শনিবার। ২৫ মার্চ ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ। ৯ চৈত্র ১৪২৯ বঙ্গাব্দ। ২ রমজান ১৪৪৪ হিজরি। এই তারিখের ‘রেডিও চিলমারী’র এক দিনের অনুষ্ঠানসূচি নিচে দেওয়া হলো।
বেলা ২টা ১০ মিনিটে ভক্তিমূলক গানের অনুষ্ঠান ‘তীরের কান্ডারি’►বেলা ২টা ৩০ মিনিটে নাটক ‘আপন–পর’। বেলা ৩টা ৩০ মিনিটে প্রতিদিনের লাইভ ম্যাগাজিন ‘পাঁচফোড়ন’ (এটাতে আজকের এই দিনে ইতিহাস, স্বাস্থ্য টিপস, বিজ্ঞান, গান ও কৌতুক), বিকেল ৪টায় পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষে প্রতিদিনের নিয়মিত ইসলামি অনুষ্ঠান ‘আলোর পথে’। (ইসলামি জীবনব্যবস্থা), বিকেল ৪টা ৩৫ মিনিটে তৃণমূল মানুষের আইনগত অধিকার, সচেতনতা ও আইনি সহায়তাবিষয়ক রেডিও অনুষ্ঠান ‘আইন ও আলাপ’। আজ শুনবেন ম্যাগাজিনের ১২১তম পর্ব। বিকেল ৪.৫৫ মিনিটে ‘জাতীয় সংবাদ’।►পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াত ও তার বাংলা তরজমা শুনতে পাবেন বিকেল ৫টা ৫ মিনিটে। সন্ধ্যা ৬টায় ‘উন্নয়ন সংবাদ’। সন্ধ্যা ৬টা ৫ মিনিটে পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াত।
এটি ছিল রমজান মাসের অনুষ্ঠানসূচি। বাকি মাসের সঙ্গে শুধু তফাত ভক্তিমূলক গানের জায়গায় হয় ভাওয়াইয়া গানের আসর। কিন্তু দুটিতে মিল যে জায়গায়, তা হলো প্রচারিত গানগুলো কম্পিউটারের সংরক্ষিত গান। স্থানীয় জীবিত শিল্পীদের সরাসরি বা রেকর্ড—কোনোটিই নয়। স্থানীয় শিল্পীদের বিকাশে কমিউনিটি রেডিওর ভূমিকা শূন্য। তাহলে সরকার–ঘোষিত নব–উদ্যোগে সৃজনশীল কার্যক্রম নিয়ে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের শিক্ষা, সংস্কৃতি, মানবিক মূল্যবোধ, সচেতনতা–সংস্কৃতি উন্নয়ন ও বিকাশে কতটুকু ভূমিকা পালন করে আসছে?
‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে’। সেই চিলমারীতে অবস্থিত রেডিও চিলমারী ভাওয়াইয়ার বিকাশে কতটুকু ভূমিকা পালন করছে, তা আলোচনা করা যাক। বাংলাদেশ ভাওয়াইয়া একাডেমির ভূপতিভূষণ বর্মা, আনোয়ারুল ইসলাম, মজনু মিয়া, ভবতরণ বর্মণসহ অন্য শিল্পীদের প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা রাখতে কতটুকু পেরেছে, এটি প্রশ্নসাপেক্ষ। তার বদলে ঢাকা ও কলকাতা মহানগরের মৃত শিল্পীদের কদরই যেন বেশি। রেডিও চিলমারী কেন চিলমারীর শিল্পীদের হলো না?
নাটক ছাড়া আর কোনো অনুষ্ঠানই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষায় প্রচারিত হয় না। তাহলে যে বলা হলো, সমাজের তৃণমূল পর্যায়ের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠীর জন্য নিবেদিত বেশ কিছু বেতারকেন্দ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষায় তাদের অংশগ্রহণ ও ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হচ্ছে, তা হচ্ছেটা কোথায়?
চতুর্দিকে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত রেডিও চিলমারীর আওতায়। এতে ৪০ লাখ জনগণের বাস। একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, রেডিও চিলমারীর শ্রোতার সংখ্যা ৫ লাখ। কুড়িগ্রাম জেলা সাহিত্য সম্মেলনে প্রায় ৫০০ লেখক নাম তালিকাভুক্ত করেছিলেন। এর বাইরে গাইবান্ধা জেলার লেখকেরাও আছেন। মোট প্রায় হাজার জন হবেন। বেশ কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিন দুটি জেলা থেকে বের হয়। রেডিও চিলমারীতে সেই হাজারখানেক স্থানীয় লেখক-সাহিত্যিকের কোনো অংশগ্রহণ নেই। স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে রেডিও স্টেশনগুলোর সম্পর্ক নেই কেন? অথচ কথা ছিল রেডিও স্টেশনগুলোকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠার।
কমিউনিটি রেডিওর ধারণা (১.২)–তে বলা হয়েছে, ‘এটি কল্যাণমূলক সম্প্রচারমাধ্যম, যার মালিকানা, ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় থাকে তৃণমূল পর্যায়ের জনগোষ্ঠী। এটি মূলত অলাভজনক ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে কমিউনিটিকে সেবা প্রদান করা এবং স্থানীয় লোকজ, আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন-বিকাশের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। কমিউনিটি রেডিও কোনো নির্দিষ্ট ক্ষুদ্র ভৌগোলিক এলাকার জনগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে কাজ করে। এটি কমিউনিটির নিজস্ব সম্পদ, যা একটি জনপদের নিজস্ব ধ্যানধারণা, বিচার-বিবেচনা ও চিন্তা-চেতনার যথাযথ প্রতিফলন ঘটায়।’
রেডিও চিলমারীর স্থায়ী কর্মকর্তা তিনজন। তাঁদের নিয়োগ দিয়েছে আরডিআরএস বাংলাদেশ। চাকরি বরখাস্তের ক্ষমতাও নিয়োগদাতাদেরই। দীর্ঘদিন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেছে মিজানুরসহ কয়েকজন। তাদের বাড়ি স্টেশন যে গ্রামে অবস্থিত, সেই গ্রামেই। রেডিওতে যখন নতুন নিয়োগ দেওয়া হয়, তখন বাইরের লোকদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এমনকি ঢাকায় বিভিন্ন প্রশিক্ষণেও তাদেরই মূলত পাঠানো হয়, যারা রেডিওর সঙ্গে যুক্ত নয়। রেডিও চিলমারীর দীর্ঘদিনের ভলান্টিয়ারদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বঞ্চিত করা হয়। অথচ তাদের অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা ছিল। কমিউনিটি রেডিও স্টেশনগুলো এত দিনেও স্থানীয় জনগণের নিজস্ব হয়ে দাঁড়াল না। স্থানীয় জনগণও সম্ভবত এ কারণেই কান ফিরিয়ে নিয়েছে।
তারপর ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারির গেজেটে আরেকটু সম্প্রসারণ করা হয়। (১.৩) ধারণা যুক্ত করে বলা হয়, ‘কমিউনিটি রেডিও এমন একটি মাধ্যম, যা তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের আত্মপ্রকাশ ও বিকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে প্রান্তিক মানুষের প্রকাশ বাহন এবং তাদের যোগাযোগের মূল মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। সর্বোপরি এটি সমাজের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে জোরদার করে।’ চিলমারীর কৃষকেরা হাটখাজনা ও মাঝিরা ঘাটখাজনা আর অটোরিকশাচালকেরা রোডখাজনার জ্বালায় অস্থির। বালুদস্যুদের নির্বিচার বালু উত্তোলনে কৃষকেরা আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। এই কৃষক-জেলে-অটোরিকশাচালকদের প্রকাশ বাহন কি হতে পেরেছে কমিউনিটি রেডিও?
(১.৪)–এ বলা হয়, কমিউনিটি রেডিও সরকারি ব্যবস্থাপনা এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত বেতার সম্প্রচারের বাইরে তৃতীয় মডেল হিসেবে পরিচিত।
কমিউনিটি বা স্থানীয় মানুষকে দাঁড়াতে গেলে আগে খাদ্যব্যবস্থায় স্বনির্ভর হতে হয়। ক্ষুদ্র কৃষক, পরিবেশবাদী, একাডেমিক ও কৃষি আন্দোলনের কর্মী, সম্পদ ব্যবস্থাপকেরা গতিশীল কৃষিব্যবস্থা নির্মাণ ও সংরক্ষণ করতে পারেন। তাঁরা বৈশ্বিক একমুখী ধ্বংসাত্মক খাদ্যবাণিজ্যকে রুখে দিতে সক্ষম। কেমনে? তা হলো ব্যাপক অর্থে জ্বালানি ও প্রযুক্তিনির্ভর না হয়ে গাঁয়ের মানুষের আগ্রহ, অনুশীলন ও ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভরশীল হয়ে। কিন্তু কমিউনিটি রেডিওগুলোর অনুষ্ঠানসূচি দেখলেই বোঝা যায়, এ–সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিই গড়ে ওঠেনি।
মুড়ি ভাজা চিলমারীতে নারীদের একটি পুরোনো পেশা। সারমুক্ত স্বাস্থ্যকর ও সুস্বাদু মুড়ি। চরের এজমালি জমি থেকে খড়ি সংগ্রহ করতেন ব্যাপকসংখ্যক নারী। অন্যদিকে এগুলো ছিল গোচারণভূমি। খড়ি সংগ্রহের সময় নানান জাতের শাকও কুড়িয়ে আনতেন। এগুলোর মধ্য দিয়ে নারীর মর্যাদা কায়েম হতো। পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার ভূমিকা থাকত।
নারীর হাত থেকে মুড়ি ভাজার পেশাটি হাতছাড়া হয়ে গেল। এজমালি সম্পত্তি, গোচারণভূমি বেহাত হয়ে গেল। কেমনে ঘটল? গণমাধ্যম হিসেবে কমিউনিটি রেডিও কতটুকু ভূমিকা নিয়েছে এটা প্রতিরোধে?
ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল বৈচিত্র্যময় ফসলের উৎপাদনকেন্দ্র ছিল। নিজেদের জমি, পরিষ্কার পানি ও উর্বর ভূমিতে টেকসই পদ্ধতিতে খাদ্য ও ফসল উৎপাদনের দরকারি জ্ঞানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে এখনো অক্ষুণ্ন আছে। কিন্তু আধিপত্যবাদী আষাঢ়ে গল্পের বহুজাতিক কোম্পানির মায়াজালে গত দু–তিন বছরে ক্যানসার সৃষ্টিকারী বিষ ও গোখাদ্য ভুট্টার আবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। উল্টো একফসলি চাষাবাদে নীরবে উৎসাহ দিয়েছে এই এনজিও কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত কমিউনিটি রেডিওগুলোই।
৭১ শতাংশ গরিব মানুষের বাস নাকি কুড়িগ্রাম জেলায়। তা–ই যদি হবে, করোনাকালে ঢাকা ছেড়ে যাঁরা ফিরলেন, তার একটা অংশ আর ঢাকা গেল না কেন? নাকি কথিত উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার এটা? কোনটা ঠিক? যদি গরিব হয়, তাহলে এত বছরেও গরিবানা ঘুচল না কেন? আর যদি না হয়, তাহলে কথিত উন্নয়ন দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে কুড়িগ্রামের অপ্রাতিষ্ঠানিক শক্তির জায়গাগুলো ঘোষণা করা উচিত। তখন স্থানীয় ঐশ্বর্যের শক্তিকে যত্ন করার দৃষ্টিভঙ্গি নির্মিত হবে। এখানে প্রধান গণমাধ্যম হিসেবে কমিউনিটি রেডিওর ভূমিকা কোথায়? কমিউনিটি রেডিওগুলোর ঘোষিত মালিক স্থানীয় জনগণ হলে কি এমন হওয়ার কথা?
নাহিদ হাসান: লেখক ও সংগঠক
[email protected]