নারী মৃত্যুর পরও যে নিরাপদ নয়, এটা আবারও প্রমাণিত হলো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের লাশঘরে দুই কিশোরীর মরদেহে ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়ার পর (প্রথম আলো, ১৪ মার্চ ২০২৩)। তাদের মরদেহ থেকে নেওয়া নমুনা পরীক্ষায় একজন পুরুষের বীর্য পাওয়া গেছে। এর আগে ১২ বছর বয়সী আরেক কিশোরী এবং চকবাজার এলাকার ৩২ বছর বয়সী এক নারীর মরদেহের সঙ্গেও এমন ঘটনা ঘটে লাশঘরে।
প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে লাশঘরের পাহারাদার সেলিমের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। ময়নাতদন্তের আগে হাসপাতালের লাশঘরে মরদেহ রাখার সময় তিনি ধর্ষণ করেছেন বলে স্বীকার করেছেন। নারী ও একাধিক শিশু-কিশোরীর লাশের সঙ্গে শারীরিক সংসর্গ করেছেন সেলিম। মৃত্যুর পর ধর্ষণের শিকার এক কিশোরীর বাবা যখন বলেন ‘মরার পরে হাসপাতালের হেফাজতে আমার মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে, এ কথা মনে পড়লে বুক ভেঙে যায়’, তখন মনে হয় এর চেয়ে হৃদয়বিদারক হাহাকার আর হতে পারে না।
খুব সম্প্রতি আরেকটি খবর জানা গেল, পাকিস্তানে নেক্রোফিলিয়া বা মৃতদেহের প্রতি জঘন্য ও বিকৃত রুচির যৌন আসক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে মৃত্যুর পর মেয়েদের কবরে তালা দিয়ে পাহারা দিচ্ছে মা–বাবা। পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম ডেইলি টাইমস এ খবর প্রকাশ করে। নারীদের কবরে তালা লাগানোর ঘটনা সেখানে বেশ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে।
২০১১ সালে করাচির উত্তর নাজিমাবাদ অঞ্চলে এ নেক্রোফিলিয়া মামলার রিপোর্টে দেখা গেছে, রিজওয়ান নামের এক কবর পাহারাদার ৪৮ নারীর মৃতদেহকে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে। পরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এ ছাড়াও অন্যান্য এলাকাতেও একাধিকবার নারীদের দেহ কবর থেকে উঠানো হয় এবং ধর্ষণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
২০২০ সালে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গের ডোম জতন কুমার লালের ভাগনে মুন্না (২০) মর্গে আসা মৃত নারীদের ঠিক এভাবেই ধর্ষণ করেছিলেন। তিনি মামার সঙ্গেই ওই হাসপাতালের মর্গে সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। দুই-তিন বছর ধরে মুন্না মর্গে থাকা মৃত নারীদের সঙ্গে এ কাজ করে আসছিলেন। ধর্ষণ করাই একধরনের মানসিক বিকৃতি, আর মৃত নারীকে ধর্ষণ করা আরও ভয়াবহ মানসিক বিকৃতি।
সেই সময়ে অর্থাৎ ২০২০ সালে ১১ থেকে ১৭ বছরের পাঁচজন কিশোরী বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। এরা পরিবার বা আপনজনের দুর্ব্যবহার, যৌন হয়রানি, ব্ল্যাকমেলিং, অবহেলা, নির্যাতন এসব থেকে থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেও তারা আদতে কিন্তু সামাজিক বিভীষিকার হাত থেকে বাঁচতে পারেনি। সোহরওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে তাদের লাশ কাটাছেঁড়া করতে নেওয়ার পর, সেখানেও মৃত অবস্থায় ধর্ষণের শিকার হতে হলো তাদের। বিষয়টা কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও অসম্ভব।
সাধারণত মৃতদেহ মানুষের মনে এক তীব্র আবেগের সৃষ্টি করে। মানুষের মনে দুঃখবোধ তৈরি হয় এবং মৃত ব্যক্তির প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়। সেই কারণে মৃতদেহের প্রতি সম্মান দেখানোর রেওয়াজ প্রতিটি সমাজ ও ধর্মে প্রতিষ্ঠিত। এমনকি ওই ব্যক্তি যদি অপরাধী বা শত্রুও হয়ে থাকে তা-ও মানুষ তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার কথা ভাবেন। সেখানে জীবিত কোনো নারীর প্রতি মানুষ যতই আকৃষ্ট হোক না কেন, প্রাণহীন দেহের প্রতি সেই অনুভূতি আর কাজ করে না এবং এটাই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। কিন্তু এরপরেও যে ব্যাতিক্রম কিছু ঘটনা ঘটে না তা নয়।
অভিযুক্ত সেলিম ও জতন কুমার লালের মৃতদেহের প্রতি এই যৌন আগ্রহ একটি মানসিক সমস্যা, যার নাম নেক্রোফিলিয়া। নেক্রোফিলিয়া নানা রকমের অস্বাভাবিক যৌনচিন্তা বা অস্বাভাবিক যৌন ইচ্ছার অন্তর্গত, যাকে একসঙ্গে বলা হয় প্যারাফিলিয়া।
এই নেক্রোফিলিয়া রোগটি সম্পর্কে আমাদের অধিকাংশ মানুষের কোনো ধারণাই নেই। কিন্তু বাংলাদেশে এ রকম ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর আমরা নির্বাক হয়ে পড়েছি। অনেকেই ঘটনাটি বিশ্বাসই করতে পারছেন না। কিন্তু অপরাধী যখন নিজের মুখে তাঁর অপরাধ স্বীকার করেছেন এবং চিকিৎসকেরা এই রোগ সম্পর্কে নানা ধরনের তথ্য শেয়ার করছেন, তখন যতই বিস্মিত হই না কেন, একে মেনে নিতেই হচ্ছে।
মৃতদেহের সঙ্গে এমন বিকৃত কর্মকাণ্ডের প্রবণতা নিয়ে ১৬ শতক থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত আইন ও মেডিকেলসংক্রান্ত বইগুলোতে কিছু আলোচনা আছে। আরও আগেও সমাজে এটি প্রচলিত ছিল, কিন্তু মানুষের আলোচনায় ছিল না। প্রাচীন মিসরে অনেকের মধ্যেই এমন স্বভাব ছিল বলে গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস লিখেছিলেন, মিসরীয়রা এই ভয় থেকেই তাদের পরিবারের সুন্দর মেয়েদের মরদেহ তিন-চার দিন ঘরে রেখে, এরপর সংরক্ষণ করতে দিত।
নানা দেশে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন ধরনের নেক্রোফিলিয়া আক্রান্ত রোগীর দেখা মেলে। এদের কেউ মৃত ব্যক্তির সঙ্গে সরাসরি যৌন কর্মকাণ্ড করে, কেউ তাদের প্রিয়জনের দেহ বহুদিন লুকিয়ে রাখে আর দেখে, কেউ কেউ শুধু যৌনতার কথা ভেবেই আনন্দ পায়, কিন্তু শারীরিক সম্পর্ক চায় না। কেউ কেউ আছে ভিকটিমকে মেরে ফেলে শারীরিক সম্পর্ক করে।
আমরা সবাই সাধারণত মনে করি একটি অপরাধ ঘটলেই অপরাধীকে চরম পাপী ভেবে শাস্তির মুখে ঠেলে দেওয়া উচিত। তাহলে কিন্তু কোনোভাবেই পরবর্তী বিপর্যয় ঠেকানো যায় না। নেক্রোফিলিয়া কেন হয়, এ সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা না থাকলেও, এর সঙ্গে ব্যক্তির জেনেটিক সম্ভাব্যতা ও বেড়ে ওঠার পরিবেশের সম্পর্ক আছে বলে মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন। কখনো কখনো পরিস্থিতির কারণেও এটি তৈরি হতে পারে। তাই সব ক্ষেত্রেই চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকা উচিত।
সমাজে নেক্রোফিলিয়ায় আক্রান্ত মানুষ খুব একটা দেখা যায় না এবং এ-সংক্রান্ত তেমন কোনো তথ্য-উপাত্তও নেই। এরপরও অনেকে মনে করেন, ধারণার চেয়ে হয়তো বেশিই আছে এই রোগ। দেখা গেছে, যেসব মানুষ নেক্রোফিলিয়ায় আক্রান্ত, তাদের শতকরা ৫৭ শতাংশেরই কোনো না কোনোভাবে বা পেশাগতভাবে মৃতদেহের কাছে যাওয়ার সুযোগ থাকে। যেমন ডোম, মর্গের পাহারাদার, হাসপাতালের আরদালি এবং গোরস্থানে কর্মরত মানুষ। গবেষকেরা মনে করেন কয়েকটা ফ্যাক্টর মানুষের মধ্যে এই রোগের পূর্ববর্তী ভূমিকা হিসেবে কাজ করে।
যেমন, যাদের খুব দুর্বল আত্মবিশ্বাস, জীবনে চরম কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে থাকলে, অন্যের দ্বারা প্রত্যাখিত হওয়ার ভয় নিয়ে বাঁচে যারা, অথবা যারা ভাবে এমন একজনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে, যে তাদের বাধা দিতে পারবে না বা তাকে না করতে পারবে না। শতকরা ৬৮ ভাগ রোগীরই নেক্রোফিলিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার এটাই মূল কারণ। শতকরা ২১ ভাগ চায় চলে যাওয়া প্রিয়জনের কাছে যেতে। এ ছাড়া কেউ কেউ মৃত মানুষের ওপর শক্তি প্রদর্শন করে নিজেদের দুর্বল আত্মবিশ্বাসকে চাঙা করতে চায়। আরও আছে হেলুসিনেশন ও অপ্রতিরোধ্য যৌন ইচ্ছা। তবে পুরো ব্যাপারটাই একধরনের মানসিক ডিজঅর্ডার। কিছু কিছু পশুপাখির মধ্যেও এই আচরণ দেখতে পাওয়া যায়। রোগী কম বলে এর চিকিৎসা নিয়ে খুব একটা ভাবা হয়নি।
