চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ২০ তম জাতীয় সম্মেলন চলছে। এখন পর্যন্ত এটা নিশ্চিত যে দলটির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সি চিন পিং তৃতীয় মেয়াদে শীর্ষ নেতা নির্বাচিত হতে চলেছেন। চীনে কমিউনিস্ট শাসন মূলত চলে আসছে ব্যক্তিবাদের ওপর ভর করে। তৃতীয় মেয়াদে সি চিন পিংয়ের আসার অর্থ হলো, এক ব্যক্তির ওপর নির্ভরতা আরও বাড়বে।
এক ব্যক্তিনির্ভর এই রাজনীতির কারণে স্বল্প মেয়াদে দেশ শাসনের ক্ষেত্রে বেইজিংয়ের যে দুর্বলতা, তা আরও গভীর হবে। দীর্ঘ মেয়াদে এর দুটি ফল। প্রথমত, চীনের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আরও অস্থিতিশীল হবে। দ্বিতীয়ত, শীর্ষ নেতৃত্ব ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর বেইজিংয়ের নীতির নাটকীয় বদল হতে থাকবে।
২০১২ সালে উত্থানের পর সি চিন পিং চীনের অভ্যন্তরীণ নীতির ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে আসছেন। এর মধ্যে রয়েছে, রাষ্ট্র ও সমাজে পার্টির কর্তৃত্ব শক্ত করা, অর্থনৈতিক অভিজাতদের ওপর বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রণ জোরালো করা, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে জোরপূর্বক মূল সমাজে অঙ্গীভূত করা, বিরোধী মত দমন এবং পশ্চিমা মতাদর্শ অনুপ্রবেশ যাতে না করতে পারে, সে জন্য তীক্ষ্ণ নজরদারি।
এর সবকিছুই সি চিন পিং করেছেন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শক্তি বৃদ্ধির জন্য। তিনি মনে করেন, ১৯৭৮ সাল থেকে শুরু হওয়া সংস্কার কর্মসূচির যুগে পার্টিকে শক্তিশালী করার বিষয়টা উপেক্ষা করা হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবেক মহাসচিব মিখাইল গর্বাচেভের মতো একই পরিণতি বরণ করতে হোক, তা চান না সি চিন পিং।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে এসব পদক্ষেপ ২০ তম কংগ্রেসে আসা নেতাদের জন্য একটা পরিষ্কার বার্তা দেয়। কেউ যদি সি চিন পিংকে কোনো বিষয়ে বিরোধিতা করেন, তাহলে শুধু তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, জীবনও ঝুঁকির মুখে পড়বে।
পার্টিকে শক্তিশালী করার এই প্রক্রিয়ার মূলে রয়েছে সি চিন পিংয়ের ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করা। ফো সি-লাই কিংবা চৌ ইয়ংকাংয়ের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে সি চিন পিং মতাদর্শিক নেতা হিসেবে নিজেকে একক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। সি চিন পিংয়ের ব্যক্তিত্বকে একটা ‘ধর্মমত’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁকে ঘিরে সব সময়ই একটা প্রোপাগান্ডা দৃশ্যমান। ২০১৭ সালের সম্মেলনে দলে তাঁর কোনো উত্তরসূরি মনোনীত হননি। এখন তিনি নিজের শাসনকাল বাড়ানোর (সম্ভবত পুরো জীবন) একটা স্থির পথে চলেছেন। এই সবকিছুই চীন যে এক নেতানির্ভর একটি ব্যক্তিবাদী শাসনের দিকে হাঁটছে, তারই প্রতিফলন।
ভাসা-ভাসাভাবে দেখলে বিষয়টিকে খুব শক্তিশালী বলে মনে হতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা গুরুতর সব সমস্যার প্রাথমিক সূত্র। সি চিন পিং এক ব্যক্তিশাসিত এমন এক শাসনে ফিরতে চাইছেন, যেটা মাও সে-তুং চীনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভ্লাদিমির পুতিনের অধীনে চীনেও আমরা একই ধরনের শাসন দেখি। বলা চলে, মাও কিংবা পুতিনের শাসনের যে ব্যর্থতা, তার সব কটির পুনরাবৃত্তি করতে চলেছেন সি চিন পিং।
একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা যখন ব্যক্তিবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে, তখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হাওয়া হয়ে যায় এবং সবখানেই ‘সহমত’ ধরনের লোকের সংখ্যা বাড়ে। সহকারীরা তাঁকে মন্দ কোনো খবর জানাতে দ্বিধা করতে শুরু করেন। ফলে সর্বোচ্চ নেতা নিজের অব্যর্থ প্রজ্ঞা ও চূড়ান্ত ক্ষমতা-সম্পর্কিত প্রোপাগান্ডায় বিশ্বাস করতে শুরু করেন। নিজের সেই দেবতুল্য অবস্থানের পতন হোক, তা কখনোই তিনি চাইবেন না।
এখন সি চিন পিংয়ের ব্যক্তিত্ব নিয়ে যে উচ্চতর ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে, তা থেকে তিনি কখনোই নামতে চাইবেন না। কেননা, তাতে তাঁকে দুর্বল নেতা বলে মনে করা হতে পারে। পুতিনের বিষয়টা বিবেচনা করে দেখুন। এ কারণেই আগবাড়িয়ে তিনি ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করেছেন। এখন আবার সেখানে যুদ্ধের গতি দ্বিগুণ বাড়িয়েছেন। এতে যে তাঁর সরকারের দ্রুত পতন কিংবা রাশিয়ার ভবিষ্যতের জন্য সর্বনাশ ডেকে নিয়ে আসা হচ্ছে, সেই বিবেচনা পুতিন করতে পারছেন না।
চীনের রাজনৈতিক অবস্থা অবশ্য এখনো রাশিয়ার মতো ততটা খারাপ হয়নি। পুতিন সিকি শতাব্দী ধরে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী রাশিয়ার রাজনীতিকে এই বিকৃত অবস্থায় এনেছেন। সি চিন চিং চীনের ক্ষমতায় রয়েছেন সবে এক দশক। বিরাট অর্থনৈতিক ক্ষতির পরও কোনো সংস্কারে না গিয়ে বেইজিং এখনো সি চিন পিংয়ের শূন্য কোভিড নীতির প্রতি একগুঁয়ে অবস্থান দেখিয়ে চলেছে। বিষয়টা বিবেচনায় নিয়ে কেউ বলতে পারেন, চীনেও রাশিয়ার মতো পরিস্থিতি ইতিমধ্যে বিরাজ করছে।
ব্যক্তিবাদনির্ভর শাসনের আরেকটি বড় দিক হলো রাজনৈতিক ক্ষয়। আদালতের সিদ্ধান্তগুলো আসে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। আমলাতন্ত্রের প্রতিদিনকার কাজে এর প্রতিফলন হয়। সরকারের কাজ বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের দক্ষতা কমতে শুরু করে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রকে তার নিজস্ব ধরনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে চেয়ারম্যান মাও সে-তুংয়ের অধীন চীনও একই ধরনের শাসনের মুখোমুখি হয়েছিল। তবে ট্রাম্পের চেয়ে মাওয়ের শাসন ছিল অনেক বেশি মারাত্মক।
মাও সে-তুংয়ের দুজন রাজনৈতিক উত্তরসূরির ভয়ানক মৃত্যু হয়েছিল। লাল রক্ষীদের হাতে ক্রমাগত নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন প্রথম জন। বন্দীশালার হিমশীতল মেঝেতে তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। সেটা ছিল অবহেলাজনিত মৃত্যু। দ্বিতীয়জনের মৃত্যু হয়েছিল রহস্যজনক একটি বিমান দুর্ঘটনায়। একটি অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর সোভিয়েত ইউনিয়নে পালানোর পথে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছিল। চীনের ওপরতলার রাজনীতি তখন রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছিল।
এই পরিবর্তন শেষে চীনে একটা সংস্কার যুগের সূচনা হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনে রাজনৈতিক সংস্কৃতির অধঃপতন ঘটেছে। ২০১৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতা চৌ ইয়ংকাংকে সরিয়ে দেন সি চিন পিং। তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। চৌ ইয়ংকাং হলেন সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম পলিটব্যুরো সদস্য, যাঁকে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ২০২২ সালে সাবেক বহিষ্কৃত উপ-জননিরাপত্তামন্ত্রী সান লিজিনকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে চীনের শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে উপদল গড়ার অভিযোগ তুলে তাঁদের দমন করেন।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে এসব পদক্ষেপ ২০ তম কংগ্রেসে আসা নেতাদের জন্য একটা পরিষ্কার বার্তা দেয়। কেউ যদি সি চিন পিংকে কোনো বিষয়ে বিরোধিতা করেন, তাহলে শুধু তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, জীবনও ঝুঁকির মুখে পড়বে।
কৌশলগতভাবে সি চিন পিং সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবেক নেতা গর্বাচেভের ভাগ্য বরণ করতে চাইবেন না। কিন্তু তাঁকে এমন সব কৌশল নিতে হচ্ছে, যাতে মাও সে-তুং কিংবা পুতিনের কথাই মনে আসছে।
কার্ল মিনজনার কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের চায়না স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে