আমরা সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে জানতে পারলাম, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ ৯ জনের নাম উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করেছেন র্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমন হোসেন। একই সঙ্গে লিমন র্যাবকে ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করে এই বাহিনীর বিলুপ্তি দাবি করেন।
লিমন অভিযোগে যে ৯ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আরও আছেন এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক (র্যাবের গোয়েন্দা শাখার তৎকালীন পরিচালক) জিয়াউল আহসান ও র্যাব-৮-এর তৎকালীন ক্যাম্প কমান্ডার মেজর রাশেদ। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে লিমন হোসেন বলেন, ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার শাসনামলে চাইলেও সব অপরাধীকে আসামি করতে পারেননি।
এই সেই লিমন, যিনি ও তাঁর পরিবার দীর্ঘ ১৩ বছর দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী তাদের এক সদস্যের অপরাধকে আড়াল করতে উল্টো লিমনকে ‘সন্ত্রাসী’ বানিয়েছিল। এ রকম আরও অনেক লিমন র্যাব ও পুলিশের কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত বা আহত হয়েছেন। র্যাবও লিমনের বিরুদ্ধে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজিয়েছিল।
উল্লেখ্য, ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামের লিমন হোসেন ২০১১ সালের ২৩ মার্চ মাঠ থেকে গরু আনতে গিয়ে র্যাবের গুলিতে পা হারান। তিনি তখন একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। প্রতিবেশী এক পরিবারের সঙ্গে জমি নিয়ে তাঁদের দ্বন্দ্ব ছিল। ওই পরিবার লিমনের পরিবারকে শায়েস্তা করতে র্যাবকে ব্যবহার করে। র্যাব সদস্যদের এ রকম ভাড়া খাটার আরও অনেক উদাহরণ আছে। নারায়ণগঞ্জের কাউন্সিলর নূর হাসেন র্যাবকে দিয়ে সাতজনকে খুন করান।
র্যাবের গুলিতে লিমনের পা হারানোর খবর প্রথম আলোয় ছাপা হলে চারদিকে শোরগোল ওঠে। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠন প্রতিবাদ করে। র্যাব নিজেদের অপরাধ ঢাকতে লিমনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করে। ২০১৩ সালে সেই মামলা থেকে অব্যাহতি দিলেও তিনি র্যাবের বিরুদ্ধে যে মামলা করেছিলেন, তার বিচার হয়নি আজও।
মঙ্গলবার লিমন সাংবাদিকদের বলেন, ‘১৩ বছর অনেক আকুতি-মিনতি করেছি ন্যায়বিচারের জন্য। তখন ন্যায়বিচার তো পাইনি, বরং অনেক হয়রানির শিকার হতে হয়েছিল। আমি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দ্বারস্থ হয়েছি ন্যায়বিচারের পাওয়ার জন্য।’ পায়ের বিনিময়ে কোনো ক্ষতিপূরণ যথোপযুক্ত হয় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ চান।
তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের নিষেধাজ্ঞার কারণে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) তাঁর পুরোপুরি চিকিৎসা হয়নি বলে জানান লিমন। পরে ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলে। আর তাঁর পড়াশোনার সহায়তা করে গণস্বাস্থ্য ও প্রথম আলো। একজন গুলিবিদ্ধ কিশোরের প্রতি কোনো মানুষ এ রকম নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারেন না, যা করেছেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। মানুষ যুদ্ধক্ষেত্রেও চিকিৎসাসেবা পাওয়ার অধিকার রাখেন।
ওই ঘটনার সময় লিমনের বয়স ছিল ১৬ বছর। তাঁকে পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচার করে বাঁ পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলেন। তবে দমে যাননি লিমন হোসেন। র্যাবের গুলিতে এক পা হারানো লিমন হোসেন ২০১৩ সালে এইচএসসি পাস করেন। পরে ২০১৮ সালে তিনি আইন বিষয়ে স্নাতক ও পরের বছর স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ২০২০ সালে লিমন সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে সহকারী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।
রাষ্ট্র কার—র্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমনের, না গুলিবর্ষণকারী র্যাবের? যদি রাষ্ট্র ন্যূনতম মানবিক বোধ ধারণ করে, তাহলে লিমনের পায়ে গুলি করা র্যাব সদস্যকে খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করবে।
আওয়ামী লীগ সরকার লিমনের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করেনি। বরং লিমনের বিরুদ্ধে সরকারি কাজে বাধা দেওয়া ও র্যাব সদস্যদের ওপর হামলার মিথ্যা মামলা করেছিল।
অতীতে র্যাব বিলুপ্ত করার দাবি জানিয়েছিল মানবাধিকার সংস্থা এইচআরডব্লিউ। সংস্থাটির বিবৃতিতে বলা হয়, র্যাব থেকে সব সেনা প্রত্যাহার করে একে পুরোপুরি এক বেসামরিক বাহিনীতে রূপান্তর করা উচিত। ‘র্যাব একটা ঘাতক বাহিনী, যার সংস্কার সম্ভব নয়’ বলেও দাবি করে এইচআরডব্লিউ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্টের সদস্যরা র্যাব কর্তৃক গুম, খুন ও আইন লঙ্ঘনের অন্যান্য ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন সে সময়। যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের সাতজন সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
সহকর্মী মনজুরুল ইসলাম গত বছর ২৩ মার্চ লিখেছিলেন, লিমনকে কারা গুলি করেছিল, তদন্ত করে এখনো তা বের করতে পারেনি পুলিশ। এর ফলে মামলার বিচারকাজও শুরু হয়নি। এ অবস্থায় ন্যায়বিচার পাবেন কি না, তা নিয়ে আশঙ্কায় আছেন লিমন ও তাঁর পরিবার।
লিমনের মা হেনোয়ারা বেগমের দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের কথা জানা যায় মনজুরুল ইসলামের লেখায়। পুলিশের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ৩০ আগস্ট ঝালকাঠির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নারাজি দাখিল করেন। আদালত ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর নারাজি আবেদন খারিজ করে দেন। নারাজি খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ২০১৩ সালের ১৮ মার্চ রিভিশন করেন তিনি।
লিমনের ঘটনা ছিল নাগরিকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যতম উদাহরণ। এভাবে বাংলাদেশে কত নিরীহ মানুষ যে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যদের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন, তার হিসাব নেই। রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল প্রতিটি অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া। সেটা তারা করেনি; বরং লিমন ও তাঁর পরিবারকে ১৩ বছর ধরে দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
রাষ্ট্র কার—র্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমনের, না গুলিবর্ষণকারী র্যাবের? যদি রাষ্ট্র ন্যূনতম মানবিক বোধ ধারণ করে, তাহলে লিমনের পায়ে গুলি করা র্যাব সদস্যকে খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি করবে। লিমনের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবে।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম–সম্পাদক ও কবি