বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের ভাষাভঙ্গি ও উপস্থপনায় একধরনের দ্ব্যর্থবাচকতা লক্ষ্য করা যায়। কেউ এটিকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে নিতে পারেন; আবার কেউ ইতিবাচকভাবে।
গত রোববার নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে আয়োজিত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কাজী হাবিবুল আউয়াল বললেন, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক, সেটার চাপ বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য করার চ্যালেঞ্জ নিতে চায় কমিশন।
একই সঙ্গে সিইসি ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনী বিতর্ককে একটু লঘু করতে ইতিহাসের আশ্রয় নিলেন। বললেন, নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিতর্ক ও সমালোচনা হতে পারে। অতীতেও হয়েছে। ৫০,৬০, ৭০ বছরের ইতিহাস ঘাঁটলেও বিতর্ক পাওয়া যাবে। এমনকি ব্রিটিশ আমলের নির্বাচন নিয়েও কিছু কিছু বিতর্ক হয়েছে। তখন হয়তো মাত্রাটা কম ছিল।
সিইসির এ বক্তব্যের মধ্য থেকে পাঠক কী নির্যাস তুলে নেবে? তিনি ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক আছে, সেটি স্বীকারই করেননি, তা রেশ বর্তমান কমিশনকে বহন করতে হচ্ছে সেটাও দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিলেন।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা করার কথা। আর সেই অভিপ্রায় প্রকাশের উপযুক্ত উপায় হলো নির্বাচন। গ্রিক নগররাষ্ট্রে সব নাগরিককে ডেকে প্রতিনিধি বাছাই করা হতো। এখন সেটি সম্ভব নয় বলেই গোপন ব্যালটে প্রতিনিধি বাছাই করা হয়। এখন যদি আপনি বাছাই প্রক্রিয়ার আগেই কাউকে খারিজ করে দেন, তাহলে তো সেটি নির্বাচন বা ইলেকশন হবে না। বড় জোর সিলেকশন হতে পারে।
সিইসি ও তাঁর সহকর্মীরা যদি ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো নির্বাচনের আরেকটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে না চান, তাহলে তাঁদের উচিত হবে সব দলকে নিয়ে নির্বাচন করা। আর যদি সেটি না করতে পারেন, তাহলে অন্তত তাঁরা সংবিধান অনুযায়ী যে শপথ নিয়েছেন, সেই শপথের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে একতরফা নির্বাচনে অপারগতা প্রকাশ করতে পারেন।
আগে নির্বাচনের বড় বাধা হিসেবে দেখা হতো কালোটাকা ও পেশিশক্তিকে। বিশেষ করে বামপন্থীরা এই কথা জোরেশোরে বলতেন। এখন সেই পেশিশক্তির ভূমিকায় কারা আছেন, তাও নিশ্চয়ই নির্বাচনর কমিশন জানে। ইতিমধ্যে জামালপুর লাঙ্গলকোট ইত্যাদি স্থান থেকে আওয়াজ উঠেছে। ক্ষমতাসীন দল ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে কীভাবে আঁতাত গড়ে ওঠে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেখা গেছে গাইবান্ধা উপনির্বাচনে।
নির্বাচন কমিশন সিসিটিভির ফুটেজ বিবেচনায় নিয়ে সেই আঁতাত কেবল ভেঙে দেয়নি, নির্বাচনটিও স্থগিত করে দিয়েছিল। এরপরই ক্ষমতাসীন মহলে মহা শোরগোল শুরু হয়ে গেল। নির্বাচন কমিশনও কিছুটা পিছিয়ে এল। যাদের জন্য উপনির্বাচনটি স্থগিত ও বিতর্কিত হলো তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারল না। ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম’ নির্বাচন কমিশনের এই দুর্বলতা ও ব্যর্থতা স্বীকার করতে হবে। ইসি যদি আগামী জাতীয় নির্বাচনেও প্রতিটি আসনে গাইবান্ধা মডেল প্রয়োগ করে এবং ৩০ দিন ধরে ৩০০ আসনে নির্বাচন করে আইনগত কোনো বাধা নেই।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনী বিতর্কের চাপ অনুভব করছেন সিইসি। এটা যদি তাঁর ‘বাত কা বাত’ না হয়ে মনের কথা হয়, তাহলে ইসিকে এমন একটি নির্বাচন করতে হবে, যেখানে সেই বিতর্ক থাকবে না। ২০১৪ সালের নির্বাচন কেবল বিএনপি বর্জন করেনি; নিবন্ধিত ৩৯টি দলের মধ্যে মাত্র ১২টি নির্বাচনে অংশ নেয়। বাকি সব দলই নির্বাচনী মাঠের বাইরে ছিল।
আর ২০১৮ সালের নির্বাচনটি কেমন হয়েছে, সেটাই যেমন দেশের মানুষ জানেন, তেমনি জানেন ইসির পদাধিকারীরাও। কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘আমরা যে নির্বাচন করতে যাচ্ছি, সেটার একটা বিশেষ দিক হচ্ছে, অভিযোগ বা বিতর্কের মাত্রাটা একটু অতিরিক্ত। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের চাপটা এসে আমাদের ওপর পড়েছে, এই নির্বাচন কমিশনের ওপর পড়েছে। আমরাও নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছি...মানুষের যে...।’
প্রশ্ন হলো, ইসির এই নিরলস পরিশ্রম কাজে আসবে কি না? হ্যাঁ, কাজে আসবে তখনই, যখন তারা নির্বাচনীব্যবস্থায় বিশ্বাসী সব দলকে নিয়ে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারবে।
ইসিকে মনে রাখতে হবে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতি স্পষ্টভাবে দুই ভাগে বিভক্ত। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি পক্ষ চায় বর্তমান সরকারের অধীন নির্বাচন। বিএনপির নেতৃত্বে আরেকটি পক্ষের দাবি, নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন। সিইসি বহুবার বলেছেন, নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টি রাজনৈতিক। রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই এটি মীমাংসা করতে হবে। সেই সঙ্গে তিনি এ কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন, বিএনপির মতো একটি বড় দল নির্বাচনে না এলে সেটি অংশগ্রহণমূলক বা গ্রহণযোগ্য হবে না।
নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হলো জনগণের ভোটাধিকার রক্ষা করা। ২০১৯ ও ২০১৪ মার্কা নির্বাচন করে সেটা কখনোই সম্ভব নয়। ইসিকে মনে রাখতে হবে তরুণ প্রজন্ম, যারা ২০০৮ এর পর ভোটার হয়েছেন, তাদের বিরাট অংশ ভোট দিতে পারেননি। এখন ইসিকেই ঠিক করতে হবে তারা ১৯৮৮,১৯৯৬ (১৫ ফেব্রুয়ারি), ২০১৪, ২০১৮ মার্কা না সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করবেন। এসব নির্বাচন আইনিভাবে বৈধতা পেলেও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করেনি।
সিইসি বলেছেন, তাঁরা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনী বিতর্কের চাপে আছেন। নিশ্চয়ই এই চাপের দায় তাদের নয়। কিন্তু তারা চাপের মাত্রা বাড়াতে না চান তাদের অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি নির্বাচনই করতে হবে।
সিইসি ও তাঁর সহকর্মীরা যদি ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো নির্বাচনের আরেকটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে না চান, তাহলে তাঁদের উচিত হবে সব দলকে নিয়ে নির্বাচন করা। আর যদি সেটি না করতে পারেন, তাহলে অন্তত তাঁরা সংবিধান অনুযায়ী যে শপথ নিয়েছেন, সেই শপথের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে একতরফা নির্বাচনে অপারগতা প্রকাশ করতে পারেন।
সিইসি যে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ নিতে চাইছেন, সেটি বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোকে বাদ দিয়ে হতে পারে না। তাদের নিয়েই চ্যালেঞ্জটি নিতে হবে।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি