দুঃখ, সংগ্রামের দিন অবসানে একদিন সুখের দেখা মিলবে—এটি মানুষের চিরন্তনী এক আকাঙ্ক্ষা। ঘুরেফিরে তাই আমাদের রূপকথাগুলোর শেষটা একই রকম...তারপর তারা সুখে-শান্তিতে দিন কাটাতে লাগলেন। কিন্তু নৈরাজ্যই যেখানে শাসন, বিশৃঙ্খলাই যেখানে আইন (নিশ্চিতভাবেই সড়কের কথা বলছি) সে রকম এক বাস্তবতায় কারও জীবন কি কখনো রূপকথার গল্পের মতো হতে পারে? বরং দুঃখ-যন্ত্রণার দিন যেইমাত্র অবসান হতে চলেছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই যেন গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো অমোঘ নিয়তি চূড়ান্ত আঘাত হেনে বসে।
জাহাঙ্গীর আলমের জীবনের গল্পটাই ধরা যাক। শেরপুরের নালিতাবাড়ীর পিপুলেশ্বর গ্রামে তাঁর বাড়ি। নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন এক জেলে পরিবারে তাঁর জন্ম। কিন্তু দারিদ্র্য তাঁর মেধাকে পরাজিত করতে পারেনি। এসএসসি ও এইচএসসি দুই পরীক্ষাতেই জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার গণ্ডিও সফলভাবে পেরিয়ে গিয়েছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের মতো প্রথম সারির বিষয়ে পড়েছিলেন। সেখান থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছিলেন। এরপর বিসিএস কিংবা অন্য কোনো সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
এটুকু বললেই জাহাঙ্গীরের জীবনের প্রতিদিনকার লড়াইটার প্রতি সঠিক সম্মান দেখানো যাবে না। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা বাবার ছিল না ছেলেকে পড়ানোর সংগতি। তাই সেই ছেলেবেলা থেকেই নিজের পড়ার খরচ নিজেকে জোগাড় করতে হতো। অন্যের জমিতে মজুর খেটে স্কুলে পড়ার খরচ জোটাতেন তিনি। এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার পর প্রথম আলো ট্রাস্টের বৃত্তি পেয়েছিলেন, যা তাঁর জীবনের লড়াইটা সামনে এগিয়ে নেওয়ার খানিকটা রসদ দিয়েছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে চাকরির প্রস্তুতিকালে টিউশনি করেই নিজের খরচ চালাতে হয়েছে, ছোট ভাইয়ের পড়ার খরচ জোগাতেন। গেল বছর বাবা মারা যাওয়ার পর দায়িত্বটা আরও বেড়ে যায়। পুরো পরিবারের খরচই তাঁকে জোগাড় করতে হতো।
নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে এমন উদাসীন থাকার নজির বিশ্বে আর কোথাও কি আছে? এই উদাসীনতার কারণ কী? নিন্দুকেরা কিন্তু বলেন, কর্তব্যক্তিরা দেশের বাইরে সেকেন্ড হোম করছেন, তাঁদের সন্তানদের সেখানে পড়াচ্ছেন। একের পর এক ব্য়য়বহুল সড়ক অবকাঠামো নির্মাণে রেকর্ড গড়ছে বাংলাদেশ, কিন্তু সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিতে কোনো পদক্ষেপই দেখা যায় না। অথচ ২০১৮ সালে এ দেশের কিশোরেরা সড়কে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় তার তাক লাগানো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল।
জাহাঙ্গীর স্বপ্ন দেখতেন, দুঃসহ সংগ্রামের দিন একদিন অবসান হবে। সরকারি চাকরি পাবেন। মা, ভাই—পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভালো থাকবেন। কিন্তু ঘর থেকে পথে বের হলে যে দেশে হাতের মুঠোতে জীবন বাজি রেখে বের হতে হয়, সে দেশে দুঃখ-শোক-দীর্ঘশ্বাস তো শেষ হওয়ার নয়। মাত্র ২৮ বছরে এসে স্তব্ধ হয়ে গেছে জাহাঙ্গীরের জীবনসংগ্রাম; থেমে গেছে তাঁর স্বপ্ন, আর তাঁকে ঘিরে পরিবার যে আশায় বুক বেঁধেছিল, তা-ও নিমেষেই নিঃশেষ হয়ে গেছে। জাহাঙ্গীরের বৃদ্ধ মা জহুরা বেগমের আর্তনাদটা কি আমরা শুনতে পাচ্ছি? শুনলেও বা কতটা দাগ কাটবে হৃদয়ে? ‘আমার বাবা চাকরি পাইয়া আমগোর সংসারে উন্নতি করব, সব সময় এই কথা বলত। কিন্তু সব স্বপ্ন নষ্ট হইয়া গেল।... অহন আমগোরে কে দেখব?’
সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, জাহাঙ্গীর মারা গেছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। আর দশটা দুর্ঘটনা যেমন, তেমনই এক দুর্ঘটনায়। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চড়ে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে সেটি উল্টে যায়। গুরুতর আহত জাহাঙ্গীরকে উদ্ধার করে শেরপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়।
আমরা যাঁরা সংবাদকর্মী, তাঁদের দুর্ঘটনার এ রকম সব খবর প্রতিনিয়ত লিখে যেতে হয়। ঘটনাগুলো শুধু স্থান, কাল, সংখ্যা বদলে দিলেই হয়। পাঠক যাঁরা পড়েন, দর্শক যাঁরা দেখেন কিংবা শ্রোতা যাঁরা শোনেন, তাঁদের কাছেও নিশ্চয়ই ব্যাপারটা একই রকম। প্রোগ্রাম ঠিক করে দেওয়া যন্ত্রের মতোই দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যাগুলো আমরা পড়ি, দেখি কিংবা শুনি। শুধু কাছের কারও মৃত্যু হলে কিংবা জাহাঙ্গীরের জীবনের মতো মানবিক কোনো গল্প হলেই হয়তো তা আমাদের হৃদয়কে কিছুটা নাড়া দেয়। কিন্তু সড়কে প্রতিটি মৃত্যুর পর পরিবারগুলোতে যে সীমাহীন ট্র্যাজেডি নেমে আসে, তার আঁচ আমরা কেউই বুঝতে পারি না। সড়কে মৃত্যুর মিছিলকে কেন আমরা এখনো পারিবারিক বিপর্যয় বলে স্বীকৃতি দিইনি, সেটা এক বড় বিস্ময়।
কাজের জন্য, পড়াশোনার জন্য, চিকিৎসার জন্য কিংবা নিছক ঘুরতে বেরিয়ে সড়কে যে মানুষগুলো দুর্ঘটনার শিকার হন, লাশ হয়ে যাওয়ার পরই সেই মানুষগুলোই একেকটা পরিসংখ্যান হয়ে যান। যাত্রীকল্যাণ সমিতি, রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের মতো সংস্থাগুলো নিয়মিত সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের পরিসংখ্যান তুলে ধরে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ওপর ভিত্তি করে তারা এ তথ্য প্রকাশ করে। সড়ক দুর্ঘটনার ধরন ও অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে কিছু সুপারিশও তুলে ধরে। নীতিনির্ধারকেরা যাতে শিক্ষা নিয়ে দুর্ঘটনা বন্ধে ব্যবস্থা নেন, সে উদ্দেশ্য থেকেই তাঁরা তা করেন। কিন্তু কে এসব তথ্য, এসব সুপারিশকে আমলে নেবে?
মন্ত্রণালয় আছে, নানা অধিদপ্তর আছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আছে; জনগণের করের টাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী-সচিব-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা হয়। অথচ দিনের পর দিন সড়কের কারণে পরিবারগুলোতে একই ট্র্যাজেডি ঘটে চলেছে, তাতে কারও কোনো হেলদোল নেই। একটা বিষয় হলো, সত্যিকারের দুর্ঘটনায় যদি এতো হতাহতের ঘটনা ঘটত, তাহলে পরিবারগুলোকে শোক ও সমবেদনা জানিয়ে কিছু সান্ত্বনা হয়তো পাওয়া যেত। কিন্তু নৈরাজ্য, অব্যবস্থাপনার কারণে সড়কে যখন হরেদরে মানুষ যখন মরছে, তখন সেটিকে নিছক দুর্ঘটনা বলা অপরাধই বটে। কেউ কি বলতে পারবেন সড়কে সুশাসন বলে কিছু অবশিষ্ট আছে।
সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে দিনে দিনে সড়ক শিক্ষার্থীখেকো হয়ে উঠছে। চলতি বছর জানুয়ারিতেই সড়ক মারা গেছে ৪৬ জন শিক্ষার্থী। গত বছর সড়কে দুর্ঘটনায় মারা যান ৮৮৫ শিক্ষার্থী। এই সংখ্যা সড়ক দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ১৬ শতাংশ। প্রতিদিন গড়ে তিনজন করে শিক্ষার্থীর মৃত্যু হচ্ছে সড়কে। সড়কে শিক্ষার্থীর মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে, অথচ আমরা সেটি পুরোপুরি উপেক্ষা করে যাচ্ছি। জীবনে প্রবেশ করার আগেই থেমে যাচ্ছে তাদের সম্ভাবনাময় জীবন। এ মৃত্যুতে শুধু একেকটা পরিবারে বিপর্যয় নেমে আসছে না, দেশের অর্থনীতিতেও এর বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে এমন উদাসীন থাকার নজির বিশ্বে আর কোথাও কি আছে? এই উদাসীনতার কারণ কী? নিন্দুকেরা কিন্তু বলেন, কর্তব্যক্তিরা দেশের বাইরে সেকেন্ড হোম করছেন, তাঁদের সন্তানদের সেখানে পড়াচ্ছেন। একের পর এক ব৵য়বহুল সড়ক অবকাঠামো নির্মাণে রেকর্ড গড়ছে বাংলাদেশ, কিন্তু সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিতে কোনো পদক্ষেপই দেখা যায় না। অথচ ২০১৮ সালে এ দেশের কিশোরেরা সড়কে শৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় তার তাক লাগানো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল।
মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী
[email protected]