১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ১৪ বছর। তখন একটা কথা প্রায়ই শুনতাম, ‘গুজবে কান দেবেন না। দেয়ালেরও কান আছে।’
পরবর্তী সময়ে এ কথার নিগূঢ় অর্থ বুঝতে পেরেছিলাম। প্রথমত, ‘গুজব’ মানে হচ্ছে ‘অপতথ্য’। অর্থাৎ কিনা যে তথ্য বানানো, যে তথ্য মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। দ্বিতীয়ত, ‘দেয়ালের কান আছে’—এর অর্থ হচ্ছে ‘গুজব’ সর্বভেদী-সর্ববাধা ভেদ করে অপতথ্য অতি দ্রুত অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে যায়।
তবে পুরোনোকালে বেশির ভাগ সময়ে গুজবের প্রচার ও প্রসার ঘটত মানুষের মুখে মুখে ও কথার মাধ্যমে।
ইদানীং অবশ্য অপতথ্যের প্রকৃতি ও প্রকার—দুটোই ভীষণভাবে বদলে গেছে। তথ্যপ্রযুক্তির বিপ্লব এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দ্রুত প্রসারণের ফলে আমাদের সমাজে অপতথ্যের একটি সংস্কৃতি জন্ম নিয়েছে। এ অপতথ্য-সংস্কৃতি প্রবল শক্তিশালী; সেটি ছড়ানো অপতথ্য দিনকে রাত করে দেয়, সত্যকে মিথ্যা বানিয়ে দেয়, নিশ্চিত বিষয়কে অনিশ্চিত করে দেয়।
এ অপতথ্য সংস্কৃতির আরেকটা মাত্রা আছে। চিরায়তকাল থেকে দেখা গেছে, কিছু গুজব আছে, যেগুলো শুনলে মনে হতে পারে, সেগুলো ‘হলেও হতে পারে’। মানে বিশ্বাসযোগ্যতার দেয়ালের ধারেকাছেই তাদের অবস্থান। আবার কিছু কিছু গুজব আছে, যা শুনলেই মনে হয়, সেগুলো একেবারে ‘ডাহা মিথ্যা’। এ নিয়ে দুবার ভাবতে হয় না। সেই ‘ডাহা মিথ্যার’ অপতথ্যের জোয়ারে সয়লাব আজ আমাদের যাপিত জীবন। অন্য কোনো উৎসে যেতে হয় না, ফেসবুক খুললেই দেখা যায় গুজবের কত ছড়াছড়ি!
এমন সব গুজব চোখে পড়ে, যাতে প্রশ্ন জাগে যে একজন সুস্থ চিন্তার মানুষ কী করে এ–জাতীয় আজব গুজব ছড়াতে পারে? আমার মনে হয়, এর তিনটা কারণ আছে। এক. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন একটি আধার। যেকোনো ব্যক্তি যেকোনো সময়ে যা খুশি এতে লিখতে পারেন। সুতরাং যেকেউ যেকোনো রকমের রং চড়িয়ে মনের যেকোনো মাধুরী মিশিয়ে সেই আধারে যেকোনো গুজব ছড়াতে পারেন।
নানা সময়ে দেখা গেছে, গুজব ছড়ানোর ফলে ধর্মীয় সহিংসতা বেড়ে গেছে এবং অন্য ধর্মীয় কিংবা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর ওপর হামলা বেড়েছে। গুজব-সংস্কৃতি একটি সন্দেহের সংস্কৃতির জন্ম দেয়, একটি প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয়। দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক দল কিংবা প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অপপ্রচার অনেক সময়ে সন্ত্রাসের জন্ম দেয়, যার ফলে রাজনৈতিক সহিংসতা ও খুনোখুনি ঘটে যায়।
দুই. কোনো কোনো মানুষ ‘যেনতেনভাবেই’ প্রচার চান। তিনি চান, তাঁর যেকোনো সেঁটে দেওয়া লেখায় শত শত লোক ‘পছন্দ’ বোতামটি টিপুক। সুতরাং যে গুজবের তিনি জন্ম দিয়েছেন, তিনি চান, সেটি লোক হতে লোকে ছড়িয়ে পড়ুক এবং এ প্রক্রিয়ায় তাঁর নাম ও পরিচিতি মুখ থেকে মুখে ঘুরতে থাকুক। গুজব ছড়ানো যদি নামের, আত্মপ্রচারের এবং বিখ্যাত হওয়ার বড় হাতিয়ার হয়, তাহলে তা ছড়াতে বহুজন পিছপা হন না।
অপতথ্য ছড়ানোর তৃতীয় প্রধান কারণটি হচ্ছে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা। একটি পক্ষকে পছন্দ না করলে তার নামে গুজবের মাধ্যমে কুৎসা রটনার মতো কার্যকর পন্থা আর কী হতে পারে। সেই সঙ্গে নিজের পক্ষের মানুষের জন্য যদি ইতিবাচক গুজব ছড়ানো যায়, তাহলে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে দেওয়া যায়।
অপতথ্য বা গুজব ছড়ানো বিষয়ে এত কথা বলছি এ কারণে যে সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব বা অপতথ্য ছড়ানো ৫৮ শতাংশ বেড়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাঁটা তিন হাজার তথ্য মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। দেশের মধ্যে গত সরকারের দল, তার আনুষঙ্গিক অঙ্গ সংস্থার লোকজন সবচেয়ে বেশি গুজব ছড়িয়েছে। বহির্বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে ভারতে সবচেয়ে বেশি প্রচারিত হয়েছে বাংলাদেশ বিষয়ে।
গত আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পরে গুজব কিংবা অপপ্রচার নতুন রূপ নেয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে। এসব গুজব-অপপ্রচারের এক-তৃতীয়াংশই ছিল সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং ধর্মীয় হিংসা ও ঘৃণা বিষয়ে। বলা দরকার, নানা প্রচারমাধ্যমও এ ব্যাপারে ইন্ধন জুগিয়েছে।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে গুজব ছড়ানোর ফলে যাঁর বিরুদ্ধে অপপ্রচার হয়েছে, অনেক সময় তাঁর আর্থিক ও পেশাগত ক্ষতি হয়েছে। কর্মচ্যুত হয়েছেন অনেকে, ব্যবসা হারিয়েছেন কেউ কেউ। কোনো কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিচরিত্রের ওপর মিথ্যা অপপ্রচারের কারণে সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে অনেকের, সামাজিক মর্যাদা হারিয়েছেন অনেকেই। চরিত্র বিষয়ে অপপ্রচার একজন মানুষ এবং তাঁর পরিবারের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হতে পারে।
নানা সময়ে দেখা গেছে, গুজব ছড়ানোর ফলে ধর্মীয় সহিংসতা বেড়ে গেছে এবং অন্য ধর্মীয় কিংবা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর ওপর হামলা বেড়েছে। গুজব-সংস্কৃতি একটি সন্দেহের সংস্কৃতির জন্ম দেয়, একটি প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষার জন্ম দেয়। দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক দল কিংবা প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অপপ্রচার অনেক সময়ে সন্ত্রাসের জন্ম দেয়, যার ফলে রাজনৈতিক সহিংসতা ও খুনোখুনি ঘটে যায়।
কোনো রাজনৈতিক দল, প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তির পক্ষে যখন মিথ্যার ভিত্তিকে জোরালো কোনো কিছুর দাবি জানানো হয়, কিংবা তাদের মিথ্যা বা মনগড়া কোনো তথ্যের ভিত্তিতে তাঁদের সমর্থন করা হয়, অথবা মহিমান্বিত করা হয়, তখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর ভালো করার পরিবর্তে এ প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট সবার ক্ষতিই বেশি করে। মিথ্যা চাটুকারিতা কারও জন্যই উপকারী নয়।
অপতথ্য বা অপপ্রচারে ক্ষতি করা ভিন্ন কারও কোনো উপকারে আসে না। তবু নানা কারণেই অপসংস্কৃতির বিস্তার ঘটছে। এর বিস্তাররোধের সময় বোধ হয় সমাগত।
● সেলিম জাহান ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি