ভোট দিতে পারবেন—এমন একটি নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছেন বাংলাদেশের মানুষ। গত দুটি নির্বাচনে তাঁরা সেই সুযোগ পাননি। তবে সামনের নির্বাচনে সেই সুযোগ পাওয়া যাবে—এমন আশা করার মতো কোনো পরিস্থিতিও তৈরি হয়নি। কিন্তু ‘ভোট হবেই’—এমন প্রস্তুতি নিয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশন এগোচ্ছে। বিএনপি যদি এই সরকারের অধীন শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে না যায় এবং নির্বাচন ঠেকাতেও না পারে, তবে ২০১৪ সালের জানুয়ারির মতোই আরও একটি নির্বাচন দেখতে হবে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে। তেমন কিছু হলে আবারও ভোট দেওয়ার সুযোগ হারাতে পারেন জনগণ।
নির্বাচনকে সম্ভবত জনগণের কাছে মূল্যহীন অথবা নির্বাচনে জনগণকেই মূল্যহীন করে তোলা হচ্ছে। কিন্তু এতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়টি ‘মূল্যহীন’ হয়ে পড়ছে না। নির্বাচন সব বিবেচনাতেই একটি খরুচে আয়োজন এবং তা বেড়েই চলেছে।
আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানে নিজেদের খরচের একটি হিসাব করেছে নির্বাচন কমিশন। তাদের হিসাবমতো এই খরচ দাঁড়াবে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি। এই সপ্তাহে খরচের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। তবে তাতে পার্থক্য নিশ্চয়ই আকাশ-পাতাল হবে না। নির্বাচন কমিশনের সূত্র বলেছে, এই খরচের ৬০ ভাগ খরচ হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পেছনে। বাকি ৪০ ভাগ নির্বাচন পরিচালনার খরচ। এখানে একটি তথ্য উল্লেখ করা জরুরি এবং তা হচ্ছে, ২০১৮ সালের নির্বাচনের জন্য কমিশনকে বরাদ্দ করা হয়েছিল ৭০০ কোটি টাকা। মানে আগামী নির্বাচনে কমিশন খরচ করতে চায় গত নির্বাচনের দ্বিগুণের বেশি।
ভোটের আগে ডিসি ও ইউএনওদের নতুন গাড়ি দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার, সেটাও নির্বাচনেরই খরচ। গাড়ি দেওয়া হবে ২৬১টি, খরচ পড়বে ৩৮১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ভাষায়, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যই এই গাড়ি দরকার। আইনমন্ত্রীর কাছ থেকেও আমরা এর ব্যাখ্যা পেয়েছি। তিনি বলেছেন, গাড়ি কেনা বন্ধ রাখার জন্য সরকারের একটি নিষেধাজ্ঞা ছিল। নির্বাচনের প্রয়োজনে তা শিথিল করা হয়েছে বলেই গাড়ি কেনার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এটা অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণ, যাঁদের (ডিসি ও ইউএনও) এসব গাড়ি দেওয়া হচ্ছে, তাঁরা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য।
নির্বাচনের আগে ভোটের সঙ্গে জড়িত এই সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ি দেওয়ার বিষয়টি তাঁদের কাছে ‘নির্বাচনী উপহার’ হিসেবেই বিবেচিত হবে। ২০১৮ সালের নির্বাচন, যা ‘রাতের ভোট’ নামে পরিচিতি পেয়েছে, তা আয়োজনে মাঠপর্যায়ের প্রশাসন কী ভূমিকা রেখেছিল, তা গোপন কিছু নয়। এর প্রতিদান দেওয়া ও আগামী নির্বাচনের আগে তাঁদেরকে খুশি রাখা সরকারের নিজের স্বার্থেই জরুরি। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি যেন কারও মধ্যে ভয় না ধরায়, সে জন্যও তো প্রণোদনা দরকার।
সরকারবিরোধী বা সমালোচকেরা অবশ্য এসব ব্যাখ্যা মানতে চাইবেন না। নির্বাচনের আগে ভোটের সঙ্গে জড়িত এই সরকারি কর্মকর্তাদের গাড়ি দেওয়ার বিষয়টি তাঁদের কাছে ‘নির্বাচনী উপহার’ হিসেবেই বিবেচিত হবে।
২০১৮ সালের নির্বাচন, যা ‘রাতের ভোট’ নামে পরিচিতি পেয়েছে, তা আয়োজনে মাঠপর্যায়ের প্রশাসন কী ভূমিকা রেখেছিল, তা গোপন কিছু নয়। এর প্রতিদান দেওয়া ও আগামী নির্বাচনের আগে তাঁদেরকে খুশি রাখা সরকারের নিজের স্বার্থেই জরুরি। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি যেন কারও মধ্যে ভয় না ধরায়, সে জন্যও তো প্রণোদনা দরকার।
বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। অর্থনীতিবিদেরা এ নিয়ে ক্রমাগত তাঁদের উদ্বেগ প্রকাশ করে যাচ্ছেন। বলছেন, রিজার্ভ পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ। ডলার–সংকটের কারণে গত বছরের তুলনায় আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলার পরিমাণ ১৮ ভাগ কমেছে। ঋণপত্র নিষ্পত্তি কমেছে ২২ ভাগ। বিলাসদ্রব্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। কিন্তু এসব করেও রিজার্ভ রক্ষা করা যাচ্ছে না। ডলারের অভাবে ব্যবসায়ীরা দরকারি পণ্য বা কাঁচামালের ঋণপত্র খোলা নিয়ে ঝামেলায় পড়ছেন—এসব খবর সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই চোখে পড়ে। কিন্তু সাধারণ মানুষের সমস্যার খোঁজখবর রাখে কে? আপনি বিদেশ যাবেন, হাজারখানেক ডলার দরকার, চেষ্টা করে দেখুন তো এটা জোগাড় করতে কতটা কাঠখড় পোড়াতে হয়!
ডলার নিয়ে যখন এই হাহাকার দশা, তখন ডিসি ও ইউএনওদের জন্য কেনা হচ্ছে ‘স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকেল’। আইনমন্ত্রীর ভাষায় সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য ‘অত্যন্ত’ প্রয়োজনীয় এই গাড়িগুলোর প্রতিটির দাম দেড় কোটি টাকার মতো। অর্থসংকট সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক যে বাড়তি টাকা ছাপিয়ে চলেছে, তা দিয়ে এসব গাড়ি কেনা সম্ভব নয়। এর জন্য দামি ডলারে হাত দিতে হবে।
এখন সমালোচকেরা যদি একে ডিসি-ইউএনওদের ‘খুশি’ করতে সরকারের মরিয়া চেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করে, তবে কি তা খুব অযৌক্তিক হবে? গাড়ি কেনার নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে, ঝুঁকিপূর্ণ রিজার্ভের অর্থ খরচ করে এই গাড়িগুলো কেন কিনতেই হবে? সরকার যে নির্বাচন করার দিকে এগোচ্ছে, তার জন্য এই গাড়িগুলো কতটা জরুরি?
সরকার যেভাবে নির্বাচন করতে চাইছে, তার আরও অনেক ‘মূল্য’ আছে। এটা শুধু নির্বাচন কমিশনের দেড় হাজার কোটি টাকা বা ডিসি-ইউএনওদের গাড়ি কেনার জন্য রিজার্ভের ৩৮১টি কোটি টাকার যোগফল নয়।
এই নির্বাচনে যদি বিএনপিকে না আনা যায়, তবে তারা যে মাত্রাতেই হোক, এই নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা করবে। আর সরকারও নিশ্চয়ই বসে থাকবে না। এর ফলাফল হচ্ছে সংঘাত ও সহিংসতা। এবং নিশ্চিতভাবেই এতে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হবে। মালের ক্ষতির আর্থিক হিসাব-নিকাশ হয়তো করা যাবে, কিন্তু যদি জানের ক্ষতি হয়, তবে তার ‘মূল্য’ আমরা কীভাবে হিসাব করব?
২০১৪ সালের মতো আরেকটি নির্বাচনের দিকে এগোতে থাকার অর্থ হচ্ছে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা এই নির্বাচন থেকে দূরে থাকবেন। একতরফাভাবে নির্বাচনটি হয়ে গেলে তৃতীয়বারের মতো একটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যাবে দেশ। নেপাল ও মালদ্বীপ— দক্ষিণ এশিয়ার এই দুটি দেশে জাতীয় নির্বাচন হয়েছে গত বছর নভেম্বর এবং এ বছরের সেপ্টেম্বরে। এই নির্বাচন দুটি নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
আগামী বছরের জানুয়ারিতে পাকিস্তানে নির্বাচন হওয়ার কথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে, আর বছরের মাঝামাঝি হওয়ার কথা ভারতে। নির্বাচন কীভাবে হবে তা নিয়ে ভারত বা পাকিস্তানে কোনো বিরোধ বা বিতর্ক নেই।
দক্ষিণ এশিয়ায় নির্বাচন নিয়ে সম্ভবত সবচেয়ে সমস্যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। গত দুটি অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং সামগ্রিকভাবে দেশের গণতন্ত্রের পরিসর সংকুচিত হওয়ায় বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে এখন ‘আংশিক মুক্ত’ বা ‘হাইব্রিড গণতন্ত্র’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
২০১৪ সালের মতো আরেকটি নির্বাচন হলে বাংলাদেশ আর গণতান্ত্রিক দেশগুলোর কাতারে থাকবে কি না, সেটা এক বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াবে। যে দেশগুলোর সঙ্গে তখন বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হবে, তা বাংলাদেশের অবস্থানকে কোথায় নিয়ে যাবে! এই মর্যাদাহানির ‘মূল্য’ কত?
এবারের নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যভাবে আয়োজনের জন্য বেশ আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের দেশগুলো একটি কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ভিসা নীতিসহ তাদের বিভিন্ন তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে ব্যর্থ হলে নির্বাচনের পর নতুন চাপে পড়তে পারে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এসব দেশের ওপর নির্ভরশীল। সেদিক থেকে কোনো চাপ এলে অর্থনৈতিকভাবে এমনিতেই নানা চ্যালেঞ্জের মুখে থাকা বাংলাদেশ আরও বিপদে পড়বে। এর ‘মূল্য’ বেশ চড়া হতে পারে।
তবে এবারও যদি ভোট দিতে না পারেন, তবে সবচেয়ে বড় ‘মূল্য’টি দেবেন সম্ভবত বাংলাদেশের জনগণ। ভোটের অধিকার ছাড়া যে প্রজন্ম বেড়ে উঠছে, তাদের মনে যে ক্ষোভ, হতাশা ও হাহাকার তৈরি হবে, তার ‘মূল্য’ সত্যিই অপরিমেয়।
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক