আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মতো জটিল জিনিসকে পানির মতো সহজ করে বোঝানো বিজ্ঞানী আইনস্টাইন যখন বলেন, ‘হার্ডেস্ট থিং ইন দ্য ওয়ার্ল্ড টু আন্ডারস্ট্যান্ড ইজ ইনকাম ট্যাক্স’, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে আয়কর জিনিসটা ‘ই ইজ ইকুয়াল টু এম সি স্কয়ার’–এর চেয়ে প্যাঁচের জিনিস।
আয়কর প্যাঁচের হলেও ঘ্যাঁচ করে তা জীবন থেকে কেটে বাদ দেওয়া যায় না। নাগরিক হিসেবে আয়কারীদের দায় আছে। তাই সায় থাকুক না থাকুক, তাঁদের আয়কর দিতে হয়। কারণ, করের ওপর ভর করে দেশ চলে। কিন্তু যেভাবে এনবিআর ‘ধার-উধার করে চলা যার তার মনে কর’–বিষয়ক ডর ধরিয়ে দিচ্ছে, তাতে আয় করতে ইচ্ছা হচ্ছে না। ব্যয় করাও ছেড়ে দিতে মন চাচ্ছে।
করদাতার কাছে এনবিআরের ‘জানিবার ইচ্ছা’ চিরকালই বড় উৎপাত। ‘পুরুষের বেতন আর নারীর বয়স জিজ্ঞাসা করতে হয় না’—এ কথার শেষাংশ মানলেও প্রথমাংশ এনবিআর মানে না। আয়-ব্যয়ের হিসাব চাওয়ার ক্ষেত্রে তার ‘চক্ষে পুরুষ–রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।’
কিন্তু এ বছর এনবিআর তথা সরকারের জানতে চাওয়ার ধরন মানতে চাচ্ছেন না করদাতারা। কারণ, জনগণের করের চেয়ে ঘরের খবর নেওয়ার ব্যাপারে সরকারকে বেশি আগ্রহী মনে হচ্ছে।
এক বছরে খোলা দিলে মুঠোফোনে কথা বলে কত টাকা ‘পুড়িয়েছি’, ফেসবুক-ইউটিউব নিয়ে ব্যস্ত থাকতে কত টাকার ইন্টারনেট প্যাকেজ ন্যস্ত করেছি, সব এনবিআরকে জানাতে হবে। কোন গলির দোকান থেকে কী বারে কয় টাকা রিচার্জ করেছি, সে তথ্যও ঢাকা রাখা যাবে না।
কোনো ধুনপুন না করে জুলাই টু জুন মুঠোফোনের খরচ দাখিল করতে হবে। পাই টু পাই হিসাব করার পর তা পইপই করে বুঝিয়ে দিতে প্রয়োজনে প্রতিবার রিচার্জের হিসাবও বুকপকেটের নোটবুকে টুকটুক করে টুকে রাখতে হবে।
নতুন আইন অনুযায়ী জীবনযাত্রার খরচের ৯ ধরনের তথ্য দিতে হবে। গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ বিলের সত্য তথ্যও দিতে হবে।
আপনার কত ধন আছে, আপনার কত ধান আছে, আপনার কত মান আছে, আপনি কার জামাই, আপনার কত কামাই, আপনার সামাজিক অবস্থান কী, আপনার সামাজিক অবস্থানের পেছনে ‘অসামাজিক আয়ের’ হাত আছে কি না, আপনার ওঠাবসা কার কার সঙ্গে, এনবিআর তার সব হিসাব দেখবে।
পরিবার নিয়ে ঘোরাঘুরির অভ্যাস থাকলে ঘটিবাটিসহ তারও খুঁটিনাটি জানাতে হবে। পরিবার নিয়ে সুন্দরবন থেকে বান্দরবান, পাথালিয়া থেকে তেঁতুলিয়া—যেখানেই ঘুরতে যান; কত খরচ করলেন, তা বছর শেষে জানাতে হবে। এমনকি ঢাকার আশপাশের রিসোর্টে ঘুরতে গেলেও তার রসিদ রাখতে হবে।
২.
চাষির পাকা ধান ইঁদুর-ঘুঘু-শালিক যেভাবে সরায়, সেই কায়দায় দেশের বড় বড় শিল্পগোষ্ঠী ও ব্যবসায়ী হাজার হাজার কোটি টাকা সিঙ্গাপুর, দুবাইসহ নানা জায়গায় সরিয়ে নিয়েছেন বলে নানা সময়ে খবর বেরিয়েছে। তাঁরা এই পয়সাকড়ির খবর এনবিআরকে জানাননি; বাংলাদেশ ব্যাংককেও জানাননি। সেই পয়সাকড়ি দিয়ে তাঁরা বিদেশের মাটিতে ধনী ব্যবসায়ী হিসেবে তকমাও পাচ্ছেন।
এমনকি আদালত কর্তৃক কারও দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ঠিকই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন, এমন ঘটনাও ভূরি ভূরি। যদিও দুর্মুখেরা বলে থাকেন, তাঁদের পালিয়ে যেতে যাবতীয় ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এ নিয়ে সেসব শিল্পগোষ্ঠী বা ব্যবসায়ীর কাছে কেউ তেমন কিছু জানতেও চাননি। এ রকম অনেকের কাছেই কোনো কিছু জানতে চাওয়া হয় না। কিন্তু ‘ভরপেট না–ও খাই, রাজকর দেওয়া চাই’ মার্কা করদাতাদের হাঁড়ির ও নাড়ির খবর এনবিআরের জানতেই হয়। এই অনিয়মই নিয়ম তথা আইন। আইন না মানলে কড়া ফাইন হবে। তাই আসুন, আইন মানি। মানার আগে জানি। কারণ, বাঁচতে হলে জানতে হবে।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
[email protected]