প্রতিবছর আমরা ঘটা করে বাজেট উপস্থাপন ও উদ্যাপন দেখি। গণমাধ্যমে এ নিয়ে নানা ধরনের সংবাদও দেখি। যেমন অর্থমন্ত্রী কী পোশাক পরে এলেন, তাঁর হাতের ব্রিফকেসটা কী রঙের, এসব নিয়ে প্রতিবারই সংবাদ হয়। একটা সময় পর্যন্ত আমরা দেখেছি, কোন অর্থমন্ত্রী কতবার বাজেট উপস্থাপন করেছেন, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা ছিল।
একসময় সর্বোচ্চ বাজেট উপস্থাপনের রেকর্ড ছিল সাইফুর রহমানের। সেটা ভেঙে দেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিন্তু বাজেটের ভেতরে কী আছে, এটা নিয়ে খুব কম আলোচনা হয়। আমরা বাজেটের ওপরের বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়েই কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা, গুঞ্জন, হইচই হতে দেখি।
এবারের বাজেটে যেমন কালোটাকা সাদা করার কর ১৫ শতাংশ বনাম সাদা টাকার সর্বোচ্চ কর ৩০ শতাংশ নিয়ে একটা বড় বিতর্ক চলছে। কিন্তু এটা তো বাজেটের একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ। মূল বাজেট নিয়ে তেমন আলোচনা দেখি না। যেটুকু আলোচনা, তা-ও গতানুগতিক।
রাজনীতিবিদেরা বাজেট বুঝুক না বুঝুক, পড়ুক না পড়ুক সরকারি দলের লোক হলে বলতেই হবে এই বাজেট গণমুখী, এই বাজেট সেরা বাজেট। আর যাঁরা বিরোধী রাজনীতি করেন, তাঁরা বলবেন, এই বাজেট উন্নয়নবিরোধী, এই বাজেট গরিব মারার বাজেট।
প্রকৃতপক্ষে বাজেট নিয়ে খুব একটা একাডেমিক আলোচনার সুযোগও নেই। বাজেট সংসদ সদস্যরাও তৈরি করেন না, রাজনীতিবিদেরাও তৈরি করেন না। তৈরি করেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। অন্য মন্ত্রণালয়গুলোয় নির্দিষ্ট কর্মকর্তা রয়েছেন, তাঁরা তাঁদের মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অর্থ মন্ত্রণালয়ে জানিয়ে দেন। এভাবেই বাজেট তৈরি হয়ে আসছে।
বাজেট বক্তৃতার শুরুতে ও শেষে একটা গৎবাঁধা রাজনৈতিক কথাবার্তা থাকে। কিন্তু যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, বাজেটের ভেতরের কাঠামোতে কোনো পরিবর্তন হয় না। যদিও বাজেট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গলাবাজি কিংবা বাগাড়ম্বরের কমতি নেই।
১৯৭২ সালের জুনে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ একটা সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রথম বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন। তখন আমাদের জাতীয় সংসদ ছিল না, ছিল গণপরিষদ। আমার মনে আছে, সে সময় একটা সমালোচনা হয়েছিল, বাজেট কেন জনপ্রতিনিধিদের সামনে উপস্থাপন করা হলো না।
তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর বাজেট বক্তৃতায় যুক্তি দিয়েছিলেন, যেহেতু সেই অর্থে জাতীয় সংসদ নেই, তিনি আশা করেন পরবর্তী বছরের বাজেটটি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করতে পারবেন। তাজউদ্দীন সে সময় ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের জুন পর্যন্ত সময়েরও একটা বাজেট উপস্থাপন করেছিলেন। স্বাভাবিক কারণেই সেটা ছিল সংক্ষিপ্ত বাজেট। সেই বাজেটের বেশির ভাগ খরচ ছিল জনপ্রশাসন খাতে।
পাকিস্তান আমলে অর্থবছর ছিল জুলাই-জুন। বাংলাদেশেও পাকিস্তান আমলের সেই ঐতিহ্যকে আমরা বহাল রেখেছি। আমাদের এখানে ক্যালেন্ডারের বছর ও অর্থবছর দুটো আলাদা। এ জন্য নানা সমস্যায় পড়তে হলেও কোনো সরকারই সেই ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে আসেনি।
বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকার। সেটা আস্তে আস্তে বেড়ে আট লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। টাকার অঙ্কে বাজেট বহুগুণ বাড়লে প্রকৃত মূল্যে কতটা বেড়েছে, এটা নিয়ে সন্দেহ আছে। আমরা যদি ১৯৭২ সালের দ্রব্যমূল্যের সূচকের সঙ্গে আজকের সূচকটা তুলনা করি, তাহলে দেখা যাবে, বাজেটের পরিমাণের যে উল্লম্ফন, তার অনেকটাই ফাঁপা। মানুষের প্রকৃত মজুরি ও প্রকৃত আয়ের কথা চিন্তা করলেও দেখা যাবে সেটাও খুব বেশি বাড়েনি।
বাজেটটা এমনভাবে করা প্রয়োজন, সেটা যেন জনবান্ধব হয়। একটা বিশেষ অর্থনৈতিক গোষ্ঠী যাদের প্রচুর টাকা ও প্রচুর সচ্ছলতা আছে, তাদের জন্য কর রেয়াত থাকার কোনো যুক্তি নেই। অর্থনীতিতে প্রগ্রেসিভ করব্যবস্থা নামে একটা টার্ম আছে। অর্থাৎ যাঁর আয় যত বেশি, আনুপাতিক হারে তিনি বেশি কর দেবেন। কিন্তু বাংলাদেশে তার উল্টোটা দেখি।
আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে একটা প্রবণতা হলো, বাজেটের আকার কত বড় হলো, সেটা নিয়ে তাঁরা একটা বাহবা পেতে চান। কিন্তু প্রতিবারই বাজেট পাসের আগে বিগত অর্থবছরের একটা সংশোধিত বাজেট উপস্থাপন করা হয়। এর মানে হচ্ছে, আগের বছর যে বাজেটটা দেওয়া হয়েছিল, সেই অনুযায়ী আয়ও হয়নি, ব্যয়ও হয়নি। এ রকমই একটা খেলা চলে আসছে।
আগে যেমন আমরা দেখতাম বাজেট দিলেই ব্যানার নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল বেরিয়ে যেত। এবারে সে রকম কিছু হয়নি। হতে পারে বাজেট নিয়ে মানুষের তেমন আগ্রহও নেই। মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে অর্থনৈতিক রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি, দ্রব্যমূল্য লাগামছাড়া ও আকাশছোঁয়া। এ নিয়ে তাঁরা একেবারে জেরবার।
বাজেট নিয়ে সাধারণ মানুষের চিন্তা হলো, জিনিসের দাম আরেকবার বাড়ল কি না। প্রতিবারই দেখা যায়, বাজেটে যেসব পণ্যের ওপর শুল্ক ও কর বাড়বে, তার খবর ব্যবসায়ীরা কেমন করে যেন আগে থেকেই জেনে যান। তাঁরা আগেই জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেন।
বাজেটের সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের একটা বড় সম্পর্ক আছে। কর রেয়াত হোক, নতুন কর আরোপ হোক—সবই এনবিআরের মাধ্যমে হয়। একটা কথা বাজারে প্রচলিত আছে, এনবিআর যার ওপর সদয়, সেখানে কর লাঘব হয়; আর যার ওপর নির্দয়, সেখানে কর বাড়ানো হয়।
এনবিআরকে নানাভাবে তোয়াজ করা বা খুশি করার প্রবণতা চলে আসে। এনবিআর কার ওপরে কখন সওয়ার হবে, সেটা তো বলা মুশকিল। সেখানে অনেক লবিং হয়। সে কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঠিক যুক্তি দিয়ে বোঝানো যায় না, সেখানে কর কেন কমানো হলো, কেন কর বাড়ানো হলো। যেমন আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ, স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলছি, কিন্তু কম্পিউটার, ল্যাপটপের আমদানি শুল্ক পুরোপুরি বাদ দিচ্ছি না। ইন্টারনেট ব্যবহারেও বাড়তি কর দিতে হচ্ছে।
আমি তো মনে করি, শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় যত উপকরণ আছে, সেটা কলম-পেনসিল, কালি, কাগজ, বই কোনোটার ক্ষেত্রেই শুল্ক থাকা উচিত নয়। আমরা যদি জ্ঞাননির্ভর সমাজ গড়তে চাই, তাহলে এসব ক্ষেত্রে শুল্ক তো দূরের কথা, আরও অনেক ভর্তুকি দেওয়া দরকার।
সর্বোপরি, বাজেটটা এমনভাবে করা প্রয়োজন, সেটা যেন জনবান্ধব হয়। একটা বিশেষ অর্থনৈতিক গোষ্ঠী যাদের প্রচুর টাকা ও প্রচুর সচ্ছলতা আছে, তাদের জন্য কর রেয়াত থাকার কোনো যুক্তি নেই। অর্থনীতিতে প্রগ্রেসিভ করব্যবস্থা নামে একটা টার্ম আছে। অর্থাৎ যাঁর আয় যত বেশি, আনুপাতিক হারে তিনি বেশি কর দেবেন। কিন্তু বাংলাদেশে তার উল্টোটা দেখি।
এখানে ভ্যাটের মতো পরোক্ষ করটা প্রাধান্য পায়। এ ধরনের কর ধনী–গরিব সবার জন্য সমান হারে প্রযোজ্য। তার মানে, একজন কপর্দকহীন বা খুবই স্বল্প আয়ের একজন কোনো পণ্য কিনলে যে পরিমাণ ভ্যাট দিতে হয়, একজন বিলিয়নারকেও সেই একই পরিমাণ ভ্যাট দিতে হচ্ছে। যেসব পণ্য গরিব মানুষেরা বেশি ব্যবহার করেন, কিংবা তাদের জন্য অত্যাবশ্যকীয়, সেসব পণ্যে ভ্যাট এভাবে রাখার যৌক্তিকতা কি?
আমরা দেখি যে সরকার প্রচুর খরচ করে। এই খরচের একটা বড় অংশ হলো অপচয় ও চুরি। যেহেতু এখানে এই অপচয়ের অর্থনীতি চলে আসছে, যেখান থেকে যত খুশি সম্ভব আয়ের রাস্তাও খোলা হচ্ছে। সে কারণেই করের জালকে আরও বিস্তৃত করা হচ্ছে। আবার অনেক মানুষ এখানে কর ফাঁকি দেয়।
প্রশ্ন হলো, মানুষ কেন কর ফাঁকি দেয়? যে মানুষ কর দেবে, তারও তো একটা মতামত আছে, তার করের টাকা কোথায় যায়, কীভাবে খরচ হয়, সেটা নির্ধারণে তার তো কোনো বক্তব্য নেই। তারা যখন দেখে, তাদের করের টাকায় কিছু লোক নবাবি করে বেড়াবে, অপচয় ও দুর্নীতি করবে—তারা কেন কর দিতে উৎসাহিত হবে?
● মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক