রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্প্রতি পিয়ংইয়ং সফর করে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এর পরপরই উন নতুন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার ঘোষণা দিয়েছেন। এতে ওয়াশিংটনে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এটি আমেরিকার মিত্রদের বিচলিত করেছে এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার হুমকি দিয়েছে।
উত্তর কোরিয়ার কারণে এবারই যে প্রথম এ ধরনের উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা নয়।
বর্তমানে যে আশঙ্কার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তার জন্য একজন ব্যক্তির বিতর্কিত কাজকে দায়ী করা যেতে পারে। তিনি হলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ট্রাম্প যখন ক্ষমতায়, তখন তাঁর কূটনৈতিক প্রচেষ্টাগুলোকে খামখেয়ালি ও বিপজ্জনক হিসেবে দেখা হতো। বিশেষ করে, যখন ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার স্বৈরশাসক কিম ২০১৭ সালে পাল্টাপাল্টি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিচ্ছিলেন, তখন উত্তেজনা অনেক বেড়ে গিয়েছিল।
২০১৮ ও ২০১৯ সালে ট্রাম্প ও কিম দুটি শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। ওই বৈঠক দুটির পর প্রকৃতপক্ষে দুই দেশের মধ্যে কয়েক দশকের দীর্ঘ দ্বন্দ্ব সমাধানের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছিল। তবে পরে ট্রাম্পের আবেগপ্রবণতা ওই প্রচেষ্টাগুলোকে বিপথগামী করে ফেলে এবং আবার উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগ তৈরি হয়েছে।
মূলত বিশ্ব মঞ্চে নিজেকে উজ্জ্বল করে তুলে ধরার এবং পূর্বসূরি বারাক ওবামার মতো শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জেতার একটি সুযোগ পাওয়া যাবে মনে করে ট্রাম্প কিমের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকের জন্য চাপ দিয়েছিলেন।
এটি একটি কঠোর বাস্তবতাও প্রতিফলিত করেছিল। ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর সঙ্গে অনুষ্ঠিত প্রথম ও একমাত্র বৈঠকে ওবামা সতর্ক করেছিলেন, উত্তর কোরিয়া লাখ লাখ আমেরিকান নাগরিককে হত্যা করতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা অর্জনের পথে রয়েছে। ওবামা ট্রাম্পকে এ-ও বলেছিলেন, উত্তর কোরিয়াকে এ ধরনের সজ্জিত হওয়া ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রকে একটি পূর্বনির্ধারিত হামলা চালাতে হতে পারে।
কিমের সঙ্গে দেখা করার জন্য ট্রাম্পের পক্ষ থেকে দেওয়া প্রস্তাব উত্তর কোরিয়ার স্বপ্নপূরণ ছিল। কারণ, ট্রাম্পের ওই প্রস্তাব বিশ্ব মঞ্চে উত্তর কোরিয়ার গ্রহণযোগ্যতার ইঙ্গিত দিয়েছিল।
দাদা ও বাবার মতো কিমও তাঁর দেশের অনুন্নত অর্থনীতিকে আধুনিক করতে চেয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শীতল যুদ্ধের সমাপ্তি (যা উত্তর কোরিয়াকে প্রতিরক্ষা থেকে বেসামরিক অর্থনীতিতে তার সম্পদ স্থানান্তর করতে সক্ষম করেছিল) প্রক্রিয়াটির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এটি অর্জনের জন্য কিম তাঁর পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিকে পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেন।
এমনকি ট্রাম্প ও কিম যখন প্রকাশ্যে পাল্টাপাল্টি হুমকি দিচ্ছিলেন, তখনো তাঁরা গোপনে শীর্ষ বৈঠক আয়োজনের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।
ট্রাম্প ক্ষমতা নেওয়ার পরপরই উত্তর কোরিয়ানরা মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কিমের দেখা করার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন। সিঙ্গাপুরে দুই পক্ষের গোপন আলোচনার সময় উত্তর কোরিয়ার গোয়েন্দারা সিআইএর গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে ট্রাম্প কিমের সঙ্গে দেখা করার বিষয়ে আন্তরিক কি না।
যদিও ট্রাম্প প্রশাসনের সরকারি নীতি ছিল উত্তর কোরিয়ার নেতাদের আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করা, কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সরাসরি ‘নেতার সঙ্গে নেতার’ শীর্ষ বৈঠকের ধারণাটিকে বেছে নিলেন। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে তিনি জাতিসংঘের একজন দূতের মাধ্যমে কিমকে একটি বৈঠকের প্রস্তাব পর্যন্ত পাঠিয়েছিলেন।
ট্রাম্প তা জানুন বা না জানুন, প্রকৃত সত্যটা হলো, উত্তর কোরিয়াকে আরও ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র সংগ্রহ করা থেকে ফেরানোর একমাত্র উপায় ছিল কিমের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়া।
ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা বন্ধ করার এবং পরীক্ষার এলাকাগুলো অকার্যকর করতে শুরু করার জন্য কিমের একতরফা সিদ্ধান্ত থেকে বোঝা যায়, তিনি কতটা আন্তরিক ছিলেন।
লক্ষণীয়ভাবে কিম একটি বড় অর্থনৈতিক আধুনিকীকরণ কর্মসূচিও ঘোষণা করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে ধারণা করা যায় যে কিম আশা করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার দ্বন্দ্ব শিগগিরই শেষ হবে।
কয়েক দশকের শত্রুতার অবসান তো কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সম্ভব নয়। ২০১৮ সালের জুনে সিঙ্গাপুরে প্রথম ট্রাম্প-কিম শীর্ষ বৈঠকটিতে ট্রাম্প নিজেই এটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। হয়তো এ কারণেই তিনি সহযোগীদের বলেছিলেন, এটি একটি ‘প্রক্রিয়া’, যার জন্য বেশ কয়েকটি শীর্ষ বৈঠকের প্রয়োজন হতে পারে।
ট্রাম্পের কথাই যে ঠিক ছিল, তা ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে হ্যানয়ে কিমের সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় বৈঠকের সময় বোঝা গিয়েছিল। ওই বৈঠকের আগে ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিফেন বিগান ও উত্তর কোরিয়ার কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র দর-কষাকষি হয়েছিল।
সাবেক মার্কিন কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়া কতটুকু পারমাণবিক কর্মসূচি অকার্যকর করবে এবং তার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে, তা নিয়ে দীর্ঘ সময় রশি-টানাটানি হয়েছে।
ট্রাম্প ও কিম এই সমস্যাগুলো সমাধানের অনেকটা কাছাকাছি গিয়েছিলেন। ট্রাম্প যতটা ছাড় দিতে রাজি ছিলেন, কিমের দাবি তা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ফলে অধৈর্য চরিত্রের জন্য সুবিদিত ট্রাম্পের সঙ্গে কিমের ঝগড়া বেঁধে যায় এবং আকস্মিকভাবে শীর্ষ সম্মেলনটি সংক্ষিপ্ত করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
দুঃখজনকভাবে, আলোচনা যখন একটি সমাধানমূলক পরিণতির দিকে যেতে শুরু করেছিল, ঠিক তখনই ট্রাম্প আবেগতাড়িত হয়ে পিছিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্তটি ঠিক তখনই এসেছিল, যখন আলোচনা গতি আসতে শুরু করেছিল।
ধারণা করা হয়, কিম তাঁর পরমাণু কর্মসূচি পুরোপুরি বন্ধ করতে রাজি না হওয়ায় সম্মেলনটি ভেস্তে গিয়েছিল।
অনেকে মনে করেন, ট্রাম্পের সে সময়কার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন ট্রাম্পকে বৈঠক ভেস্তে দিতে উসকানি দিয়েছিলেন। তবে দিন শেষে বৈঠকটি ব্যর্থ হওয়ার জন্য সবাই কমবেশি ট্রাম্পকেই দায়ী করে থাকেন।
ওই বৈঠক যদি সফল হতো, তাহলে হয়তো আজ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার একধরনের সমঝোতার সম্পর্ক থাকত। আর সেটি হলে আজ পুতিনের সঙ্গে উনের সহযোগিতা চুক্তি হতো না; উনও আমেরিকার বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিতে পারতেন না।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত
জোয়েল এস উইট হেনরি এল স্টিমসন সেন্টারের নর্থ ইস্ট এশিয়া সিকিউরিটি স্টাডিজের একজন ডিসটিংগুইশড ফেলো।