডিসেম্বর, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বার্মা অ্যাক্ট স্বাক্ষর যে মোটামুটি একটা কূটনৈতিক সমন্বয়ের ফল, তা বেশ স্পষ্ট। বার্মা অ্যাক্টে সামরিক জান্তার বিরোধীদের প্রতি সমর্থন প্রকাশের সময়ে খোলাখুলিভাবে জাতীয় ঐক্য সরকারের (এনইউজি) উল্লেখ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এতে মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলো এবং জনগণের প্রতিরক্ষা বাহিনী বা এনইউজের গড়ে তোলা বাহিনীকে প্রাণঘাতী নয়, এমন অস্ত্র ও সরঞ্জাম সহায়তা দেওয়ার অনুমোদন রয়েছে।
সম্প্রতি ঢাকায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত অঞ্চলে ‘বার্মা অ্যাক্ট’-এর প্রভাবসম্পর্কিত এক আলোচনায়, মিয়ানমারের এনইউজির স্বাস্থ্য ও শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক জাও ওয়াই সোয়ে বার্মা আইন পাস করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তিনি অবশ্য একক কোনো পরাশক্তির ওপর নির্ভর না করে বর্তমান সংঘাত মোকাবিলায় বহুপক্ষীয় সহযোগিতার কথা বলেছেন।
মিয়ানমারের জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোকে সহায়তা দেওয়া হলে তা বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বলে এখন বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা অনেকেই উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ডেরেক শোলে তাঁর সাম্প্রতিক ঢাকা সফরে আশ্বাস দিয়েছেন যে সে রকম কিছু ঘটবে না। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে সাম্প্রতিক অস্থিরতা ও কিছু সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনা পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হওয়ার ইঙ্গিত মিলছে। যদিও এসব ঘটনার দায় নিয়ে নানামুখী, কখনো কখনো বিপরীতধর্মী কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।
এদিকে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাহায্যও কমছে আশঙ্কাজনক মাত্রায়। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, ডব্লিউএফপি, শরণার্থীদের জন্য খাদ্যসহায়তার বরাদ্দ মাথাপিছু ১৭ শতাংশ কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিছুদিন আগে ঢাকা ঘুরে যাওয়া ব্রিটিশ এমপি রুশনারা আলী হাউস অব কমন্সে তাঁর এক প্রশ্নে দাবি করেছেন যে ২০১৭ সালে ব্রিটেন রোহিঙ্গাদের জন্য যতটা অর্থ দিয়েছিল, গত বছরে তা কমিয়েছে ৮০ শতাংশ। কেন এতটা সাহায্য কমল এবং তা বাড়বে কি না, সে প্রশ্নের কোনো স্পষ্ট জবাব পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী দেননি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বাস্তুচ্যুতি এবং অন্যান্য দুর্যোগের কারণে সাহায্যের চাহিদা অন্যান্য জায়গায় যে হারে বেড়েছে, তাতে রোহিঙ্গাদের অবস্থায় শিগগিরই কোনো উন্নতির সম্ভাবনা নেই।
বোধগম্য কারণে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য উন্মুখ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, মিয়ানমারের বর্তমান উদ্যোগ কি আন্তরিক এবং সত্যিকার সমাধানের অংশ? নাকি বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে একধরনের ধাপ্পার কৌশল? বাংলাদেশ প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায় থাকা আট লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার তালিকা দিয়েছে অনেক আগেই। তাহলে হাজারখানেক শরণার্থীকে নিয়ে পাইলট করা প্রয়োজন হবে কেন?
তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের নাম-ঠিকানা যাচাই যেখানে মিয়ানমারে হওয়ার কথা, সেখানে কক্সবাজারে এসে তাদের সাক্ষাৎকারের যৌক্তিকতা কী? মিয়ানমারের ভেতরের যে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত নাগরিক হিসেবে বিভিন্ন শিবিরে অন্তরীণ আছে, তাদের পুনর্বাসন করে কেন বাকিদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা হচ্ছে না? আর এ প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘ সংস্থা ইউএনএইচসিআরকে কেন সম্পৃক্ত করা হচ্ছে না? তারা তো বলছে প্রত্যাবাসনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়নি। রোহিঙ্গা অধিকার গোষ্ঠীগুলোও বলছে, নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ছাড়া প্রত্যাবাসন হলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি তৈরি হবে।
আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) গাম্বিয়ার দায়ের করা গণহত্যার মামলার শুনানিতে আমি শুনেছি মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির উল্লেখ করে দাবি করা হয়েছিল যে আদালত মিয়ানমারের ওপর নির্দেশনা জারি করলে তা প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত করবে। আইসিজে সে যুক্তি গ্রহণ করেননি। তবে ভিন্নমত পোষণকারী বিচারক যুক্তিটি গ্রহণ করেছিলেন। ওই মামলায় গাম্বিয়ার পেশ করা বিশদ আরজির বিপরীতে আগামী ২৪ এপ্রিলের মধ্যে মিয়ানমারকে তার জবাব পেশ করতে হবে। কথিত পরীক্ষামূলক (পাইলট) প্রত্যাবাসন আদালতকে বিভ্রান্ত করার কৌশল নয় তো?
কামাল আহমেদ সাংবাদিক