ইন্টারনেটে সাইদ রাজি মৌসাভির উপস্থিতি ছিল না। ইরানের সেনাবাহিনী ও মধ্যপ্রাচ্যের কোথাও তাঁকে পাওয়া যেত না।
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ৩০ বছর ধরে মৌসাভির উপস্থিতির ঘটনা কোনো লুকোছাপার বিষয় ছিল না।
ইরানের কুদস ফোর্সের জেনারেল কাসেম সোলাইমানির ‘ডান হাত’ বলে পরিচিত ছিলেন মৌসাভি। ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডসের শাখা কুদস ফোর্স ইরানের বাইরে অভিযানের জন্য পরিচিত।
সিরিয়ায় আসাদ সরকারের সঙ্গে সখ্য ছিল মৌসাভির। ২০২১ সালের পর লেবাননে হিজবুল্লাহের সঙ্গে তাঁর মৈত্রী ছিল। সিরিয়াতে তিনি জ্যেষ্ঠ কমান্ডার ছিলেন।
এবারের বড়দিনে ইসরায়েলের হামলায় মৌসাভি সংবাদের শিরোনাম হন। ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান থেকে দক্ষিণ দামেস্কের সায়েদ জয়নব এলাকায় অবস্থিত ইরানের মূল সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালানো হয়। এই হামলায় কমান্ডার মৌসাভি নিহত হন।
মৌসাভির উপস্থিতি নীরব হলেও হামাসের সালেহ আল-আরৌরি সব সময় আলোচনার পাদপ্রদীপে ছিলেন।
হামাসের সামরিক শাখার প্রতিষ্ঠাতা ও পশ্চিম তীরে হামাসের অভিযানের তদারককারী ছিলেন তিনি। হামাসের উপপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন আল-আরৌরি।
ইসরায়েলের রাজনৈতিক চাপের কারণে আল-আরৌরি কাতার থেকে তুরস্ক, তুরস্ক থেকে লেবাননে অবস্থান করছিলেন। ইরানি কর্মকর্তা ও হিজবুল্লাহর সঙ্গে সখ্যর কারণে আল-আরৌরি কখনো দৃশ্যপট থেকে হাওয়া হয়ে যাননি।
ইসরায়েলে ঢুকে ৭ অক্টোবর হামাস যে হামলা চালিয়েছিল, তার পরিকল্পনাকারী বলা হয় আল-আরৌরিকে। পণবন্দীদের মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েলের কারাগার থেকে ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুদের মুক্তির ক্ষেত্রেও (সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতি) আল-আরৌরির ভূমিকার কথা আলোচিত হয়।
২ জানুয়ারি বৈরুতের উপকণ্ঠে দাহিয়া অঞ্চলে হিজবুল্লাহর ঘাঁটিতে ড্রোন হামলা চালায় ইসরায়েল। আল-আরৌরিসহ হামাসের আরও আরও দুজন জ্যেষ্ঠ কমান্ডার সেই হামলায় নিহত হন।
এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের দায় খুব কম ক্ষেত্রেই স্বীকার করে ইসরায়েল। ২০০৪ সালে হামাসের আধ্যাত্মিক নেতা আহমেদ ইয়াসিনসহ আরও অনেকের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ইসরায়েলের সংশ্লিষ্টতার কথা শোনা যায়।
ইরান ও হিজবুল্লাহ এবং আসাদ সরকারের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে বারবার করে হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েল।
কিন্তু এবারে ইসরায়েল তাদের সামরিক অভিযানকে কেন্দ্র করে মৌসাভি ও আল-আরৌরির ওপর হামলা চালিয়েছে। এর মাধ্যমে হামাস, ইরান ও হিজবুল্লাহর দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে ইসরায়েল বলছে, তারা যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গায় গিয়ে হামলা করতে পারে। তোমরা এর জবাবে কী করবে করো দেখি?’
ইসরায়েলের এই সরাসরি চ্যালেঞ্জের বিপরীতে এখন পর্যন্ত ইরান ও হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে জবাবটা খুব ‘কড়া নয়’। ইসরায়েলের সঙ্গে তারা সরাসরি কোনো সংঘাতে জড়াতে চাইছে না।
মৌসাভির শেষকৃত্যে রেভল্যুশনারি গার্ডস কমান্ডার মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি ঘোষণা করেন, ‘জায়নবাদী শাসনের অবসানই হবে শহীদ সায়েদ রাজি হত্যার প্রতিশোধ।’ এ বক্তব্যের পরপরই তিনি বলেন, ‘এটা অর্জিত হবে মহান ও সম্মানিত ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের মধ্য দিয়ে।’
ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি নির্দিষ্ট কোনো পদক্ষেপের কথা উল্লেখ না করেই বলেছেন, এই অপরাধের অবশ্যই জবাব দেওয়া হবে। জায়নবাদী অপরাধীদের অবশ্যই তাদের অপরাধের জন্য শাস্তি পেতে হবে।
হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ কণ্ঠেও একই প্রতিধ্বনি শোনো গেল। তিনি বলেছেন, হামাস নেতা আল-আরৌরি হত্যার মতো গুরুতর অপরাধের শাস্তি অবশ্যই পেতে হবে।
ইরানের শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে হিজবুল্লাহ কমান্ডার সবার মনোভাব হলো, ইরানের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ শুধু ঝুঁকি নয়, সেটা হবে সম্ভাব্য আত্মঘাতী অভিযান।
৭ অক্টোবরের পর থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েলি সেনা ও হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের মধ্যে অসংখ্যবার পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও রকেট হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ পর্যন্ত ১৩৭ জন হিজবুল্লাহ যোদ্ধা ও কয়েকজন ইসরায়েলি সেনা এসব হামলায় নিহত হয়েছেন।
এ ধরনের সংঘর্ষে শুধু সামরিক ক্ষেত্রে প্রভাব ছড়াবে তা নয়, লেবাননের অর্থনীতির ওপরও বড় ধাক্কা দেবে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, লেবানন সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক সংকটের মুখে রয়েছে। দেশটির ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে।
ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে প্রায় অকেজো হয়ে পড়া লেবানন সরকারব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে এবং নৈরাজ্যে ডুবে যেতে পারে।
ধর্মতন্ত্র, সামরিকতন্ত্রের মধ্য দিয়ে ইরান সরকারে বর্তমানে স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে চলা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নিষেধাজ্ঞা এবং রেভল্যুশনারি গার্ডের মাত্রাতিরিক্ত স্বার্থের কারণে যে অব্যবস্থাপনা, তার ফলে ইরানের অর্থনীতি এখন পর্যন্ত ভঙ্গুর।
২০২২ সালে নারী স্বাধীনতার জন্য ইরানজুড়ে যে বিক্ষোভ সংঘটিত হয়, তা থেকে এই ইঙ্গিত মেলে যে বর্তমান সরকারের ওপর ইরানের লোকদের অসন্তোষ রয়েছে। যদিও সেই আন্দোলন নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়েছিল।
এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে সম্প্রতি আমওয়াজ ডট মিডিয়ার করা এক প্রশ্নের জবাবে ইরানের জ্যেষ্ঠ একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘এটা কঠিন একটি সিদ্ধান্ত। তুমি যদি প্রতিশোধ নিতে যাও, তাহলেও নারকীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। প্রতিশোধ না নিলেও নারকীয় পরিস্থিতি তৈরি হবে।’
এসব সীমাবদ্ধতার কারণে হামাস ও গাজার মানুষদের ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে মরতে ছেড়ে দেওয়াটাই ইরান ও হিজবুল্লাহর জন্য বেশি বাস্তবসম্মত সমাধান মনে হতে পারে।
সে ক্ষেত্রে ইরান মূলত গাজায় ইসরায়েলি হামলার যে মানবিক বিপর্যয়, সেই চিত্র তুলে ধরার মধ্য দিয়ে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে বিজয়ী হওয়া যায়, সেই পথই বেছে নিয়েছে।
এই ফাঁকে ইরান একধরনের অপ্রত্যক্ষ যুদ্ধ শুরু করেছে। ইরানের দিক থেকে রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থন পাওয়া হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে বেসামরিক জাহাজে হামলা চালাচ্ছে।
লোহিত সাগরে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে। আমেরিকান সেনারা হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে হুতিদের তিনটি নৌকা ডুবিয়েও দিয়েছে। এরপরও হুতি বিদ্রোহীদের হামলার কারণে লোহিত সাগর দিয়ে সুয়েজ খাল রুটে অনেক জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। এ কারণে এক সপ্তাহের ব্যবধানে জাহাজে পরিবহন খরচ দ্বিগুণ হয়েছে।
সাত অক্টোবরের পর ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ইরাক ও সিরিয়ায় আমেরিকান সেনাদের ঘাঁটিগুলোতে শতাধিক রকেট ও ড্রোন হামলা করেছে।
এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্র ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ওপর ভয়াবহ হামলা করেছে। গত সপ্তাহে বাগদাদে হামলা চালিয়ে সশস্ত্র গোষ্ঠী আল-নুজাবার নেতাকে হত্যা করেন যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা।
এ প্রেক্ষাপটে ইরান সরকার অন্য কোনো দেশের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে অস্বস্তি বোধ করবে। ইসরালেরের সঙ্গে সীমান্তে হিজবুল্লাহ মাঝেমধ্যে ছোটখাটো সংঘাত অব্যাহত রাখবে। কিন্তু বড় কোনো সংঘাতে জড়াবে না।
কিন্তু এ ধরনের সংঘাতে চেইন রিঅ্যাকশন হওয়ার শঙ্কা থেকে যায়। সে ক্ষেত্রে ইচ্ছার বিরুদ্ধেও অনেক সময় নতুন যুদ্ধক্ষেত্র চালু হয়ে যেতে পারে।
স্কট লুকাস অধ্যাপক, ক্লিনটন ইনস্টিটিউট, ইউনিভার্সিটি কলেজ ডাবলিন
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত