ইউক্রেনকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার আলোচনায় সম্মত হতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সময় নিয়েছে মাত্র আট ঘণ্টা। ইইউর মানদণ্ডে সময়টা খুবই কম। আপাতদৃষ্টে ইইউর এই সিদ্ধান্ত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির জয়। তবে এই জয় বহুমূল্য।
সদস্যপদ প্রাপ্তি নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি হাঙ্গেরির প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ওরবান ইউক্রেনের জন্য ৫৫ বিলিয়ন ডলারের অনুদান ছাড়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ফেলেছেন। আত্মরক্ষার জন্য ইউক্রেনের এই অর্থের খুবই প্রয়োজন ছিল। যুদ্ধের দ্বিতীয় বছর পূর্তির আগে সবকিছু মিলে ইউরোপ পড়েছে দোটানায়।
ইইউর ইউক্রেন নীতি তিনটি প্রধান ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমত, ইউরোপীয় নেতারা ইউক্রেনের জয়ের সংজ্ঞা কী হবে, সে ব্যাপারে একমত হয়েছেন। তাঁদের সিদ্ধান্ত হলো, ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা পুনরুদ্ধার হলে ধরে নিতে হবে ইউক্রেন যুদ্ধে জয়ী হয়েছে। স্মরণযোগ্য, যুদ্ধের প্রথম পর্বে ইউক্রেন যত দিন পর্যন্ত না দেশটির হৃত অংশ পুনরুদ্ধার করতে পারছে, তত দিন পর্যন্ত সমর্থন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছিল মিত্ররা।
দ্বিতীয়ত, ইউরোপের রাশিয়া নীতির মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রাশিয়াকে একঘরে করে ফেলা। পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলো একযোগে মস্কোর সেন্ট পিটার্সবার্গ ছেড়ে গেছে, জি-৭–ভুক্ত দেশগুলো রাশিয়ার তেলের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার কূটনীতিকদের বের করে দিয়েছে।
সর্বশেষ, শীতল যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ইউরোপের নির্ভরতা এখন সর্বোচ্চ। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বের পরও জো বাইডেন প্রশাসন কিছু বিষয়ে অনড় রয়েছে। যেমন ইউরোপের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিতে দেশটি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে উল্লেখ করেছে। ইউক্রেন ইতিমধ্যে তার হৃত অঞ্চলের ৮২ শতাংশ পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয়েছে। রাশিয়াও তার বিপুলসংখ্যক সেনা ও সম্পদ খুইয়েছে। উপরন্তু আটলান্টিক জোট (ন্যাটো), যেটি কিনা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে নির্জীব হয়ে পড়েছিল, সেটিও আবার শক্তি সঞ্চয় করেছে। শীতল যুদ্ধের পর এই প্রথম জোটটি এতটা সংহত রূপ নিল।
কিন্তু এই তিন স্তম্ভকেই কিছুটা নড়বড়ে মনে হয়। ইইউতে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে ওরবান ভেটো দিতে পারেন, এমন আশঙ্কা ছিল। সেই চ্যালেঞ্জকে ইইউ কায়দা করে এড়াতে পেরেছে। কিন্তু ইউক্রেনের এই জয় যতটা না বাস্তবিক, তার চেয়ে বেশি প্রতীকী। কারণ, ইইউ এই মুহূর্তে ইউক্রেনের জন্য জরুরি অর্থসহায়তা জোগানের ব্যাপারে কিছু করতে পারেনি। পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই একরকম থেমে আছে।
এই স্থিতাবস্থা রাশিয়াকে সুবিধাজনক অবস্থায় নিয়ে গেছে। রাশিয়ার ব্যাপক ও দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ কৌশলের কাছে ইউক্রেন বারবারই মার খেয়েছে। কারণ, ইউক্রেনের যে কৌশল, তা শুরু থেকেই ছিল অবাস্তব। উপরন্তু পলিটিকোর অনুসন্ধানে সম্প্রতি জানা গেছে, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা সর্বব্যাপী প্রভাব রাখতে পারেনি। ধারণা করা হচ্ছিল, নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়িত হলে রাশিয়া বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে, তা হয়নি। এ ছাড়া ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রকে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে বলে অনেকেই একমত।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ক্রমে কমে আসার বিষয়টি ইউরোপের স্থিতিশীলতার জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় হুমকি। ইউরোপের নেতাদের বড় উদ্বেগের জায়গা হলো ২০২৫ সালে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা। কারণ, ডানপন্থী বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্থাগুলো এরই মধ্যে ন্যাটোকে ‘সুপ্তাবস্থা’য় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা শুরু করেছে। তারা দায়দায়িত্বের ভাগ নেওয়ার বদলে দায়দায়িত্ব অন্যের ঘাড়ে কী করে চাপিয়ে দেওয়া যায়, সেই কৌশলের প্রতি মতামত গঠনের চেষ্টা করছে।
পশ্চিমা দেশগুলোর উচিত ইউক্রেনকে তাদের অভীষ্টে পৌঁছানোয় সহযোগিতা করা। ইউরোপের উচিত হবে ইউক্রেনের অর্থনৈতিক ও সামরিকশিল্পের সংস্কার সাধনে সহযোগিতা করা। যাতে করে ইউক্রেনকে আর পশ্চিমা অভ্যন্তরীণ রাজনীতির খেয়ালখুশির শিকার হতে না হয়। এতে ইউক্রেন রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে আত্মরক্ষায় টেকসই সমাধান খুঁজে পাবে
তবে শুধু যে ট্রাম্পেই সমস্যা, তা নয়। এমনকি বাইডেন প্রশাসন একসময় ইউক্রেনের সামরিক অভিযানে সমন্বয়কের ভূমিকায় থাকলেও সম্প্রতি তাদের সুর বদলেছে। অল্প কিছুদিন আগে জেলেনস্কি বাইডেনের সঙ্গে এক সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন।
ওই সম্মেলনে বাইডেন নতুন একটি বাক্য ব্যবহার করেছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যত দিন ‘সম্ভব’, তত দিন পর্যন্ত ইউক্রেনকে সহযোগিতা করবে। এর আগে তিনি বলতেন, যত দিন লাগুক, তত দিনই ইউক্রেনের জন্য মার্কিন সহায়তা অব্যাহত থাকবে। জেলেনস্কি ওয়াশিংটনে গিয়েছিলেন রিপাবলিকান আইনপ্রণেতাদের কাছ থেকে অনুদানের ব্যাপারে সম্মতি আদায় করতে। তাতে তিনি ব্যর্থ হন।
বাইডেনের এই ভাষাগত পরিবর্তনে বোঝা যায় যে তিনি ইউক্রেনকে নিয়ে দ্বিধায় আছেন। আর তাঁর এই পরিবর্তনের কারণেই ইউক্রেনের ইউরোপীয় মিত্ররা নতুন কৌশল গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। তবে ইউক্রেনের জয় শুধু আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা নয়। যুদ্ধের পর ইউক্রেনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। যদি ইউক্রেন এই যুদ্ধের পর একটি কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয় এবং ন্যাটো ও ইইউর সদস্য হতে পারে, তাহলেই তা হবে ইউক্রেনের জন্য নজরকাড়া জয়।
পশ্চিমা দেশগুলোর উচিত ইউক্রেনকে তাদের অভীষ্টে পৌঁছানোয় সহযোগিতা করা। ইউরোপের উচিত হবে ইউক্রেনের অর্থনৈতিক ও সামরিকশিল্পের সংস্কার সাধনে সহযোগিতা করা। যাতে করে ইউক্রেনকে আর পশ্চিমা অভ্যন্তরীণ রাজনীতির খেয়ালখুশির শিকার হতে না হয়। এতে ইউক্রেন রাশিয়ার আগ্রাসন থেকে আত্মরক্ষায় টেকসই সমাধান খুঁজে পাবে। যুদ্ধ কবে শেষ হবে, সেই অপেক্ষায় না থেকে পশ্চিমা সরকারগুলো এখনই ইউক্রেনের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং তাদের কর ব্যবস্থাপনাকে পুনর্গঠিত করার উদ্যোগ নিতে পারে।
ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে। আটলান্টিক মহাসাগরকেন্দ্রিক জোটের ভবিষ্যৎ এই মুহূর্তে অস্থিতিশীল। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিবর্তনের সম্ভাবনার প্রেক্ষাপটে ইইউকে এখন এই অনিশ্চয়তার কাল ভালোভাবে সামাল দিতে হবে।
● মার্ক লিওনার্ড ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের পরিচালক
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট