চলে গেলেন ভাষাসংগ্রামী, সংস্কৃতি ও মুক্তমনা নারী সংগঠক জওশন আরা রহমান। তাঁর মৃত্যুসংবাদ শুনে মনটা দুঃখে ভরে গেল। গত ১১ জুলাই, ২০২৪ রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে দুপুর সাড়ে ১২টায় তিনি মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। বনানী কবরস্থানে স্বামী প্রয়াত ভাষাসংগ্রামী মাহবুব উল আলম চৌধুরীর কবরে তাঁকে শায়িত করা হয়েছে।
কবি ও সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ‘কাঁদতে আসিনি—ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ একুশের প্রথম কবিতা। তাঁরা ১৯৫২ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক চর্চায় এ দম্পতি ছিলেন এক বৃন্তে দুটি ফুলের মতো। তিনি একটি কন্যাসন্তানের জননী। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে স্বামী, কন্যাসহ গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। জওশন আরা রহমান ছিলেন একজন অগ্রপথিক। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যেসব শীর্ষ নারী ষাট দশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি ছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রথম সারির। তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
জওশন আরা রহমানের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৯ অক্টোবর চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলার চুনতী গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুনসেফ পরিবারে। তাঁর ডাকনাম বুলবুল। বাবা ছিলেন চট্টগ্রামের জেলা রেজিস্ট্রার মাহবুবুর রহমান ও মা সাদীদা খানম। তিনি আট ভাইবোনের মধ্যে সপ্তম ছিলেন। তাঁর লেখা স্মৃতিকথা থেকে বোঝা যায় তাঁর পরিবার থেকে গ্রথিত মূল্যবোধ। ‘শৈশবে ফিরে আসি। তখন আমরা একটা ভাড়া বাসায় থাকতাম। পরবর্তীকালে পৈতৃক ভিটায় আব্বা টিনের ছাউনি দেওয়া একটি বেড়ার ঘর বানিয়ে ছিলেন। রুমঘাটার আত্মীয়রা বলতেন, এত দিন সরকারি চাকরি করেও সাবরেজিস্ট্রার সাহেব একটি পাকা বাড়ি বানাতে পারেননি। আব্বা উত্তরে বলতেন, আমার আটটি অট্টালিকা (তাঁর সন্তানসন্ততি) আছে। আমার দালানবাড়ির দরকার নেই।’
একজন বিদুষী ও ধ্রুপদি মানুষ ছিলেন জওশন আরা রহমান। নিজের দেশ, সংস্কৃতি এবং মানুষকে ভালোবেসেছেন। তিনি প্রতি শনিবার বিকেলে এবং রোববার স্কুলের সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বিখ্যাত শিল্পী কলিম শরাফীর কাছে রবীন্দ্রসংগীত শিখতেন। ১৯৫২ সালে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে প্রতিভা মুৎসুদ্দীর নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৫২ সালে চট্টগ্রামের ডাক্তার খাস্তগীর গার্লস হাইস্কুল থেকে বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পাস করেন।
তখন ১৯৫৪ চট্টগ্রামে নারীদের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নারী সমিতি নামের একটি সংগঠন কাজ করত। এই সংগঠনের পক্ষে বিভিন্ন ইস্যুতে চট্টগ্রাম কলেজের কাছে রাস্তার ধারের দেয়ালে পোস্টার লাগিয়ে ছিলেন। সম্ভবত মেয়েদের দিয়ে রাস্তায় পোস্টার লাগানো চট্টগ্রামে এই প্রথম।
তিনি ১৯৫৫-৫৬ সালে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। চট্টগ্রাম কলেজে ‘বিএ’ পড়ার সময় সেই ১৯৫৭ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালে কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিন ‘অন্বেষা’ সম্পাদনা করেন। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি স্নাতক করেন। ১৯৬০ সালে জওশন আরা সরকারের সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা হিসেবে সরকারি চাকরিজীবন শুরু করেন। ১৯৬৪-৬৫ সালে চাকরিরত অবস্থায় নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটন শহরে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা এবং ১৯৬৭ সালে ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ থেকে স্নাতকোত্তর করেন। পরে ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তৎকালীন ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার থেকেও স্নাতকোত্তর করেন।
পরে সেই চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি ইউনিসেফ বাংলাদেশের চিফ অব উম্যান ডেভেলপমেন্ট বিভাগে যোগ দেন। ১৯৭৯ সালে জওশন আরা ইউনিসেফের মহিলা কর্মসূচির প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে তিনি প্ল্যানিং ও মনিটরিং বিভাগেরও প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি ইউনিসেফের চিফ অব প্রোগ্রাম প্ল্যানিং পদে কাজ করেন। ইউনিসেফ বাংলাদেশ থেকে জওশন আরার উদ্যোগেই সব দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের নিয়ে নারী উন্নয়নের জন্য একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়েছিল। সেই নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক ছিলেন তিনি। ওই নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নারী উন্নয়ন বিষয়ে ‘ম্যাক্রো অধ্যায়’ সম্পৃক্ত করার জন্য জওশন আরা একটি প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। এভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নারী উন্নয়ন ‘ম্যাক্রো অধ্যায়’ সম্পৃক্ত হয়। সময়ের পরিক্রমায় সেই ধারাবাহিকতায়, এখন জেন্ডার বাজেটিংয়ের বিষয়গুলো গুরুত্ব পাচ্ছে। নারীদের এগিয়ে নিতে এই অজানা মেয়েটির দৃষ্টির অনবদ্য অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই সুদীর্ঘ কর্মজীবনের পথপরিক্রমায় জওশন আরা রহমান একাগ্রচিত্তে সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন।
বেইজিংয়ে বিশ্ব নারী সম্মেলন প্রস্তুতিতে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। সিডও সনদ বাস্তবায়ন ও বেইজিং প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন কার্যকর করার ব্যাপারে জওশন আরা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে কাজ করেছেন। ইউনিসেফ থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি রয়েল ড্যানিশ এম্বাসির টেকনিক্যাল উপদেষ্টা হিসেবে শিশু অধিকার ফোরামের সঙ্গে কাজ করেন। অবসরে যাওয়ার আগে কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সিতে (সিআইডিএ) কর্মরত ছিলেন। গণ বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন।
নারীর ক্ষমতায়নে তাঁর অবদান অনেক। নারী উন্নয়ননীতি কার্যকরের ক্ষেত্রে অনন্য এক নীতিনির্ধারক ছিলেন তিনি। নব্বইয়ের দশকে এ দেশে ‘হাতে অর্থ পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে নারীকে স্বাবলম্বী করা’র এক অভাবনীয় কৌশল তৈরিতে ভূমিকা রেখেছিলেন।
জওশন আরা বুলবুল খালার আমার প্রয়াত মা, ঘাসফুল প্রতিষ্ঠাতা শামসুন্নাহার রহমান পরাণের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল। ওনার মেয়ে মুন্নীর সঙ্গে আমি চট্টগ্রামের অপর্ণা চরণ বালিকা বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে একসঙ্গে কিছুদিন পড়েছি। তিনিই সম্ভবত সেই সময়ে আমার দেখা প্রথম অফিসে পদধারী কর্মজীবী মা। খালা প্রতিদিন টিফিন ব্রেকের আগেই একটি বড় টিফিন ক্যারিয়ারে মুন্নীর জন্য টিফিন নিয়ে আসতেন এবং স্কুল গেটে অপেক্ষা করতেন। ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’–এর বোর্ডে আমার ওনার সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে। ২০১৫ সালে আম্মার মৃত্যুর পর তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হয়। তিনি আম্মার জন্য লিখেছিলেন। প্রায়ই ফোনে কথা হতো। পরে শ্রবণশক্ত দুর্বল হওয়াতে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করতেন। সুন্দর আর্টিকেল শেয়ার করতেন। প্রতি মেসেজে তিনি লিখতেন। আমার প্রিয় বন্ধু পরাণ। তিনি আমাকে অনেক উৎসাহ দিতেন, কাজকর্ম নিয়ে জানতে ভালোবাসতেন। আমার মেয়ে জেরীনের কাজ নিয়েও আগ্রহ ছিল। আম্মা বেঁচে থাকাকালীন ওনার সমসাময়িক বন্ধু এবং সামাজিক ও নারী উন্নয়নের কর্মযজ্ঞের সহযাত্রীদের আমার বাসায় নিমন্ত্রণ করার কথা ভাবছিলাম। আমার মেয়ে জেরীন মাহমুদ হোসেন শুনে পরামর্শ দিল, আমরা একটু বড় পরিসরে তিন প্রজন্মের একটি মিলনমেলা করব। সেখানে তাঁর নানুর, মায়ের এবং তাদের প্রজন্মের মেয়েরা থাকবে। উত্তরসূরিরা তাঁদের জীবনের পথচলার গল্প শোনাবেন। বিভিন্ন প্রজন্মের মধ্যে ভাবের আদান–প্রদান হবে। আম্মা বেঁচে থাকতে সেটা করা হয়ে ওঠেনি। পরবর্তী সময়ে ২০১৬ সালে আমার বাসায় তিন প্রজন্মের সেই মিলনমেলা করেছিলাম। সেখানে জওশন আরা রহমান, মালেকা খান, সালমা খান, সুলতানা কামাল, খুশী কবির, পারভীন হাসান, ইরিনা ভট্টাচার্য্য, আরমা দত্ত, রাশেদা কে চৌধূরী, ড. রওনক জাহানসহ অন্যদের উপস্থিতিতে অপার আনন্দঘন অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেখানে উপস্থিত অগ্রপথিকদের সেই যুগের শত বাধা, প্রতিকূলতা অতিক্রম করে জীবনের জয়রথ এগিয়ে নেওয়ার গল্প সবাইকে দারুণভাবে আলোড়িত করে, উদ্দীপ্ত করে নতুন প্রজন্মকে। বিশেষ করে জওশন আরা বুলবুল খালার কথা জেরীনকে আন্দোলিত করে, সেই ক্ষণে তার মধ্যে ‘হার স্টোরি’ প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা জাগে এবং পরবর্তী সময়ে মেয়েদের ‘সুপার গার্লদের’ গল্প শোনানো, সচেতন করা, আত্মবিশ্বাস উজ্জীবিত করার জন্য হার স্টোরি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে।
জওশন আরা রহমান মনে করতেন, তাঁর সেই আরাধ্য কাজে কিছুটা হলেও অগ্রগতি হয়েছে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত স্তরের নারীরা উন্নয়নের আওতায় এসেছে। তবে নীতিনির্ধারণীতে সেভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা উচ্চ আসনে নারীর অবস্থান উল্লেখযোগ্য নয়। তাঁর মতে, তিনিসহ পূর্বসূরিরা নারীকে মূলধারায় আনতে যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, তা চলমান। ভবিষ্যতে এই ধারা অব্যাহত থাকলে তবেই নারীকে নীতিনির্ধারণের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।
তিনি গৌরবের ভাষা আন্দোলন এবং তাঁর নিজের অংশগ্রহণ, দীর্ঘ কর্মময় জীবন নিয়ে লিখেছেন ‘স্মৃতিকথা একটি অজানা মেয়ে’ এবং তাঁর ইংরেজি অনুবাদ ‘অ্যান আননোন উইমেন’ নামে একটি আত্মজীবনী। সেই বইয়ে তিনি তাঁর জীবন, কর্ম এবং জীবনের উল্লেখযোগ্য স্মৃতি গেঁথে রেখেছেন পরম মমতায়। তাঁর লেখা বই বিশ শতকের নারীদের জীবনব্যবস্থারই প্রতিচ্ছবি। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে, ‘মাহবুব উল আলম চৌধুরী স্মরণে বরণে’ উল্লেখযোগ্য।
ওনার আত্মজীবনী বইটিতে তিনি নিজের আত্মমূল্যায়নে বলেছেন,
‘আমি লেখাপড়ায় অত্যন্ত সাধারণ ছিলাম। কিন্তু কঠোর পরিশ্রম করে মেধাকে খাটিয়ে যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তা আমার জীবনে বারবার অনুভব করেছি। নিজের প্রচেষ্টার সঙ্গে শিক্ষকদের এবং নিকট আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতাও অপরিহার্য।’
তাঁর মধ্যে ছিল অপার স্বপ্ন, অসীম দৃঢ়তা। ষাট দশকের সেই সময়ে, বিশেষ করে চট্টগ্রামে ছোট্ট সন্তান রেখে একজন বিবাহিতা তরুণীর উচ্চতর পড়াশোনার জন্য একা বিদেশযাত্রা, অনেক দৃঢ় মনোবলের ও প্রত্যয়ের পরিচয়। সেই সঙ্গে অবশ্যই ওনার উদারমনা স্বামীকে কৃতিত্ব দিতে হবে।
তাঁর স্মৃতি, জীবন ও কর্ম আগামী প্রজন্মকেও উদ্বুদ্ধ করবে—এ আমাদের কামনা।
আল্লাহ তাঁকে বেহেশত নসিব করুন।
● পারভীন মাহমুদ সমাজকর্মী