মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে সম্প্রতি লাশ হয়ে দেশে ফিরেছেন বাংলাদেশের একজন শিক্ষার্থী। তাঁর মরদেহ তোলা হয় নদী থেকে। প্রথমে মনে করা হয়েছিল নদীতে ডুবেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও এমনটি জানায় ওই শিক্ষার্থীর পরিবারকে। কিন্তু একটি ভিডিও ফুটেজ দেখার পর শিক্ষার্থীর পরিবার এই মৃত্যুকে মেনে নিতে পারছে না। তাঁরা অভিযোগ তুলেছেন, র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। প্রায় বিবস্ত্র করে শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের ভিডিওটি ইউটিউব এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এই ঘটনার মাসখানেক আগে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় ভর্তি হওয়া এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয় র্যাগিংয়ের কারণে। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে তাঁকে র্যাগ দেওয়া হয় বিবস্ত্র করে। ওই শিক্ষার্থীর পরিবারের অভিযোগ, এরপর তাঁকে তিনতলার বারান্দা থেকে ফেলে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। দ্রুত তদন্ত শেষ করে ৪ জন ছাত্রকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে এবং ৬৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেয়। তা ছাড়া হত্যার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ও বর্তমান ১৩ জন শিক্ষার্থীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও সাম্প্রতিককালে র্যাগিং ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কিছুদিন আগে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী র্যাগিংয়ের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের অন্তত ১৫ জন শিক্ষার্থী প্রথম আলোর প্রতিনিধির কাছে তাঁদের ভোগান্তির কথা তুলে ধরেন। এর মধ্যে একজনকে ‘ফুলহাতা জামার হাতা গুটিয়ে রাখা’র অপরাধে পাঁচ ঘণ্টা আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন তাঁর বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীরা। মাস চারেক আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের একই ব্যাচের ১২ জন শিক্ষার্থীকে একসঙ্গে রাতে জঙ্গলে নিয়ে র্যাগ দেওয়া হয়। প্রাণিবিদ্যা বিভাগেরই আগের ব্যাচের শিক্ষার্থীরা নানা কায়দায় তাঁদের নির্যাতন করেন।
নতুন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার নামে এবং তাঁদের আদবকেতা শেখানোর বাহানায় প্রায় অবাধে র্যাগ দিয়ে থাকেন পুরাতন শিক্ষার্থীরা। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি কালচার বা রীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। অর্থাৎ আজ যাঁরা র্যাগিংয়ের শিকার হন, কাল তাঁরাই র্যাগ দেওয়ার ‘যোগ্যতা’ অর্জন করেন। এভাবেই বছরের পর বছর ধরে ‘র্যাগিং কালচার’ শিক্ষার্থী-পরম্পরায় চলে আসছে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা প্রায় ক্ষেত্রেই এসব নির্যাতনের কথা বাইরে প্রকাশ করেন না। বিভিন্ন সময়ে তদন্ত করতে গিয়ে শিক্ষকেরা দেখেছেন, শিক্ষার্থীরা নির্যাতিত হয়েও ভয়ে মুখ খুলতে চান না।
নির্যাতনের ঘটনা অধিকাংশ শিক্ষার্থী তাঁদের পরিবারের কাছেও গোপন রাখেন। তাঁদের বয়সটাই এমন যে র্যাগিংয়ের ঘটনা অভিভাবকদের জানিয়ে তাঁরা নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে চান না। তা ছাড়া মাত্র এইচএসসি পাস করা শিক্ষার্থীরা বুঝে উঠতে পারেন না এ ক্ষেত্রে কী করা উচিত। ফলে প্রতিনিয়ত অস্বস্তি ও আতঙ্কের মধ্য দিয়ে তাঁদের যাত্রা শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে আগস্টের মাঝামাঝিতে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও কাছাকাছি সময়ে ক্লাস শুরু হয়েছে। এই দেড় মাসে নতুন করে কত শিক্ষার্থী র্যাগিংয়ের শিকার হলেন, তার পরিসংখ্যান বোধ করি কারও পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।
র্যাগিংয়ের নানা কৌশল রয়েছে। গালিগালাজ করা, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা, অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছু খাওয়ানো, জোর করে অস্বস্তিকর কাজ করানো, যৌন হয়রানি করা, টাকা কেড়ে নেওয়া—এগুলো র্যাগিংয়ের প্রধান কৌশল। এসব কৌশলের মধ্যে আবার নানা ধরন রয়েছে। যেমন ‘মুরগি’ বানিয়ে বসিয়ে রাখা, ম্যাচের কাঠি দিয়ে ঘরের ক্ষেত্রফল বের করতে দেওয়া, অশ্লীল ভঙ্গিতে নাচগান করানো ইত্যাদি। এ ছাড়া নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবনের চেষ্টা তো আছেই। হাল আমলের অধিকাংশ র্যাগিংয়ে নগ্ন করে ভিডিও ধারণ করার এবং শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া র্যাগ দেওয়ার মাধ্যমে পুরাতন শিক্ষার্থীরা নতুন শিক্ষার্থীকে নানা রকম নিয়ম পালন করতে বাধ্য করেন।
র্যাগিংয়ের কারণে অনেক শিক্ষার্থী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। কিছু শিক্ষার্থী স্থায়ীভাবে শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। সবচেয়ে বড় কথা, র্যাগিংয়ের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে নবাগত শিক্ষার্থীদের বিরূপ ধারণা তৈরি হয়। তাঁদের কেউ কেউ পড়াশোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। অথচ মেধার স্বাক্ষর রেখেই এসব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। অনেকে নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী লিখিত অভিযোগ দিয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যান। গত চার বছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত চারজন শিক্ষার্থী এভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। দেশের অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও এটা ঘটে চলেছে।
২০২০ সালের একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট সিদ্ধান্ত দেন, র্যাগ দেওয়াকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে। র্যাগিংয়ের অপরাধে তাই ফৌজদারি আইনে মামলা হতে বাধা নেই। একই সঙ্গে আদালত দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংবিরোধী কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। এই কমিটির কাজও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, র্যাগিংয়ের শিকার হওয়া শিক্ষার্থীদের জরুরি ভিত্তিতে সহায়তা করা এবং দ্রুত তাঁদের সমস্যার প্রতিকার করা। কিন্তু অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংবিরোধী আলাদা কমিটি নেই। এমনকি ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা জানেনও না কোথায় বা কার কাছে অভিযোগ দিতে হবে।
সপ্তাহখানেক আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীন শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, কাউকে র্যাগ দেওয়া হলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু বাস্তবে র্যাগিংয়ের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অসহায় মনে হয়। কোনোভাবেই র্যাগিং কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। পত্রপত্রিকায় ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রবলভাবে আলোচিত ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রেই কেবল ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়। অথচ প্রতিটি ক্ষেত্রে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হলে র্যাগিং শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব ছিল। কানাডা ও জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শাস্তি ও বিধিনিষেধ আরোপ করেই র্যাগিং বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে।
র্যাগিংয়ের আরেকটি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে আছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতারা। তাঁরা শুরুতেই ভয় দেখিয়ে ও নির্যাতন করে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। এরপর তাঁদের দলীয় মিছিলে যেতে বাধ্য করেন। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে এসব ছাত্রনেতা নতুন শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়া ও চলাফেরার ব্যাপারে নানা রকম বিধিনিষেধ আরোপ করে থাকেন। মওকা পেলে ছাত্রনেতাদের অত্যাচার কোন পর্যায়ে যেতে পারে, এর দৃষ্টান্ত বুয়েটের আবরার ফাহাদ কিংবা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলপরী খাতুন। একজন চিরতরে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন, আরেকজন বিচার পেয়ে লেখাপড়ায় ফিরতে পেরেছেন।
তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক