বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নানামুখী জল্পনার মধ্যে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী দৈনিক দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ২ সেপ্টেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যাতে ক্ষমতাসীন দলের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সদস্যদের কী ধরনের প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে, তার একটি বিশদ বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের একাধিক পত্রিকা অনলাইনে নিউইয়র্ক টাইমস-এর ওই প্রতিবেদনের অনুবাদ প্রকাশ করেছে।
ইত্তেফাক-এর অনলাইনে শিরোনামটির বাংলা করা হয়েছে ‘নীরবে ধ্বংস করা হচ্ছে একটি গণতন্ত্র’। মূল শিরোনামের একটি অংশ অনুবাদে বাদ পড়েছে, যাতে ছিল অযুতসংখ্যক (মিলিয়নস) বিচারের মুখোমুখি। বিএনপিকে উদ্ধৃত করে তারা বলেছে, দলটির ৫০ লাখ সদস্যের আনুমানিক অর্ধেকই মামলার আসামি। কেউ কেউ ডজনখানেক, আবার কেউ কেউ এমনকি কয়েক শ মামলার আসামি। তাঁদের দিন কাটে আদালতের বারান্দা অথবা কাঠগড়ায়। প্রতিবেদনে বেশ কয়েকজনের অভিজ্ঞতার বিবরণও রয়েছে।
এর ঠিক চার দিন পর ঢাকার পত্রিকা সমকাল ‘পুরোনো মামলা চাঙা, যোগ হচ্ছে নতুনও’ শিরোনামের প্রতিবেদনে লিখেছে, বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১ লাখ ৪১ হাজার এবং এগুলোর আসামির সংখ্যা ৪৯ লাখ ৪০ হাজার ৪৯২। সংখ্যাটা নিউইয়র্ক টাইমস-এর উল্লেখ করা ২৫ লাখের দ্বিগুণ। তারা লিখেছে, গত মাসেও নতুন মামলা হয়েছে ৩৩১টি, যাতে আসামি সংখ্যা ৪ হাজার। অনেক ক্ষেত্রেই তারা জেলাওয়ারি পরিসংখ্যান দিয়েছে, যার সূত্র বিএনপি।
এসব সংখ্যা নিয়ে ক্ষমতাসীন দল বা সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ব্যাখ্যা দিয়েছে বলে চোখে পড়েনি। দলের সমর্থকেরা বিচ্ছিন্নভাবে এসব পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন তুলেছেন। যদিও অতি উৎসাহী এবং দলীয় আনুগত্যের কারণে সুবিধাভোগী পুলিশ কর্তাদের অনেকে শত শত এবং ক্ষেত্রবিশেষে হাজার হাজার অজ্ঞাতনামা আসামি করায় এ রকম অস্বাভাবিক সংখ্যাস্ফীতি একেবারে অসম্ভব নয়।
বিএনপির পক্ষ থেকে অবশ্য এখন কেউ যে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে এসব তথ্যের প্রমাণ দেবে, সেই পথও বন্ধ। বিএনপির গ্রেপ্তার হওয়া সদস্যদের নামের তালিকা করতেন যিনি, সেই নাসির জামশেদকে পুলিশ গত ১৯ আগস্ট মধ্যরাতে দলীয় কার্যালয় থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে যাত্রাবাড়ীর এক মামলায় আসামি করেছে বলে খবর দিয়েছে নিউ এজ পত্রিকা।
দুই পত্রিকার আসামি সংখ্যায় ফারাক যত বড়ই হোক না কেন, ন্যূনতম সংখ্যাটিও কম উদ্বেগজনক নয়। আর নির্বাচন সামনে রেখে মামলাভুক্ত আসামিদের বিচার ত্বরান্বিত করতে পুলিশ যে নির্দেশিত হয়েছে এবং আদেশ প্রতিপালনে তৎপর, সেই খবর সম্প্রতি একাধিক কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। পুলিশ, সরকারি কৌঁসুলি এবং আদালতের কার্যক্রমে পরিষ্কার ইঙ্গিত মেলে যে নির্বাচনের আগেই অনেক মামলার শুনানি শেষ হবে এবং আসামিদের আশ্রয় হবে কারাগার।
নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদনের উল্লেখযোগ্য অংশগুলোর মধ্যে আছে ১৪ বছরের শাসনকালে পুলিশ, আদালতসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অনুগতদের দ্বারা পরিপূর্ণ করে সেগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কথা। এরপর পত্রিকাটি বলেছে, ভিন্নমত দমনের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা হয়েছে। রাজনৈতিক নেতা ও বিশ্লেষকদের উদ্ধৃত করে পত্রিকাটি লিখেছে যে দেশটিকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করারচেষ্টা চলছে।
একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাইলে তার জন্য রাজনৈতিক সমঝোতা হতে হবে। সেই সমঝোতা নিজেদের উদ্যোগেই হোক অথবা অন্য কারও মধ্যস্থতায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি যে কোনো সহজ কাজ নয়, তা-ও অনস্বীকার্য। আমাদের নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের এত মাথাব্যথা কেন—এমন প্রশ্ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও মন্ত্রিসভার অনেকেই করে থাকেন। এর কারণ হচ্ছে, তাঁরা পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে চান না।
মানবাধিকার, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশের নোবেলজয়ী অধ্যাপক ইউনূসের পক্ষে দাঁড়ানো নোবেলজয়ী ও আন্তর্জাতিক পরিসরে নিজ নিজ ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষর রাখা ১৮১ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি। তাঁরাও তাঁদের বিবৃতিতে আইনের শাসন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।
গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্কও ভিন্নমতাবলম্বীদের বিচারিক হয়রানির কথা বলেছেন। তাঁর কথায়, ‘নাগরিক সমাজের নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার রক্ষাকারী এবং ভিন্নমতের কণ্ঠস্বরদের আইনি হয়রানি বাংলাদেশের নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারচর্চার জন্য উদ্বেগজনক লক্ষণ।’
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানির কোনো উদ্দেশ্য সরকারের নেই, বরং শুধু অপরাধ দমনের প্রয়োজনেই এসব মামলা—সরকারের এমন যুক্তি যে ইতিমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে, এসব বিবৃতি ও প্রতিবেদনে তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। এর কারণ প্রধানত দুটি—মামলা ও আসামির বিস্ময়কর সংখ্যা এবং একই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলার আধিক্য। এগুলো বিচারিক হয়রানির লক্ষণ হিসেবেই গণ্য হচ্ছে। আইনি বাধা তৈরির কারণে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সম্ভাবনাময় প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে বারিত করার সম্ভাব্য কৌশল এবার আদৌ কাজে আসবে কি না, সেটাই সম্ভবত একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে।
রাজনীতিতে বিএনপির জায়গায় জাতীয় পার্টিকে বিকল্প বিরোধী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় ক্ষমতাসীন দল এবং আমাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ঐকান্তিক আগ্রহ ও চেষ্টায় যে কোনো ঘাটতি ছিল না, তার প্রমাণ গত এক দশকে বহুবার দেখা গেছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে নানা রকম আনুকূল্যের আকর্ষণে তাদের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য বজায় রাখার যে রেকর্ড জাতীয় পার্টি গড়েছে, তাতে দলটির অস্তিত্বই এখন হুমকির মুখে।
এখনো দলটির নেতা কার আমন্ত্রণে ভারত সফর করলেন, কার সঙ্গে কথা বললেন, কী আলোচনা হলো, তা প্রকাশ করার মতো স্বকীয়তা ও স্বাধীনতার অধিকারী নন। গত পাঁচ বছরের বিভিন্ন উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোর ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, ভোট প্রাপ্তির দিক থেকে তারা এখন দেশের তৃতীয় প্রধান দলের অবস্থানেও নেই। রাজনৈতিক সংকট কোন দিকে গড়ায়, সে পরিস্থিতি বিবেচনা করে তাঁরা দলের অবস্থান ঠিক করবেন বলে তাঁদের যে সিদ্ধান্ত, একে রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব ও সুবিধাবাদিতা ছাড়া আর কিছু বলার অবকাশ কই?
বাস্তবতা হচ্ছে, একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চাইলে তার জন্য রাজনৈতিক সমঝোতা হতে হবে। সেই সমঝোতা নিজেদের উদ্যোগেই হোক অথবা অন্য কারও মধ্যস্থতায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি যে কোনো সহজ কাজ নয়, তা-ও অনস্বীকার্য। আমাদের নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের এত মাথাব্যথা কেন—এমন প্রশ্ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও মন্ত্রিসভার অনেকেই করে থাকেন। এর কারণ হচ্ছে, তাঁরা পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে চান না।
১৯৯৬ সালে তাঁরা যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিলেন, তখনো বিদেশিরা মধ্যস্থতার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। তখনো কূটনীতিকদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন ঢাকার তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ডেভিড মেরিল এবং ওয়াশিংটনে সে কথা জানিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নিকোলাস বার্নস। তখন খালেদা জিয়া সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলে ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচন করেছিলেন।
সেই নির্বাচনের পরও পর্দার অন্তরালে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে আলোচনা হয় এবং তাতেও কূটনীতিকেরা ভূমিকা নেন। তখন ঢাকায় আসেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী কংগ্রেস সদস্য বিল রিচার্ডসন, যিনি পরে নিউ মেক্সিকো রাজ্যের গভর্নর হয়েছিলেন। তিনি দুই নেত্রীর সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন। তিনি ঢাকা ছাড়ার পরও পশ্চিমা কূটনীতিকেরা দূতিয়ালি অব্যাহত রাখেন এবং শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়ে আইন করে নতুন নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেন।
বিল রিচার্ডসন অবশ্য দূতিয়ালি করে বাংলাদেশে মাদক পাচারের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত আমেরিকান তরুণী এলিয়েদা ম্যককর্ডের দণ্ড মওকুফ ও মুক্তি আদায় করে নিয়েছিলেন। পরে শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদের সময় ১৯৯৮ সালে বিল রিচার্ডসন যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানিমন্ত্রী হয়েছিলেন।
১ সেপ্টেম্বর বিল রিচার্ডসনের মৃত্যুর পর তাঁর বাংলাদেশের সফরের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সহিংস আন্দোলন এবং তা থেকে উত্তরণের ঘটনাবলির কথা সামনে চলে আসে। সেই একই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যু নিয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক বিরোধ নিষ্পত্তিতে কেন তাহলে রাজনীতিকেরা অতীত থেকে শিক্ষা নেবেন না?
● কামাল আহমেদ সাংবাদিক