এ ধরনের মানসিক অসুস্থতা ব্যক্তির অভ্যন্তরীণ কারণে দেখা দিতে পারে, আবার পরিবেশ পরিস্থিতি ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদেরও আক্রান্ত করতে পারে। শিশু-কিশোর বয়সেই যদি এমন চরিত্রগুলোর অস্বাভাবিকতা লক্ষ করা যায় এবং সময়মতো ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তাহলে হয়তো সেটা অপরাধের পর্যায়ে যাবে না এবং সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না।
কিন্তু আমরা সবাই সাধারণত মনে করি একটি অপরাধ ঘটলেই অপরাধীকে চরম পাপী ভেবে শাস্তির মুখে ঠেলে দেওয়া উচিত। তাহলে কিন্তু কোনোভাবেই পরবর্তী বিপর্যয় ঠেকানো যায় না। নেক্রোফিলিয়া কেন হয়, এ সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণা না থাকলেও, এর সঙ্গে ব্যক্তির জেনেটিক সম্ভাব্যতা ও বেড়ে ওঠার পরিবেশের সম্পর্ক আছে বলে মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন। কখনো কখনো পরিস্থিতির কারণেও এটি তৈরি হতে পারে। তাই সব ক্ষেত্রেই চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকা উচিত।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে মুন্না যখন মৃত কিশোরীদের সঙ্গে এমন কর্মকাণ্ড করেছিলেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ২০। কয়েক বছর ধরেই তিনি তাঁর মামা জতন কুমার লালের সঙ্গে মর্গে সহযোগিতা করেন। মুন্নার মামা জানিয়েছিলেন গ্রামে খারাপ ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করার কারণে ভাগনে মুন্নাকে রাজবাড়ী থেকে এনে তাঁর সঙ্গে রাখতেন। অর্থাৎ মুন্নার মানসিক ডিজঅর্ডারের লক্ষণ তার মধ্যে আগে থেকেই ছিল, যা সাইকোপ্যাথিক আচরণের পূর্বলক্ষণ।
সাইকোপ্যাথ, পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার বা প্যারাফিলিয়া মানসিক সমস্যা হলেও এই কারণে করা অপরাধ শাস্তিযোগ্য। আর তাই নেক্রোফিলিয়া হলেও মুন্নার শাস্তি হয়েছে, সেলিম দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁরও শাস্তি হবে। এ জন্যই সময় এসেছে মর্গে নিয়োগের সময় যথাযথ স্ক্রিনিং, ট্রেনিং ও মনিটরিং ও পূর্ব আচরণ ও সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে জানা।
কয়েক বছর আগে একটি খবরে দেখেছিলাম সুইডিশ লিবারেল পার্টির যুব শাখা নেক্রোফিলিয়াকে বৈধতা দেওয়ার দাবি তুলেছে। তারা বলেছে, মানুষের উচিত মৃত্যুর পর তার দেহ কী হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। ইউরোপে এ ধরনের দাবি এটাই প্রথম নয়। তবে ভালো কথা কোনো সরকারই এসব কাজকে আইনগত ভিত্তি দেয়নি, বরং সব দেশেই এগুলো শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
আসলে সামাজিক সুস্থতার ক্ষেত্রে আমাদের গঠনমূলক পথে এগোতে হবে। আমরা যদি এই জাতীয় অপরাধকে মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার না করে, শুধু শাস্তি দেওয়ার পথে যাই তাহলে অপরাধীর সংখ্যা বাড়বে বই কমবে না।
সেলিম বা মুন্নার এই অপরাধ কিন্তু সরাসরি ‘পথভ্রষ্ট’ হওয়া থেকে নয়। এ ধরনের অপরাধ বা অপরাধমূলক বিহেভিয়ারে আক্রান্ত মানুষের পাশে বা সামনে এমন কেউ থাকে না যে এই আচরণগত সমস্যাটা আগে থেকে লক্ষ করবেন এবং তাঁদের চিকিৎসা করাবেন ও সঠিক পথ দেখাবেন। যথাযথ চিকিৎসা না করিয়ে শুধু শাস্তি দিলে তাকে কিছু সময়ের জন্য সমাজ থেকে দূরে রাখা যায় ঠিকই, কিন্তু তাকে সুস্থ করা যাবে না।
সেই সঙ্গে আরও যারা এ ধরনের রোগে আক্রান্ত, তাদেরও ঠেকানো যাবে না। সেই জন্য সামাজিক সুস্থতার ক্ষেত্রে গঠনমূলক পথে এগোতে হবে এবং এর জন্য চাই বিষয়ভিত্তিক শিক্ষা ও কিছু গোপন না করে শুরুতেই ব্যবস্থা নেওয়া।
শাহানা হুদা যোগাযোগকর্মী