দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির একেবারে শিকড়ে গেঁড়ে বসে আছে পরিবারতন্ত্র। নিয়তিবাদী সমাজে যেখানে ভক্তি ও সুবিধাবাদের জয়জয়কার, সেখানে গণতন্ত্রের নামে অভিজাততন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। ফলে গণতান্ত্রিক চর্চার ক্ষেত্রে কার্যত বাছাই গণতন্ত্রের বাইরে বের হয়ে আসতে পারেনি এখানকার বেশির ভাগ ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল। পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি-অর্থনীতি শেষ পর্যন্ত গোষ্ঠীতন্ত্রের জন্ম দেয়।
ফলে দেখা যায়, দলীয় ও সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে মন্ত্রী, আমলা কোনো পরিবার বা গোষ্ঠী থেকেই হয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি আলোচিত শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পেছনে যে রাজাপক্ষে সরকারকে দায়ী করা হয়, সেই রাজাপক্ষে পরিবার থেকে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন ছিলেন।
দক্ষিণ এশিয়ার এই রাজনৈতিক ঐতিহ্য থেকে বাংলাদেশ খুব যে একটা ব্যতিক্রম, তা নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে পরিবারতন্ত্র বেশ প্রবলভাবে দৃশ্যমান। তবে একটা ক্ষেত্রে সম্ভবত বেশ অনন্য নজির স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। রাজনৈতিক বিজ্ঞানে সেটাকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা যাবে, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। সংজ্ঞা নির্ধারণের আগে সেটিকে রাজনীতির ঘরতন্ত্র বলে ডাকা যাক। দলীয় প্রধানের স্ত্রীদের এমপি হওয়ার একটি উৎকৃষ্ট উপায় এই ঘরতন্ত্র। ব্যাপারটা অনেকটা এমন নিজেরা তো এমপি হয়েছেন, স্ত্রীরা কেন বাদ পড়বেন!
একাদশ জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছে, এমন তিনটি রাজনৈতিক দলে দলীয় প্রধানদের স্ত্রী তাঁদের স্বামীদের পাশাপাশি সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন। এটি নিঃসন্দেহে নৈতিক প্রশ্ন, কিন্তু মূল প্রশ্নটা আরও গভীরের। রাজনৈতিক দলের ভেতরেই যদি গণতান্ত্রিক চর্চার লেশমাত্র অবশেষ না থাকে, তাহলে তারা রাষ্ট্রে, সরকারে গিয়ে কীভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে?
দলীয় প্রধানের স্ত্রী সংসদ সদস্য—নৈতিকতার প্রশ্নটি সরিয়ে রাখলে দুটি শর্ত পূরণ করলে এটিকে হয়তো ন্যায্যতা দেওয়া যেত। এক. এমন যদি হতো, দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা রাজনীতি করে আসছেন এবং দলীয় রাজনীতিতে তাঁদের অনন্য অবদান আছে। দুই. দলের সদস্যরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তাঁদের মনোনীত করেছেন। এ দুটি শর্ত পূরণ হলে সেখানে প্রশ্ন তোলার অবকাশ ছিল না। কিন্তু কারো ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষাই যদি সে ক্ষেত্রে মুখ্য বিবেচ্য হয়, তাহলে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রে তা যে বড় ধাক্কা-তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
গত ৬ মার্চ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনুর স্ত্রী আফরোজা হক। সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু একাদশ জাতীয় সংসদে কুষ্টিয়া-২ আসনের সংসদ সদস্য। ইনু-আফরোজা দম্পতি শুধু একা নন, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও তাঁর স্ত্রী লুৎফুন্নেসা খান এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও তাঁর স্ত্রী শেরিফা কাদেরও বর্তমান সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন।
জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০ টি। জনগণের সরাসরি ভোটে কোনো রাজনৈতিক দল ও জোটের পাওয়া আসনের সংখ্যানুপাতিক হার অনুযায়ী কোন দল কতটি সংরক্ষিত আসন পাবে, তা নির্ধারণ করা হয়। একাদশ জাতীয় সংসদে বিএনপি থেকে সরাসরি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ছয়জন। এর বিপরীতে তাদের মহিলা আসন ছিল একটি। সেটিতে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন রুমিন ফারহানা। গত বছরের ১১ ডিসেম্বর বিএনপির সংসদ সদস্যরা জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। তাঁর আসন শূন্য হলে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের প্রার্থী করা হয় আফরোজা হককে। অন্য কেউ প্রার্থী না থাকায় তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
একাদশ জাতীয় সংসদে কোনো দলীয়প্রধানের স্ত্রীর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার প্রথম দৃষ্টান্ত স্থাপন হয় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির হাত ধরে। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন্নেসা খান সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য হিসাবে শপথ নেন। সাবেক ছাত্র ইউনিয়নকর্মী লুৎফুন্নেসা খান দলটির মহিলা ফ্রন্টে কাজ করেন। পলিটব্যুরো সদস্যদের রেখে সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য হিসেবে তাঁকে মনোনীত করায় দলটির ভেতরে সে সময়ে নানা প্রশ্নের জন্ম হয়েছিল।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী জি এম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদের ২০২১ সালের ২১ জুন সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি একজন কণ্ঠশিল্পী। জাতীয় পার্টির নেতা ও সংসদ সদস্য মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী মৃত্যুবরণ করলে তাঁর শূন্য আসন হলে শেরিফা কাদেরকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। জি এম কাদের লালমনিরহাট-৩ আসনের সংসদ সদস্য। আর তাঁর স্ত্রী শেরিফা কাদের লালমনিরহাট জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি।
দলীয় প্রধানের স্ত্রী সংসদ সদস্য—নৈতিকতার প্রশ্নটি সরিয়ে রাখলে দুটি শর্ত পূরণ করলে এটিকে হয়তো ন্যায্যতা দেওয়া যেত। এক. এমন যদি হতো, দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা রাজনীতি করে আসছেন এবং দলীয় রাজনীতিতে তাঁদের অনন্য অবদান আছে। দুই. দলের সদস্যরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তাঁদের মনোনীত করেছেন। এ দুটি শর্ত পূরণ হলে সেখানে প্রশ্ন তোলার অবকাশ ছিল না। কিন্তু কারো ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষাই যদি সে ক্ষেত্রে মুখ্য বিবেচ্য হয়, তাহলে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রে তা যে বড় ধাক্কা-তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতার যে চর্চা, সেখানে নারীদের রাজনীতিতে আসার পথ অনেকটাই রুদ্ধ। গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশে (আরপিও) স্পষ্ট করে বলা আছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সব পর্যায়ের ৩৩ শতাংশ নারী থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কোনো দলই লক্ষ্যমাত্রার ধারেকাছে নেই। এ অবস্থায় ঘরতন্ত্রের চর্চা রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ নিরুৎসাহিত করবে।
সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধি হিসেবেই সংসদে যান। জনগণের করের টাকায় তাঁদের ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা প্রদান করা হয়। ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা বা স্বপ্নপূরণের ক্ষেত্র কি জাতীয় সংসদ?
মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী