ইউক্রেনে দুর্নীতি নিয়ে সর্বশেষ যে তথ্য ফাঁস হলো, সেটা একটি জটিল গল্প। এই কেলেঙ্কারিটা ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে ঘিরে। ১ লাখ মর্টার সেলের (যার মূল্য ৪০ মিলিয়ন ডলার) কিনতে অর্থ পরিশোধ করা হলেও মর্টার সেলগুলো সরবরাহ করা হয়নি। এই কেলেঙ্কারির গল্প যখন সামনে এল, তখন দুর্নীতি নিয়ে গবেষণা করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণা সূচকে ইউক্রেন এযাবৎকালের সবচেয়ে সেরা স্কোর করেছে।
টিআইয়ের সূচকে ইউক্রেনের এই অগ্রগতি থেকে বোঝা যায়, ঘনিষ্ঠজনসহ দুর্নীতি গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য ভলোদিমির জেলেনস্কি যে প্রচেষ্টা নিয়েছেন, তার কিছুটা অগ্রগতি ঘটেছে।
পক্ষান্তরে মর্টার সেল কেলেঙ্কারি পরিষ্কার ইঙ্গিত দেয়, ইউক্রেনের জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের ও অস্ত্র সরবরাহকারীদের মধ্যে দুর্নীতি কতটা বিস্তার লাভ করেছে ও কতটা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই দুর্নীতি এমন এক সময়ে জেঁকে বসেছে, যখন ইউক্রেন বড় ধরনের অস্তিত্বের সংকটে রয়েছে।
এখন পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে, তা হলো, দুর্নীতি ইউক্রেনের টিকে থাকা না-থাকার মূল প্রশ্নটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দুর্নীতিই ইউক্রেনের একমাত্র সমস্যা নয় কিংবা এটাই দেশটির সবচেয়ে বড় সমস্যা নয়। কিন্তু দুর্নীতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এই ধারণার কারণে ইউক্রেনের ভেতরের রাজনীতি যেমন জটিল হয়ে উঠছে আবার পশ্চিমা সমর্থনের ক্ষেত্রেও বড় বাধা তৈরি হচ্ছে।
দুর্নীতি ইউক্রেনের দীর্ঘদিনের সমস্যা। কিন্তু গত ১০ বছরে ইউক্রেন নিয়ে টিআইয়ের যে ধারণাসূচক, তাতে দেখা যায়, দেশটি দুর্নীতি থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে ধারাবাহিক উন্নতি করে চলেছে। রাশিয়া ও আজারবাইজনকে বাদ দিলে ইউরোপের আর কোনো দেশে ইউক্রেনের মতো এতটা দুর্নীতি নেই।
দুর্নীতির এই মহামারির মধ্যেও দুই বছরের যুদ্ধে ইউক্রেন এখনো টিকে আছে। তারা রাশিয়ার আগ্রাসনের মুখে অবিস্মরণীয় প্রতিরোধক্ষমতা দেখিয়ে চলেছে। কিন্তু কর্তাব্যক্তিদের এসব কেলেঙ্কারিসহ অন্য যেসব দুর্নীতি তাতে বলা যায়, ইউক্রেনকে এখনো প্রতিনিয়ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। দুর্নীতি ইউক্রেনকে আরেকটি অস্তিত্বের হুমকিতে ফেলে দিয়েছে। আর সেটা ঘটছে সে সময়েই, যখন দেশটির টিকে থাকা না-থাকা পশ্চিমা অস্ত্র ও অর্থের ওপর নির্ভরশীল।
হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, জার্মানির প্রভাবশালী ডানপন্থী বিরোধী দল এএফডি ইউক্রেনকে আর অর্থ ও অস্ত্রসহায়তা না দেওয়ার জন্য দুর্নীতির অকাট্য যুক্তি ব্যবহার করছে। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকান আইনপ্রণেতারা বলেছেন, তদারকির ঘাটতির মানে হচ্ছে, ইউক্রেনকে দেওয়া আমেরিকার সহায়তা দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের পকেটে চলে যাওয়া।
ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ও যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে যখন ইউক্রেনকে সহযোগিতা দেওয়া না-দেওয়া নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক বাড়ছেই এবং দেশগুলোর নির্বাচনী প্রচারণায় সেটি অন্যতম বিষয় হয়ে উঠেছে, তখন তহবিল তছরুপের এসব অকাট্য প্রমাণ ইউক্রেনকে অব্যাহতভাবে সহযোগিতা পাওয়ার ব্যাপারে কঠিন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে।
জেলেনস্কির নড়বড়ে অবস্থান
পশ্চিমা সমর্থন অব্যাহত থাকা নিয়ে এই বিপজ্জনক পরিস্থিতি যখন সৃষ্টি হয়েছে, তখন দেশের ভেতরে জেলেনস্কির অবস্থানও নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনে জেলেনস্কির অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল দুর্নীতি তিনি উচ্ছেদ করবেন। কিন্তু তার সরকারের ঘনিষ্ঠ মহলের দুর্নীতি সেই প্রতিশ্রুতির ওপর জোর আঘাত হানল।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাকে শক্তিশালী করেছেন। কিন্তু সমালোচকেরা বলছেন, নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের জন্য দমন-পীড়ন হচ্ছে।
বর্তমান কেলেঙ্কারি ইউক্রেনের রাজনৈতিক বিভাজনকেই গভীর করবে। যুদ্ধকৌশল নিয়ে বিভেদ সৃষ্টিকারী বিতর্ক যখন তুঙ্গে এবং এ বিষয়ে ইউক্রেনের সামরিক নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যকার মতবিরোধের বিষয়টি যখন প্রকাশ্যে চলে এসেছে, সে সময়ে জেলেনস্কির কাছে রাজনৈতিক বিভাজন কাম্য কোনো বিষয় হতে পারে না।
জেলেনস্কি তাঁর সেনাপ্রধান ভ্যালেরি জালুঝনিকে বরখাস্ত করবেন কি না কিংবা সেই ক্ষমতা তাঁর আছে কি না, সেটা একদমই পরিষ্কার নয়। বলা হচ্ছে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তাঁর সেনাপ্রধানকে প্রতিরক্ষা উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে বলেছিলেন। কিন্তু জালুঝনি সেটা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। জেলেনস্কি ও জালুঝনির মধ্যে সম্পর্ক সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তিক্ত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ২০২৩ সালে ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ অভিযান তেমন কোনো সাফল্য বয়ে আনতে ব্যর্থ হওয়ায়, সেটা চরম রূপ ধারণ করে।
২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে জেলেনস্কি তাঁর শীর্ষ জেনারেল জালুঝনিকে নিন্দা করেন। এর কারণ হলো জালুঝনি প্রকাশ্যে বলেন, যুদ্ধ অচলাবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে। আরেকটি জল্পনা ডানা মেলেছে, জালুঝনি রাজনীতিতে আসতে চলেছেন এবং জেলেনস্কির বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হবেন। ডিসেম্বর মাসের এক জরিপ বলছে, ৬২ শতাংশ ইউক্রেনীয় বলছেন, তাঁরা জেলেনস্কিকে বিশ্বাস করেন আর জালুঝনির ওপর আস্থা রাখছেন ৮৮ শতাংশ।
দুর্নীতি-কেলেঙ্কারি ও ইউক্রেনের ক্ষমতাকাঠামোর শীর্ষ পর্যায়ের রদবদলের খবর—দুইয়ের কোনোটাই রাশিয়ার সঙ্গে জয় তো দূরে থাক পরাজয় এড়াতে ইউক্রেনীয়রা একটা বিশ্বাসযোগ্য পথ তৈরি করতে পারছে—পশ্চিমাদের মধ্যে এই আস্থা আনবে না। আর এ ধরনের আস্থা ছাড়া, সহযোগিতার ব্যাপারটা আরও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার জোরালো অস্ত্র ছাড়া পশ্চিমা দেশগুলোর আইনসভা থেকে সহযোগিতা অনুমোদনের ব্যাপারটি দুর্বল হয়ে পড়বে।
এখন পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে, তা হলো, দুর্নীতি ইউক্রেনের টিকে থাকা না-থাকার মূল প্রশ্নটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। দুর্নীতিই ইউক্রেনের একমাত্র সমস্যা নয় কিংবা এটাই দেশটির সবচেয়ে বড় সমস্যা নয়। কিন্তু দুর্নীতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এই ধারণার কারণে ইউক্রেনের ভেতরের রাজনীতি যেমন জটিল হয়ে উঠছে আবার পশ্চিমা সমর্থনের ক্ষেত্রেও বড় বাধা তৈরি হচ্ছে।
দুর্নীতির কারণে ইউক্রেন ভেঙে যাচ্ছে, সেটা ঠিক নয়। কিন্তু যুদ্ধের মধ্যে দুর্নীতি এমন বাজে একটা ব্যাপার, যার কারণ ইউক্রেন ভেঙে যেতে পারে। কেননা, দুর্নীতি ইউক্রেনের ভেতরে ও বাইরে বড় প্রভাব ফেলছে।
স্টেফান উলফ, বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ে অধ্যাপক
জেন মনেত, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ওদেসা ল একাডেমির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের অধ্যাপক