রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেন কি তলেতলে সমঝোতার চেষ্টা করছে?

ইউক্রেনের সবচেয়ে আধুনিক ৪৭তম মেকানাইজড ব্রিগেড যুদ্ধক্ষেত্রে রুশদের হটিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে।

একটা বড় সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা চুক্তির ব্যাপারে মনোযোগ দিচ্ছে ইউক্রেন। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকভ বলেছেন, ‘রাশিয়া যদি তাদের আগে ঘোষণা করা বিশেষ সামরিক অভিযানের লক্ষ্য পরিবর্তন করে, তাহলে ইউক্রেন সমঝোতা ও শান্তি চুক্তির জন্য প্রস্তুত।’

রেজনিকভের এই বিবৃতি এল প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির খেরসন সফরের পর। ৮ জুন জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলে চলমান আক্রমণ অভিযানের সর্বশেষ অবস্থা তাঁকে অবহিত করা হয়।

সন্দেহ নেই যে জেলেনস্কি এমন সংবাদ শুনেছেন, যেটা তিনি শুনতে চাননি। ইউক্রেনের আক্রমণ অভিযান ঠিকঠাকমতো কাজ করছে না এবং ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। রুশরা ইউক্রেনের অনেকগুলো ট্যাংক অকেজো করে দিতে পেরেছে। এর মধ্যে ফ্রান্সের সরবরাহ করা এএমএক্স-১০এস এবং জার্মানির লিওপার্ড এ-৬ মডেলের ট্যাংক রয়েছে।

রুশরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তির হেনসোলডট টিআরএমএল-৪ডি এইএসএ রাডারও ধ্বংস করেছে। আইরিশ এই আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আনা হয়েছিল ইউক্রেনীয় বাহিনীর আক্রমণ অভিযানে সমর্থন দেওয়ার জন্য। সেটা ধ্বংস হওয়ায় আকাশযুদ্ধে রুশ বাহিনী চালকের আসন নিয়ে নিয়েছে।

রুশদের হতাহত ও বস্তুগত ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে আমরা খুব বেশি জানি না। কিন্তু ইউক্রেনের সবচেয়ে আধুনিক ৪৭তম মেকানাইজড ব্রিগেড যুদ্ধক্ষেত্রে রুশদের হটিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্রিগেডটি ইউরোপে ন্যাটোর হাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং অত্যাধুনিক হিমার্স ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাসহ আধুনিক যুদ্ধ সরঞ্জামসমৃদ্ধ।

যাহোক, সব মিলিয়ে ইউক্রেনের এই ব্রিগেডের কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেটা এখন পর্যন্ত অজানা। কিন্তু আক্রমণ অভিযানে অংশ নেওয়া অন্য ইউনিটগুলো অকেজো হয়ে গেছে। সে কারণে অনেক সৈনিক যুদ্ধ করতে অনীহা প্রকাশ করেছেন।

তবে ইউক্রেনের হাতে এখনো যুদ্ধ করার মতো বিশাল বহরের সেনাদল রয়েছে এবং আক্রমণ অভিযানের এটা কেবল প্রাথমিক পর্যায়। কিন্তু রুশদের প্রায় দুই লাখ রিজার্ভ সেনাদল রয়েছে। তাদের সবে নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়েছে।

জেলেনস্কি প্রকাশ্যে রুশদের সঙ্গে চুক্তির কথা বলতে পারেন না। সেটা করলে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয়ে যাবে এবং নিজের দেশে তাঁর অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে।

রেজনিকভ যদি রুশদের সঙ্গে সমঝোতার জন্য সত্যি সত্যি ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হয়ে থাকেন, তাহলে সেটা রুশদের কাছে প্রমাণ করতে হবে। কিন্তু রেজনিকভ যদি নিজেই কর্তৃপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে যান, তাহলে সেটা ইউক্রেনের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুতর ফাটল। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা হলো, বাস্তবে সমঝোতার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই সম্ভাবনা যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে যুদ্ধ অনিবার্যভাবে চলবে।

প্রশ্ন হলো, রেজনিকভ কি তাঁর বিবৃতির মধ্য এটা বলতে চেয়েছেন কি, রুশরা যদি আগ বাড়িয়ে সমঝোতার পথে আসতে চায়, তাহলে তাদের উদ্দেশ্য পরিবর্তন করতে হবে? অথবা ইউক্রেন কি তাদের দিক থেকে আগ বাড়িয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য রুশদের বিশেষ সামরিক অভিযানের উদ্দেশ্য পরিবর্তনের কথা বলছে?

রেজনিকভ যদি সমঝোতা প্রশ্নে রুশদেরকে তাদের অবস্থান পরিবর্তনের জন্য বলেন, তাহলে তাঁর সেই বিবৃতিটি ক্রেমলিন সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করে দেবে। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে ক্রেমলিনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। হতে পারে যে রেজনিকভ আসলে কী বলতে চেয়েছেন, সেটা বুঝতে চেষ্টা করছে রুশ কর্তৃপক্ষ। সমঝোতার জন্য রেজনিকভ ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি কি না, হয়তো সেটাও বুঝতে চাইছে রুশরা।

সম্প্রতি দুর্নীতির অভিযোগে রেজনিকভকে বরখাস্ত করার চিন্তা করেছিলেন জেলেনস্কি। ইউক্রেনে কঠোর সেন্সরশিপ চালু থাকলেও এ ঘটনা ফাঁস হয়ে যায়। এরপর রহস্যজনকভাবে সেই ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়। জেলেনস্কির সঙ্গে রেজনিকভের সম্পর্কে একটা টানাপোড়েন চলছে। এ কারণে রেজনিকভ কি তাঁর নিজের থেকেই বক্তব্য দিয়েছেন কি না, সেই প্রশ্ন এখন রুশদের পরীক্ষা করে দেখছে।

রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সমঝোতার বিষয়টি সবশেষ গতি পেয়েছিল ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটের ইউক্রেন, রাশিয়া, জার্মানি ও ফ্রান্স সফরের সময়। তিনি বলেছিলেন, একটা সমঝোতার প্রচেষ্টার জন্য তিনি কাজ করছেন। সে সময় তাঁর এই প্রচেষ্টাকে বাইডেন প্রশাসন ব্যর্থ করে দিয়েছিল।

রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সমঝোতার বিষয়টি সবশেষ গতি পেয়েছিল ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটের ইউক্রেন, রাশিয়া, জার্মানি ও ফ্রান্স সফরের সময়।
ছবি : রয়টার্স

সে সময় বেনেট বলেছিলেন, মূল প্রশ্নটি হলো জেলেনস্কি ও তাঁর সরকারকে রক্ষা করা—এ বিষয়টি পুতিন সাগ্রহে নিশ্চয়তা দিতে চেয়েছিলেন। এ ছাড়া ইউক্রেনকে ‘বেসামরিকীকরণ’ ও ‘বিনাৎসীকরণ’-এর লক্ষ্য থেকে সরে আসতে চেয়েছিলেন পুতিন।
মস্কো ও ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বেনেট সমঝোতার বিষয়টি ভুলভাবে উপস্থাপন করেছেন।

১৯৬২ সালে কিউবান ক্ষেপণাস্ত্র–সংকটের সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা দলকে ফাঁদে ফেলেছিলেন এবং তাঁর ভাই রবার্ট কেনেডিকে ওয়াশিংটনে অবস্থিত সোভিয়েত দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত আনাতলি ডব্রিনিনের কাছে পাঠিয়েছিলেন। রবার্ট কেনেডি সে সময় আটর্নি জেনারেল ছিলেন।

সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা নিকিতা খ্রুশ্চেভের প্রশ্ন ছিল, রবার্ট কেনেডি কি উপযাচক হয়ে এসেছেন, নাকি প্রকৃতপক্ষে তাঁর ভাইয়ের হয়ে কথা বলতে এসেছেন? নিকিতা খ্রুশ্চেভের শ্যালক সোভিয়েত সাংবাদিক আলেক্সি আডঝুবি প্রেসিডেন্ট কেনেডির সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি নেওয়া সাক্ষাৎকারটি প্রকাশের জন্য নেওয়া হয়নি। আলেক্সির প্রধান জিজ্ঞাসা ছিল প্রেসিডেন্টের ভাই ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি কি না। কেনেডি নিশ্চিত করেছিলেন তাঁর ভাই তাঁরই প্রতিনিধিত্ব করছেন।

আরও পড়ুন

এ ঘটনা গোপন সমঝোতার দরজা খুলে দিয়েছিল। ফলশ্রুতিতে কিউবা থেকে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র এবং তুরস্ক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র জুপিটার সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

রেজনিকভ যদি রুশদের সঙ্গে সমঝোতার জন্য সত্যি সত্যি ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হয়ে থাকেন, তাহলে সেটা রুশদের কাছে প্রমাণ করতে হবে। কিন্তু রেজনিকভ যদি নিজেই কর্তৃপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে যান, তাহলে সেটা ইউক্রেনের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুতর ফাটল। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বাস্তবে সমঝোতার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই সম্ভাবনা যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে যুদ্ধ অনিবার্যভাবে চলবে।

  • স্টিফেন ব্রায়েন সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি অ্যান্ড ইয়র্কটাউন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো

  • এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত