বিশ্লেষণ
বাইডেন সরে যাওয়ায় ডেমোক্র্যাটরা কি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন না জো বাইডেন। গত রোববার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার দৌড় থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে নতুন প্রার্থী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের প্রতি নিজের সমর্থন জানিয়েছেন বাইডেন। এখন দলীয় সিদ্ধান্ত একই হলে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে লড়বেন কমলা হ্যারিস। প্রেসিডেন্ট প্রার্থী পরিবর্তনের ফলে নির্বাচনে দলটি জয়ী হতে পারবে কি না, তা নিয়ে লিখেছেন রিচার্ড হাস
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি বদলে দিয়েছে। এবারের জুলাই মাসটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ঐতিহাসিক। রিপাবলিকান পার্টির কনভেনশনের প্রাক্কালে সুপ্রিম কোর্টের একটি সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হত্যার চেষ্টা—এই ঐতিহাসিক ঘটনাবলিরই অংশ।
ডেমোক্রেটিক পার্টির অনেক কর্মকর্তা এবং দাতাদের অনুরোধের পাশাপাশি ভোটারদের ইচ্ছা অনুসারে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে বাইডেনের সরে আসার সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল। ৮১ বছর বয়সী বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি বয়সী প্রেসিডেন্ট। এই বয়স নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তিনি কতটা ভালো করতে পারবেন, সে প্রশ্ন ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যেই ছিল।
এসব সত্ত্বেও দলের ডেলিগেটরা (প্রতিনিধি) তাঁকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। সে অনুযায়ী নির্বাচনী প্রচারও শুরু করেছিলেন বাইডেন। তবে বাদ সাধে গত মাসের শেষের দিকে ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর প্রথম সরাসরি নির্বাচনী বিতর্ক।
এই বিতর্কে বাইডেন পরাজিত হয়েছেন—অনেকেই এমনটা মনে করে থাকেন। তাঁর বয়সের জন্যই এসব কিছু হয়েছে এবং আরও চার বছরের জন্য তাঁর পক্ষে দেশ চালানো অসম্ভব—মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে এ রকম মনোভাব লক্ষ করা গেছে। কিন্তু ট্রাম্পের ক্ষেত্রে তাঁদের ধারণা তেমন নয়।
বাইডেনের সফলতা-ব্যর্থতা সম্পর্কে এত তাড়াতাড়ি কিছু বলা যাবে না। অন্য সব কারণ বাদ দিলেও একটি কারণ হলো, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর মেয়াদ এখনো ছয় মাস বাকি। তিনি সরে গিয়ে তাঁর সম্ভাব্য সমালোচনা দূর করার দিকে অনেক পথ এগিয়ে গেছেন।
কারণ, সমালোচকেরা বলেছেন, বাইডেন প্রতিযোগিতায় থাকলে নির্বাচনী পূর্বাভাস অনুসারে তিনি ট্রাম্পের কাছে পরাজিত হতেন। মার্কিন গণতন্ত্র এবং বিশ্বব্যাপী দেশটির ভূমিকার ব্যাপারে ট্রাম্পের অঙ্গীকার নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন রয়েছে।
ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ডেমোক্রেটিক মনোনীত প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হবেন—এমন সম্ভাবনা প্রবল। বাইডেনের অনুমোদন তাঁকে মনোনয়ন পেতে সাহায্য করবে। তবে এতেই বিষয়টা নিষ্পত্তি হবে না। কারণ, বাইডেনের কেবল তাঁর প্রতিশ্রুত দলীয় প্রতিনিধিদের প্রভাবিত করার ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে তাঁর সেই প্রভাব কাজে লাগবে না।
এই আগস্টে শিকাগোতে ডেমোক্রেটিক পার্টির কনভেনশনে একটি উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা হবে। এর মধ্যে চার সপ্তাহে যা ঘটবে, আগামী দিনে সেটাই নির্ধারক ভূমিকা পালন করতে পারে। হ্যারিস মূলত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মনোনয়ন পেতে পারেন। আবার এক বা একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বীও আবির্ভূত হতে পারেন।
ধরে নিচ্ছি যে কমলা হ্যারিস টিকে থাকবেন। পরবর্তী দৃশ্যপট তাঁর জন্য সুবিধাজনক হতে পারে। চলমান প্রক্রিয়াটি তাঁর রাজনৈতিক দক্ষতাকে আরও উন্নত করবে, একজন বিজয়ী হিসেবে দেখাতে সাহায্য করবে এবং তাঁকে একজন অজনপ্রিয় প্রেসিডেন্টের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ দেবে।
প্রক্রিয়াটি এমন এক সময়ে ডেমোক্রেটিক পার্টির ওপরও আলোকপাত করবে, যখন দলটিকে ভোটারদের কাছে নিজেকে আবার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে। এটি অপরিহার্য। কারণ, ট্রাম্প এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর রানিংমেট সিনেটর জেডি ভ্যান্স প্রচার-প্রচারণায় অনেকটাই এগিয়ে গেছেন।
তবে হ্যারিস যদি নির্বাচনী দৌড়ে তাঁদের কাছে হেরেও যান, জরিপগুলো এমন পূর্বাভাস দেয় যে তিনি বাইডেনের তুলনায় ভালো ফল করবেন। হ্যারিসের মনোনয়ন প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্র্যাটদের জয়ের সম্ভাবনাকে উন্নত করবে (সিনেটের নিয়ন্ত্রণ নাগালের বাইরে রাখা হবে) এবং এভাবে রিপাবলিকানদের পুরো ফেডারেল ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা থেকে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।
নির্বাচনী পূর্বাভাসে ট্রাম্প হ্যারিসের চেয়ে সামান্য এগিয়ে আছেন। তবে পরের মাসে তিনি স্পটলাইটে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে একটি উৎসাহ-উদ্দীপনার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কৌঁসুলি হিসেবে হ্যারিসের দক্ষতা রয়েছে, যে দক্ষতার পরিচয় তিনি প্রথমে একজন সরকারি কৌঁসুলি এবং পরে ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দিয়েছেন এবং মানুষের সম্মানও পেয়েছিলেন।
বিষয়টা নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় তাঁকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করবে। তিনি সুপ্রিম কোর্টের পাশাপাশি ভ্যান্সের গর্ভপাতবিরোধী কট্টর অবস্থান মোকাবিলা করার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি। রিপাবলিকান টিকিটে একজন নারী বা সংখ্যালঘু প্রার্থীর অনুপস্থিতিতে তিনি কিছুটা সুবিধা পেতে পারেন।
যাহোক, এবার ডেমোক্র্যাটদের একটি অনিবার্য চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এটাকে ‘হুবার্ট হামফ্রে ডিলেমা’ হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। ১৯৬৮ সালে হামফ্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন আবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এরপর হামফ্রে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন পেয়েছিলেন।
নির্বাচন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে বাইডেন যে ‘প্রত্যাহারপত্র’ লিখেছেন, তার সঙ্গে ৫৬ বছর আগে জনসনের কথার অনেক মিল রয়েছে। এক্সে জো বাইডেন লিখেছেন, ‘আমার সরে দাঁড়ানোটা আমার দল, আমার দেশ ও আমার নিজের জন্য সবচেয়ে মঙ্গলজনক।’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করাটা তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় সম্মানের বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।
বাইডেন ও জনসন প্রায় একই ধরনের শব্দ ব্যবহার করেছেন। দুজনের কণ্ঠে একই ধরনের বক্তব্য প্রতিধ্বনিত হলেও প্রধান পার্থক্য হলো, বাইডেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) তাঁর বক্তব্য প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে জনসন রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে উপস্থিত হয়ে বক্তৃতার মাধ্যমে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন।
হুবার্ট হামফ্রে ডিলেমার কথা উল্লেখ করা করা হয়েছে। এর নিগূঢ় অর্থ হলো: কীভাবে অনুগত দেখাবেন এবং অজনপ্রিয় নীতিগুলো দিয়ে ভারাক্রান্ত না হয়ে প্রেসিডেন্ট পদে জনপ্রিয়তার কৃতিত্ব নেবেন। ১৯৬৮ সালে এটি ছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধ, যা হামফ্রের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে জটিল করে তুলেছিল। কারণ, তিনি এমন একটি নীতি থেকে নিজেকে দূরে রাখা কঠিন বলে মনে করেছিলেন, যার সঙ্গে তিনি নিজেই যুক্ত ছিলেন। তা ছাড়া তিনি এমন একজন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কাজ করেছেন, আনুগত্যের জন্য যাঁর সহনশীলতা ছিল খুবই কম।
বর্তমানে কোনো একক ইস্যু জনসাধারণের বিতর্কে প্রাধান্য পায় না। তবে বাইডেনের থেকে ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনীত প্রার্থীকে আলাদা করার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, যাঁরা পরিবর্তন চান, তাঁদের অনেকের কাছে আগের শাসনামলকে একটি বোঝা মনে হতে পারে। কেউ যদি এই বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেন, তাঁদের শুধু দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সাম্প্রতিক নির্বাচনের ফলাফলগুলো দেখতে হবে।
হ্যারিস বা অন্য কেউ, যেই ডেমোক্রেটিক মনোনীত প্রার্থী হোন, তাঁকে বেশ কিছু বিষয়ে নীতিনির্ধারণী বক্তব্য দিতে হবে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস আইন, ‘চিপস’ ও বিজ্ঞান আইন। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই, গণতন্ত্র রক্ষার প্রচেষ্টা, গর্ভপাত ও জন্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়গুলোও রয়েছে।
তবে পরিস্থিতি এটাও বলে যে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী মধ্যপ্রাচ্যের নীতি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইতে পারেন। সাধারণ আমেরিকানরা প্রভাবশালী মার্কিন রাজনীতিকদের ইসরায়েলপন্থী হিসেবে দেখে থাকেন। তবে সীমান্তবিষয়ক নীতি এবং অপরাধকে তাঁরা মামুলি বিষয় মনে করেন।
হ্যারিস যদি প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডেমোক্র্যাটদের পছন্দের প্রার্থী হযন, তাহলে তাঁর রানিংমেট (ভাইস প্রেসিডেন্ট) নির্বাচনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হবে। নভেম্বরের নির্বাচনে বেশ কয়েকটি মধ্য-পশ্চিমি রাজ্য সিদ্ধান্তমূলক হতে পারে এবং সেখানে স্বাধীন ভোটারদের একটি বড় ভূমিকা থাকতে পারে। মিশিগানের গভর্নর গ্রেচেন হুইটমার, পেনসিলভানিয়ার জোশ শাপিরো, কেন্টাকির অ্যান্ডি বেসিয়ার এবং উত্তর ক্যারোলাইনার রয় কুপারকে হ্যারিসের সম্ভাব্য রানিংমেট হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তাঁরা সবাই বাইডেনের সঙ্গে কাজ করেছেন।
নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাইডেনের অত্যাশ্চর্য ঘোষণার পরও ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য এখনো অনেক কিছু অনিশ্চিত। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট, এবারের নির্বাচনের ফলাফল যুক্তরাষ্ট্র এবং বাকি বিশ্বের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে।
নির্বাচনে সাধারণত এ রকম হয় না। কারণ, প্রার্থীদের মিল তাঁদের পার্থক্যকে ছাড়িয়ে যায়। এবার সে রকম নয়। পার্থক্যগুলো গভীর। আমেরিকানরা এই নভেম্বরে ভোট দেওয়ার সময় ঠিক কতটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন, তা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা-বর্ণনা করা এখন বেশ কঠিন ব্যাপার।
রিচার্ড হাস লেখক এবং কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনের প্রেসিডেন্ট ইমেরিটাস
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে নেওয়া