৭ অক্টোবর হামাস হামলা চালানোর পরপরই ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ গাজায় গণহত্যামূলক যুদ্ধ চালানোর জন্য তার প্রোপাগান্ডা যন্ত্রকে সর্বোচ্চ মাত্রায় সক্রিয় করেছে।
পশ্চিমা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা জাতি ও বর্ণ বিবেচনায় ফিলিস্তিনিদের নিকৃষ্ট মনে করে থাকে এবং ইসরায়েলি ভাষ্যকে সত্য বলে বিশ্বাস করতে সাধারণত প্রস্তুত থাকে। এটি মাথায় রেখেই ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ ৭ অক্টোবরের পর হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি শিশুদের শিরশ্ছেদ করা ও পুড়িয়ে মারা, নারীদের ধর্ষণ করা এবং অন্যান্য অপ্রমাণিত অপরাধের ভিত্তিহীন অভিযোগ আনে।
ইসরায়েলের কার্যত সাঁটলিপিকার হিসেবে কাজ করা পশ্চিমা মিডিয়া সেই সব অভিযোগের সত্যাসত্য যাচাই ছাড়াই দ্রুত তা প্রকাশ করে দেয়। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্লজ্জভাবে এই মিথ্যাগুলোকে তখন থেকে সত্য হিসেবে প্রচার করে চলেছেন।
৭ অক্টোবরের ঘটনার ইসরায়েলি প্রত্যক্ষদর্শীরা সাক্ষ্য দিয়েছেন, ইসরায়েলের বাহিনী ওই দিন হামাস যোদ্ধাদের ওপর হামলা চালানোর পাশাপাশি ইসরায়েলি বেসামরিক লোকদেরও ওপরও হামলা চালিয়েছিল। পরে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে, তারা কয়েক শ ইসরায়েলি নাগরিককে পুড়িয়ে মেরেছে।
বিভিন্ন প্রতিবেদনে আরও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, ইসরায়েলি গোলাবর্ষণে তাদের নিজেদের নাগরিকদের বাড়ি ধ্বংস হয়েছে; ইসরায়েলি সামরিক ঘাঁটিতে ইসরায়েলি গোলাবর্ষণে তাদের নিজেদের সেনাদের মৃত্যু হয়েছে; তারা নিজেরাই নিজেদের নাগরিকদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে।
এসব তথ্য বেরিয়ে আসার পরও পশ্চিমা গণমাধ্যম ও সরকারগুলো ইসরায়েলের বর্ণবাদী বানোয়াট ভাষ্য প্রচার করা থেকে বিরত থাকেনি। ইসরায়েলের কথিত মৃত্যুর সংখ্যাকে অনেকে সত্য বলে মেনে নিলেও আরব বিশ্ব প্রথম থেকেই ইসরায়েলের ঘোষণা করা নিহতের সংখ্যার বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে সন্দিহান ছিল। আর হামাস বরাবরই বলে এসেছে, তারা ইসরায়েলি বেসামরিক লোকদের নিশানা করার কথা অস্বীকার করে এসেছে।
ইসরায়েলের মিথ্যা ভাষণের তালিকা দীর্ঘ। ১৯৪৮ সাল থেকেই ইসরায়েল মিথ্যা, মিথ ও বানোয়াট দাবির একটি বিস্ময়কর রেকর্ড জমা করেছে। ৭৫ বছরের বেশি সময় ধরে আরব ও ইউরোপীয় গবেষকেরা এসব মিথ্যাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ইসরায়েলি ঐতিহাসিকেরাও দেশটির সরকারি ও সামরিক আর্কাইভের বানোয়াট নথিপত্র প্রকাশ করেছেন।
জাতিগত নির্মূলের ঘটনা ঘটানোর মধ্য দিয়ে জায়নবাদীরা যেসব অপরাধ করেছিল, সেই অপরাধের ওপরই ইসরায়েলের ভিত্তি দাঁড়ানো। আর সেই ভিত্তি নিয়েই ইসরায়েল তার সবচেয়ে বড় মিথ্যাচার করেছে।
উপনিবেশ গড়ে তোলা ইসরায়েলিরা দখল করা ফিলিস্তিনে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়ার পর ১৯৪৭ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে ১৯৪৮ সালের ১৪ মে পর্যন্ত চার লাখ ফিলিস্তিনিকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করেছিল। এরপর ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর নাগাদ আরও সাড়ে তিন লাখ ফিলিস্তিনিকে ভিটাছাড়া করে তারা।
ফিলিস্তিনিদের জাতিগত নির্মূল করার যুদ্ধের সময় জায়নবাদীরা কয়েক দফায় গণহত্যা চালিয়েছিল এবং ফিলিস্তিনি নারী ও মেয়েশিশুদের ধর্ষণ করাসহ অনেক সহিংস অপরাধ করেছিল। এর অকাট্য প্রমাণ থাকার পরও ইসরায়েল এবং তাদের প্রোপাগান্ডা যন্ত্র জোর দিয়ে বলে এসেছে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করা হয়নি; তারা নিজেদের ইচ্ছাতেই বাড়িঘর ছেড়ে চলে গেছে।
১৯৫০ এবং ১৯৬০–এর দশকে ইসরায়েল দাবি করেছিল, প্রতিবেশী আরব দেশগুলো যুদ্ধের আঘাত থেকে বাঁচতে রেডিওতে ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার আহ্বান চালিয়েছিল এবং সেই ঘোষণা শুনে ফিলিস্তিনিরা চলে গিয়েছিল।
কিন্তু এখনকার গবেষকদের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, প্রতিবেশী আরব দেশগুলো রেডিওতে ফিলিস্তিনিদের ঠিক উল্টো কথা বলেছিল। তারা তাদের বাড়িঘর ছেড়ে না যেতে বলছিল। কিন্তু জায়নবাদীদের রেডিওতে চক্রান্তমূলকভাবে ওই ধরনের ঘোষণা দিয়ে, সেটিকে আরব নেতাদের ঘোষণা হিসেবে প্রচার করা হয়েছিল।
এখন আবার সেই ধরনের মিথ্যাচারের খেলা শুরু হয়েছে। ফিলিস্তিনি মুসলমানদের গাজা থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। কিন্তু ইসরায়েল বলছে, তারা এ ধরনের কিছু করছে না। কিন্তু আরব ও মুসলিম বিশ্বের ইসরায়েলের এই মিথ্যাচারে বিশ্বাস করার কোনো কারণ থাকার কথা নয়।
জোসেফ মাসাদ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকান স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত