বোমাই ফাটালেন জাপানের রাষ্ট্রদূত। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) এবং ফ্রেডরিক এবারট স্টিফটুং (এফইএস) আয়োজিত মিট দ্য অ্যাম্বাসাডর অনুষ্ঠানে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি ছিলেন মূল অতিথি।
১৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত এ সভায় তিনি বলেন, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে দেখতে চায় জাপান। তিনি আরও বলেন, ‘এর আগে আমরা আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার কথা শুনেছি, যা পৃথিবীর অন্য কোথাও শুনিনি। আমি আশা করব, এবার তেমন সুযোগ থাকবে না বা এমন ঘটনা ঘটবে না।’
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে জাপানের রাষ্ট্রদূতের এ বক্তব্য বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে শহরে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের ব্যাখ্যা চাইবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পরদিন বিকেলে রাষ্ট্রদূত নাওকি পররাষ্ট্রসচিবের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি বলেছেন, এই সাক্ষাতে প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন জাপান সফর নিয়ে কথা হয়েছে, রাজনৈতিক প্রসঙ্গ বা নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা হয়নি।
পক্ষান্তরে শাহরিয়ার আলম তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘আমরা বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূতকে ডেকেছিলাম। তাঁকে যা যা বলা দরকার আমরা বলেছি।’ তিনি কূটনৈতিক শিষ্টাচার বিষয়ে ভিয়েনা কনভেনশনের ৪১ ধারার কথাও উল্লেখ করেন, যেখানে বিদেশি কূটনীতিকদের স্বাগতিক দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে নিষেধ করা হয়েছে।
এর মধ্যে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকও এ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নির্বাচনে কোনো দেশের হস্তক্ষেপ মেনে নেওয়া হবে না এবং নির্বাচন নিয়ে যাঁরা মন্তব্য করছেন, তাঁদের সতর্ক করা হবে। যে বিষয়টি স্পষ্টতই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এবং যা নিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বক্তব্য দিয়েছেন, কৃষিমন্ত্রীকে কেন সেটা নিয়ে কথা বলতে হবে, তা বোধগম্য নয়। আমাদের মন্ত্রীরা মনে হয় যৌথ দায়িত্ব (কালেক্টিভ রেসপন্সিবিলিটি) বিষয়টিকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করেছেন।
স্বাগতিক দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা না বলা অবশ্যই কূটনৈতিক শিষ্টাচারের অংশ। তবে বিষয়টি আমাদের রাজনীতিবিদদের মনে থাকে শুধু তখনই, যখন তাঁরা ক্ষমতায়। বিরোধী দলে গেলেই কথাটা তাঁরা বেমালুম ভুলে যান এবং যখনই প্রয়োজন মনে করেন, অভিযোগ নিয়ে যান রাষ্ট্রদূতদের কাছে। এমনকি, সুযোগ করে দেন বিদেশি কেউ এসে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেওয়ার। অতীতে স্যার নিনিয়ান বা তারানকো মিশনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে।
শক্তিমান দেশের রাষ্ট্রদূতেরা জানেন যে এরূপ হস্তক্ষেপমূলক বক্তব্য দিলেও তাঁদের কোনো সমস্যা হবে না। তা ছাড়া তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গণতন্ত্র এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সমর্থন বা সহায়তা দেওয়া পশ্চিমা দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতির অন্তর্ভুক্ত। তাই ভিয়েনা কনভেনশনের পরিপন্থী হলেও এক হিসেবে তাঁরা তাঁদের ম্যান্ডেটই পূরণ করছেন।
ভোট গ্রহণ এবং গণনায় সব দলের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবে, কাউকে ভয় দেখানো হবে না এবং যে প্রার্থী বেশি ভোট পাবে, সেই বিজয়ী বলে ঘোষিত হবে। আমাদের ভোট সংস্কৃতি থেকে এই স্বাভাবিক বিষয়গুলো হারিয়ে গেছে। এসব ফিরিয়ে আনতে হবে। আর তা যদি সম্ভব হয়, পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের তখন আর আগ বাড়িয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করার প্রয়োজন হবে না।
স্মরণ করা যেতে পারে যে জার্মানির রাষ্ট্রদূতও কিছুদিন আগে এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক প্রতিবেদনেও ২০১৮ সালের নির্বাচন মুক্ত ও ন্যায়সংগত হয়নি বলেই মত প্রকাশ করা হয়েছে। জাপানের রাষ্ট্রদূত হঠাৎ করে এ বক্তব্য দিয়ে ফেলেছেন, এমনটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই। জাপানের রাষ্ট্রদূত হঠাৎ করে কিছু করে বসেন না। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাঁর বক্তব্য সদর দপ্তরের অনুমোদনক্রমেই হয়েছে বলে ধরে নেওয়া উচিত।
গত দুই দিন ঘুরেফিরে দুটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাকে। বিভিন্ন সময় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক সতর্ক করার পরও রাষ্ট্রদূতেরা এরূপ বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকছেন না কেন? এর উত্তর খুব সহজ, রাষ্ট্রদূতেরা জানেন যে সতর্কবার্তা গুরুত্বসহকারে না নিলেও বাংলাদেশ তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো শক্ত ব্যবস্থা নেবে না। দ্বিতীয় প্রশ্ন, অন্যান্য দেশেও কি রাষ্ট্রদূতেরা এ রকম অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলান? না হলে বাংলাদেশেই কেন তাঁরা এমন কর্মে লিপ্ত হন?
এ প্রশ্নের উত্তর খানিকটা জটিল। আফ্রিকার দুর্বল এবং অরাজকতাপূর্ণ দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয়ে পশ্চিমের দেশগুলো হস্তক্ষেপ করে থাকে। বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে পশ্চিমের রাষ্ট্রদূতদের মন্তব্য করার প্রবণতা তাই অনন্যসাধারণ কিছু নয়। গণতন্ত্র অনেক দেশেই সর্বাঙ্গীণ সুন্দর হয় না। গণতন্ত্র নিয়ে কাজ করা মার্কিন প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউস ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রকে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করেছে।
তবে এসব দেশে ছোটখাটো ত্রুটি সত্ত্বেও নিয়মিত বিরতিতে মানসম্মত নির্বাচন হয় এবং সরকার কারা চালাবে, মোটাদাগে তা ভোটারদের দ্বারাই নির্ধারিত হয়। ভারতের বা এমন অন্যান্য দেশের নির্বাচন নিয়ে তাই রাষ্ট্রদূতেরা এরূপ মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন।
আপাতদৃষ্টে অনুচিত এবং বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ তাহলে কীভাবে সম্ভব? তাত্ত্বিক ভিত্তিতে উত্তরণের দুটি পথ আছে।
এক. এমন একটি শক্তিমান দেশে পরিণত হওয়া, যাতে পশ্চিমের দেশগুলোর আপত্তির তোয়াক্কা না করতে হয় এবং কোনো রাষ্ট্রদূত কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করলে প্রথমে সতর্ক করা এবং পরে তঁাকে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি ঘোষণা করা যায়। অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পক্ষে এমন উচ্চতা অর্জনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ, যে দেশের রাষ্ট্রদূতেরা ভিয়েনা কনভেনশনের বাইরে গিয়ে এসব মন্তব্য করছেন, সে দেশগুলোই বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের বড় বাজার এবং ঋণ বা অনুদানের বড় উৎস। তাঁদের চটানো তাই বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়।
দুই. যে বিষয়ে মন্তব্য নিয়ে এত হইচই, বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের মনোভাবও কিন্তু অনেকটাই একই রকম। ২০১৮ সালের মতো আরেকটি নির্বাচন কি বাংলাদেশের মানুষ চায়? মানুষ চায়, ভোট গ্রহণ হবে উৎসবমুখর পরিবেশে—দিনের বেলায়, রাতে নয়। বুথের ভেতর কোনো দলের প্রতিনিধি ঢুকে বলে দেবে না ভোট কোন মার্কায় দিতে হবে।
ভোট গ্রহণ এবং গণনায় সব দলের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবে, কাউকে ভয় দেখানো হবে না এবং যে প্রার্থী বেশি ভোট পাবে, সেই বিজয়ী বলে ঘোষিত হবে। আমাদের ভোট সংস্কৃতি থেকে এই স্বাভাবিক বিষয়গুলো হারিয়ে গেছে।
এসব ফিরিয়ে আনতে হবে। আর তা যদি সম্ভব হয়, পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের তখন আর আগ বাড়িয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করার প্রয়োজন হবে না। যত দিন আমরা তা না করছি, তত দিন তাঁরা ভিয়েনা কনভেনশন ভেঙে এরূপ উচ্চারণ চালিয়ে যাবেন, আর আমরা তাঁদের ডেকে এনে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখব, ফলাফল যা-ই হোক না কেন।
মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব