অন্য কিছু নয়, কান্না এখন সমন্বয়ের

বন্যা দুর্গত এলাকায় ত্রাণ সহায়তা নিয়ে যাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবীরা

ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লামুখী ত্রাণসামগ্রীর কাফেলার কোনো অভাব নাই। যানজট ঠেলে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ছাড়াও দেশের নানা জায়গা আর প্রায় সব ধর্মের প্রতিষ্ঠান থেকে ত্রাণ পাঠানো হচ্ছে বন্যা উপদ্রুত এলাকায়। তবে যতই দিন যাচ্ছে সংবাদমাধ্যমে সমন্বয়ের জন্য হাহাকারের খবর ক্রমশ জোরালো থেকে জোরালোতর হচ্ছে। নিত্যদিন শিরোনাম হচ্ছে, ‘সমন্বয়ের অভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাচ্ছে না কেউ ত্রাণ’, ‘কেউ ত্রাণ পাচ্ছে, কেউ পাচ্ছে না’, ‘দক্ষতা ও সমন্বয়ের অভাবে ব্যাহত ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম’, ‘ত্রাণ বিতরণে সমন্বয়হীনতা’, ‘আমরা ত্রাণ বিতরণ করতে এসে এমন পরিস্থিতিতে পড়ব, এটা কখনো ভাবিনি’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমরা কেউ সমন্বিত হতে পছন্দ করি কি?

আমি এনেছি, আমি নিজে হাতে দিয়ে এখনই আবার ফিরে যাব। ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার মালামাল নিয়ে ৩০ হাজার টাকার গাড়িভাড়া দিয়ে আসা টাঙ্গাইলের একদল তরুণ এভাবেই কথা বলছিলেন। খুব ভালো হতো যদি এ রকম দূর–দূরান্ত থেকে ছুটে আসা তরুণদের প্রচেষ্টাকে আন্তরিকতার সঙ্গে জেলা প্রশাসন গ্রহণ করত। বাতলে দিত কোথায় কী প্রয়োজন। ফিরে যাওয়ার তাড়া থাকলে পরামর্শ দিতে পারেন কোথায় রেখে যেতে পারেন।

পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যাকশন নেটওয়ার্কের (প্রান) প্রধান নির্বাহী নুরুল আলম মাসুদ বন্যার শুরু থেকেই ফেনী–নোয়াখালী এলাকায় বানভাসি মানুষের সঙ্গে কাজ করছেন। তিনি জানালেন, এখনো দীর্ঘদিন ত্রাণ লাগবে। সেটা বিতরণে একটা সমন্বিত পরিকল্পনা করা জরুরি। সবাই যার যার জায়গা থেকে সহায়তা করবে; কিন্তু সেটা বিতরণের ব্যাপারে যদি রূপরেখা না থাকে তাহলে দেখা যাবে এক অঞ্চলের মানুষ বেশি সাহায্য পাবে, কোনো কোনো জায়গার মানুষ বঞ্চিত রয়েই যাবে। লক্ষ্মীপুর সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি জেড এম ফারুকী এবং সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সভাপতি কামাল হোসেন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে সবাই উঁচু সড়ক ধরে ত্রাণ বিতরণ করছেন এবং প্রত্যেকে নিজের মতো করে কাজ করছেন। এর ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বানভাসি মানুষেরা ত্রাণ পাচ্ছেন না। ত্রাণ বিতরণে প্রশাসনের সমন্বয় বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার কথা তাঁরা উল্লেখ করেছেন।

শুধু বিতরণ নয়, বাইরে থেকে আসা নতুন ত্রাণকর্মীদের নিরাপত্তার জন্যও সমন্বয়ের প্রয়োজন। জেলায় ঢুকেই তাঁদের নাম–ঠিকানা, যোগাযোগের ফোন নম্বর জেলা বা উপজেলা ত্রাণ সমন্বয় কেন্দ্রে লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন (সরকার এটাকে অবশ্য নিয়ন্ত্রণকক্ষ বলতে বেশি পছন্দ করে)। অনেকেই দুর্ঘটনায় পড়ছেন এবং নানা জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। গত ২৭ আগস্ট ঢাকার উত্তরা এলাকা থেকে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে নোয়াখালীতে গিয়েছিলেন একদল শিক্ষার্থী। ২৯ আগস্ট, বেলা একটার দিকে নোয়াখালী সদর উপজেলার ২ নম্বর দাদপুর ইউনিয়নের খলিফার হাটে ত্রাণ বিতরণে যাওয়ার পথে তিন শিক্ষার্থী দিঘির পানিতে ডুবে যান। পরে তাঁদের উদ্ধার করে ওই দিন বিকেলে সরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। একপর্যায়ে হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সদের বিরুদ্ধে সেবা প্রদানে গাফিলতির অভিযোগ করেন শিক্ষার্থীরা। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থীরা। শুরু হয় বিক্ষোভ। পরে পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনাবাহিনী ও পুলিশ ডাকতে হয়। শুরু থেকে একটা সমন্বয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেলে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়ানো যেত।

সার্বিক সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি। যাঁরা ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের নিজ উদ্যোগে বিতরণ নিরুৎসাহিত করতে হবে। প্রয়োজনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। মুক্ত কায়দায় বিতরণ আর ফটোসেশন বন্ধ করাটা খুবই জরুরি। বিভিন্ন জেলা থেকে উপদ্রুত এলাকায় নিয়ে যাওয়া ত্রাণসামগ্রী উপজেলা নির্বাহীর দপ্তরে জমা দিয়ে প্রাপ্তি স্বীকারপত্র নিয়ে ফিরে যাবেন বিভিন্ন জেলা থেকে আগতরা। অনেক জায়গায় তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে কিছু কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছে। 

একানব্বইয়ের ঘূর্ণিঝড়ের পর জেলা–উপজেলায় যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সার্বিক সমন্বয়ের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানোর একটা রেওয়াজ চালু হয়েছিল। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সব দপ্তরের সঙ্গে ফলপ্রসূ সমন্বয়ের এক নতুন ঐকতান সৃষ্টিতে সেই পদক্ষেপ ভালো কাজ করেছিল। সেটা আমরা আবার কেন করছি না? 

সমস্যাটা কোথায়?

প্রশাসন যথাসাধ্য কাজ করছে না বা করতে পারছে না অথবা দ্বিধান্বিত। এত দিন তারা (প্রশাসন) একটা পলিটিক্যাল আবার কিছুটা আমলাতান্ত্রিক চেইন অব কমান্ডের অধীনে কাজ করত। ভাবত এমপি সাহেব কী বলেন না বলেন; বা এমপি সাহেবরাও ‘সালাম’ দিতেন অথবা তাঁর অনুচরেরা যোগাযোগ করতেন। সরকারি পরিপত্র বা ক্যাবিনেটের ফোন বা চিঠি আসত। আর দুর্যোগ মানেই ছিল ঝাঁকে ঝাঁকে ভিআইপিদের আগমন আর তাঁদের প্রটোকল। পঞ্চাশ বছর ধরে তারা যে সিস্টেমে অভ্যস্ত ছিল, সেটা এখন নেই। অনেকেই এখন দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ইয়া নফসি ইয়া নফসি জপছেন।

বন্যাবিধ্বস্ত জেলাগুলো, বিশেষ করে কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনীতে পোস্টিং ছিল ‘প্রাইজ পোস্টিং’। এসব জেলায় পদায়ন নিশ্চিত করতে বিশ্বস্ততার উঁচু পাহারা পেরোতে হতো। না হলে শুনতে হতো ‘এরা কারা? কোথা থেকে এলো?’ এ রকম বিশ্বস্ততার আগুনে পোড়া ‘ক্যাডাররা’ স্বাভাবিকভাবেই এখন পানিশমেন্ট পোস্টিংয়ের ভয়ে জড়সড়। প্রায় সবাই স্যুটকেস গুছিয়ে রেখেছেন, বা সরিয়ে ফেলেছেন যা সরাবার।

জেলা উপজেলা সর্বত্র একই অবস্থা। এখনো টিম টিম করে জেগে আছে ইউনিয়ন পরিষদ। তারাই এখন মাঠপর্যায়ে সমন্বয়ের একমাত্র অবশিষ্ট সুতা। তবে এখানেও যে কারও কোনো দাগ বা দাগা নেই সেটা হলফ করে বলা যাবে না। তাঁদের অনেকই গা ঢাকা দিয়ে আছেন। তবে ইউনিয়ন পরিষদের নারী প্রতিনিধিরা প্রায় সবাই এলাকায় আছেন। কাজ করছেন। এখনই ইউনিয়ন পরিষদ ভেঙে না দিয়ে তাঁদের মাঠপর্যায়ে সমন্বয়ের কাজে লাগাতে হবে। ইউনিয়ন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিতে গার্ল গাইড, স্কাউট, বিএনসিসি ইত্যাদি থেকে তরুণদের সংযুক্ত করতে হবে পূর্ণ সদস্যের মর্যাদায়। এটুকু করতে সরকারের একটি পরিপত্রই যথেষ্ট হবে। পরে কোনো এক সময় খাড়া নির্দেশাবলি বা স্ট্যান্ডিং অর্ডারে পরিবর্তন আনলেই হবে। বলা বাহুল্য, জেলা, উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলোতে তরুণদের জন্য কোনো চেয়ার বা পদ নেই।

পুনর্গঠিত ইউনিয়ন কমিটিগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে উপজেলা কমিটি গঠন করতে হবে। সেখানও তরুণদের রাখতে হবে পূর্ণ সদস্যের মর্যাদায়। কমপক্ষে এক-তৃতীয়াংশ সদস্য থাকবেন তরুণরা।

সার্বিক সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকবেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি। যাঁরা ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের নিজ উদ্যোগে বিতরণ নিরুৎসাহিত করতে হবে। প্রয়োজনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। ফ্রিস্টাইল বিতরণ আর ফটোসেশন বন্ধ করাটা খুবই জরুরি। বিভিন্ন জেলা থেকে উপদ্রুত এলাকায় নিয়ে যাওয়া ত্রাণসামগ্রী উপজেলা নির্বাহীর দপ্তরে জমা দিয়ে প্রাপ্তি স্বীকারপত্র নিয়ে ফিরে যাবেন বিভিন্ন জেলা থেকে আগতরা। অনেক জায়গায় তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে কিছু কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

একানব্বইয়ের ঘূর্ণিঝড়ের পর জেলা উপজেলায় যুগ্ম সচিব এবং উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সার্বিক সমন্বয়ের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানোর একটা রেওয়াজ চালু হয়েছিল। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সব দপ্তরের সঙ্গে ফলপ্রসূ সমন্বয়ের এক নতুন ঐকতান সৃষ্টিতে সেই পদক্ষেপ ভালো কাজ করেছিল। সেটা আমরা আবার কেন করছি না?

জেলা রেড ক্রস কি নিষ্ক্রিয়?

জেলায় জেলায় রেড ক্রিসেন্ট কমিটিগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির অতীতে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ও পুনর্বাসনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের অনেক নজির আছে। তারাও সমন্বয়ের ক্ষেত্রে একটা ভূমিকা রাখত। এখন সে অবস্থা নেই। দুঃখের কথা, এই কমিটিগুলোও রাজনৈতিকীকরণের খপ্পরে পড়ে এখন কোমায় চলে গেছে। জেলা কমিটিগুলোতে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হওয়ার একটা অলিখিত ব্যবস্থা চালু আছে। মাত্র গত ২৪ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে তিন বছর মেয়াদে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা পর্ষদ বা ম্যানেজিং বোর্ড গঠিত হয়। তিন মাস না যেতেই তিন বছর মেয়াদি কমিটি ‘তামাদি’ হয়ে গেছে। এখন অ্যাডহক কমিটি করে কাজ শুরু করতে না পারলে মানুষের হক মারা যাবে। এই কমিটিতেও তরুণদের সদস্য/সম্পাদক করার কথা ভাবতে হবে।

এনজিওগুলোও সমন্বয় সংকটের বাইরে নেই

গত ২৪ আগস্ট কিছু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে এক বৈঠকে বন্যার্ত ব্যক্তিদের সহযোগিতায় সব এনজিওকে সমন্বিতভাবে কাজ করার তাগিদ দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। গত ২৮ আগস্ট এনজিও ব্যুরো ‘বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় অঞ্চলভিত্তিক সমন্বয় কেন্দ্রে এনজিও প্রতিনিধি মনোনয়ন’ দিয়ে এক চিঠি ইস্যু করে। এনজিও ব্যুরো জানে সমন্বয়ের কাজটা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো কীভাবে করে। সমন্বয়ের জন্য তারা তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে এবং এনজিও ব্যুরো প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকে সেটা কাজ করছে। এনজিও ব্যুরোর এই চিঠি নতুন এক ধোঁয়াশার সৃষ্টি করেছে।

বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে হলে এসব ধোঁয়াশা দূর করে আমাদের এগোতে হবে। লক্ষ্য ঠিক থাকলে আমরা নিশ্চয় আবু সাঈদ, মুগ্ধ, ফাইয়াজদের স্বপ্নের দেশটা ছুঁতে পারব।

  • গওহার নঈম ওয়ারা গবেষক। ই–মেইল: [email protected]