বিজয়ের মাস
বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ থেকে শুরু করে বিজয়–পরবর্তী ঘটনাবলি উঠে এসেছে ভারতীয় কূটনীতিক চন্দ্রশেখর দাশগুপ্তের লেখা ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার বইয়ে। প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য বইটির একটি অংশ সংক্ষেপিত অনুবাদে ছাপা হচ্ছে। আজ ছাপা হলো প্রথম পর্ব।
ঢাকায় পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের আইকনিক আলোকচিত্রটি বলা যায় অনুষ্ঠানের ঐতিহাসিক জাঁকজমকপূর্ণ আবহকে যথার্থভাবে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার উপস্থিতিতে আত্মসমর্পণপত্রে স্বাক্ষর করছেন। সাক্ষী হিসেবে সেখানে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সিনিয়র অফিসাররা উপস্থিত আছেন। ভিন্ন একটি অ্যাঙ্গেল থেকে তোলা অপর এক ছবিতে গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারকে (এ কে খন্দকার) ভাইস অ্যাডমিরাল কৃষ্ণনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় (যৌক্তিক কারণে কর্নেল ওসমানী উপস্থিত থাকতে না পারায় তাঁর হয়ে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন ক্যাপ্টেন খন্দকার)। একটি ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স পাকিস্তানি শাসন থেকে নিজ দেশের মুক্তি উদ্যাপনের দৃশ্য দেখতে জড়ো হওয়া উচ্ছ্বসিত বাঙালিদের একটি অংশকে অন্তত চিত্রায়িত করতে পারত। আইকনিক ফটোগ্রাফটি মূলত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর বিজয়কে চিত্রিত করে।
পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের পাঁচ দিন পর, অর্থাৎ ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ শেষ পর্যন্ত পরিবর্তিত বাস্তবতাকে মেনে নেয়। সেখানে গৃহীত ৩০৭ (১৯৭১) নম্বর প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়, উপমহাদেশে যুদ্ধবিরতি কার্যকর রয়েছে। প্রস্তাবে উভয় পক্ষকে নিজ নিজ অঞ্চলে তাদের সেনা প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি কার্যকর রাখতে বলা হয় এবং ভারত ও পাকিস্তানে জাতিসংঘের সামরিক পর্যবেক্ষক গ্রুপের তত্ত্বাবধানে কার্যকর থাকা জম্মু ও কাশ্মীরের যুদ্ধবিরতি পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণভাবে সম্মান করতে বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে মুক্তিযুদ্ধের অপরিবর্তনীয় ফলকে পরোক্ষভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়া তখন কেবল সময়ের ব্যাপার ছিল। ৬ ডিসেম্বর ভুটান সদ্যোজাত রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে ভারতের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে।
১৯৭২ সালের জানুয়ারির গোড়ায় জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (তৎকালীন পূর্ব জার্মানি) বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় এবং এরপর সোভিয়েত ব্লকের অন্য সদস্যরা তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং ফেডারেল রিপাবলিক অব জার্মানিসহ (তৎকালীন পশ্চিম জার্মানি) প্রধান পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলো এবং ৮ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। এভাবে ১৯৭২ সালের এপ্রিলের প্রথম দিক নাগাদ চীন ছাড়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সব স্থায়ী সদস্যসহ বেশির ভাগ প্রধান শক্তি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।
দেশ পাকিস্তানি দখলদারি থেকে মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাখ লাখ বাঙালি শরণার্থী ভারত থেকে স্বদেশে ফিরে আসে। বাংলাদেশ স্বাধীনতার ছয় সপ্তাহের মধ্যে প্রায় ৭০ লাখ শরণার্থীকে প্রত্যাবাসন করা হয়। ১৯৭২ সালের ২৫ মার্চের মধ্যে প্রায় এক কোটি উদ্বাস্তুর মধ্যে মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া সবাই স্বদেশে ফেরত এসেছিল।
যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বেসামরিক প্রশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা মুজিবনগর সরকার আগেই (নভেম্বরে) তৈরি করে রেখেছিল। স্বাধীনতার পর এসব পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করা হয়। পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের পরের দিনই রেডিওতে সিনিয়র জেলা কর্মকর্তাদের (জেলা প্রশাসক এবং এসপি) নিয়োগের ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৮ ডিসেম্বর মুখ্য সচিব রুহুল কুদ্দুসের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি দল প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ নিতে ঢাকায় আসে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা ২২ ডিসেম্বর ঢাকায় আসেন। এভাবে স্বাধীনতার এক সপ্তাহের মধ্যেই বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাজ করতে শুরু করে।
এরই মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে পাকিস্তান। ১৯৭২ সালের জানুয়ারির শুরুতে জুলফিকার আলী ভুট্টো (যিনি চরম অপমানের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ও সেনাশাসকের পদ থেকে বিদায় নেওয়া ইয়াহিয়া খানের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন) বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মুজিবকে লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তিনি ১০ জানুয়ারি নয়াদিল্লি হয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। শেখ মুজিব দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে নেমে ভারতের জনগণের উদ্দেশে ঘোষণা করেন, ‘আমি বাংলাদেশে যাওয়ার পথে আপনাদের মহান দেশের ঐতিহাসিক রাজধানীতে বিরতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কারণ আমার জনগণের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু ভারতের জনগণ এবং আপনাদের মহান নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন সরকারকে ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছি।’
উষ্ণ অভ্যর্থনার মধ্য দিয়ে মুজিব ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। তাঁর বিজয়ী প্রত্যাবর্তন নতুন সরকারকে এমন কর্তৃত্ব দিয়েছিল, যা আগে ছিল না। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে অস্ত্র ফেরত নেওয়া এবং তাদের শক্তিকে জাতি গঠনের কাজে লাগানোর কাজটি নতুন সরকারের প্রধান কাজ হয়ে ওঠে। যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। ১৭ জানুয়ারি ভারত বাংলাদেশকে চিনি, লবণ, শিশুখাদ্যের মতো অতি জরুরি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও ওষুধ; গ্রামীণ শিল্পের জন্য তৈলবীজ ও তুলার সুতা; সিমেন্ট, ইস্পাত ও ইস্পাত পণ্য; বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের সরঞ্জাম এবং পরিবহন যানবাহনসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্য ও সরঞ্জাম সরবরাহ করতে সম্মত হয়। ভারতের সহায়তায় চট্টগ্রাম বন্দরকে সচল করা হয়। বাংলাদেশে রেলপথ পুনর্নির্মাণেও ভারত সহায়তা করে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বৈদেশিক সাহায্যের বোঝা প্রধানত ভারতের কাঁধে ছিল। প্রধান ঐতিহ্যবাহী দাতাদেশগুলো বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার পরই কেবল এই অবস্থার পরিবর্তন হয়।
দেশ পাকিস্তানি দখলদারি থেকে মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাখ লাখ বাঙালি শরণার্থী ভারত থেকে স্বদেশে ফিরে আসে। বাংলাদেশ স্বাধীনতার ছয় সপ্তাহের মধ্যে প্রায় ৭০ লাখ শরণার্থীকে প্রত্যাবাসন করা হয়। ১৯৭২ সালের ২৫ মার্চের মধ্যে প্রায় এক কোটি উদ্বাস্তুর মধ্যে মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া সবাই স্বদেশে ফেরত এসেছিল। ‘ভারতের সরকার ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে, বিশেষ করে প্রতিবেশী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয় এবং আসাম যেভাবে বাস্তুচ্যুত লাখ লাখ বাংলাদেশিকে আশ্রয় দিয়েছে, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে’ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের এক মাসের কম সময়ের মধ্যে মুজিব কলকাতা সফর করেন।
এই সফর মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে শিল্প, কৃষি, যোগাযোগ, পানি ও বিদ্যুৎ সম্পদের উন্নয়ন ও ব্যবহার, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার সম্ভাবনা নিয়ে বিশদ আলোচনার সুযোগ করে দেয়। এই সময় বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনা ১৯৭২ সালের ২৫ মার্চের মধ্যে সরিয়ে নেওয়ার কাজ সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই সময় মুজিব ও ইন্দিরার আলোচনায় সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা ২৫ মার্চ ঠিক হলেও পরবর্তী সময়ে যখন শ্রীমতী গান্ধীর ঢাকা সফরের তারিখ ১৭ মার্চ নির্ধারিত হয়, তখন ইন্দিরা তাঁর ঢাকা সফরের আগেই সেনা প্রত্যাহার শেষ করার অনুরোধ করেন। সে অনুযায়ী, প্রত্যাহারের তারিখ ১৫ মার্চে এগিয়ে আনার বিষয়ে উভয় পক্ষ সম্মত হয়। ১২ মার্চ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা স্টেডিয়ামে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বর্ণাঢ্য বিদায়ী কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করেন।
● আগামীকাল: সিমলার পথে
● চন্দ্রশেখর দাশগুপ্ত ভারতের সাবেক কূটনীতিক