গ্রামের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নানাবাড়ির সূত্রে, সেখানেই আঁতুড়ঘরে আমার জন্ম। শৈশব, কৈশোরে সব ছুটিতে সেখানে বেড়াতে যাওয়া ছিল জীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দের বিষয়।
গ্রামের জগৎ, মানুষ, আম-কাঁঠাল-লিচুসহ ফলের গাছ, পুকুর, খাল–বিল, ধান চাষ, পাট চাষ, আখ চাষ, মাছ ধরা, গরুর গাড়ি, মহিষের গাড়ি, ধান কাটা, পিঠা, সাঁতার, খেলাধুলা, হাটবাজার, যাত্রাসহ নানা কর্মতৎপরতা, মানুষের আনন্দ–বেদনা, হাসি–ঠাট্টা, সালিসসহ বহু কিছুর সঙ্গে পরিচয় এখানেই। গ্রামের সঙ্গে এই যোগাযোগটুকুও যদি না থাকত, তাহলে আমি আরও অসম্পূর্ণ থাকতাম।
গ্রামে আমার এক প্রিয় গন্তব্য ছিল বিলের ধারে একটা বিশাল বটগাছ। বড় হয়েও যেভাবে গ্রামে গেলেই সেখানে হাজির হওয়ার তাড়া অনুভব করতাম, তাতে যেন তা একটা তীর্থস্থানের মতো হয়ে উঠেছিল। আমার জন্মেরও আগের এই বটগাছ, এর পেছনে একটা বড় বিল, সামনে মাঠ। দুই ঈদের জামাত হয় সেখানেই। ছোটবেলায় ঈদের সময় যখন গেছি, তখন এই জামাতেও অংশ নিয়েছি, দেখা যেত দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসছে। সেই দৃশ্য অনুভূতি এখনো মনে আছে।
পুরো বছরেই সেই মাঠ ছিল আশপাশের বহুজনের প্রশান্তি বিনোদনের জায়গা। বটগাছের বিশাল ছায়া, অসংখ্য পাখির কিচিরমিচির আর অবিরাম নরম বাতাসের মধ্যে সেখানে দেখা যেত মাছ ধরতে ধরতে কেউ এসে বিশ্রাম নিচ্ছে, আশপাশের খেতে কাজ করতে করতে এখানে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে কেউ, আবার কখনো কখনো অলসভাবে গান গাইতে দেখা যেত খালিগা পরিশ্রমী মানুষদের। যাতায়াতের পথে এখানে কেউ নামাজ পড়ত। মানুষের পাশেই থাকত ক্লান্ত গরু, ছাগল, মহিষ। কুকুর, বিড়ালের জন্যও বাধা ছিল না। মাঝেমধ্যে গায়েনদের গানের আসরও বসত।
কয়েক বছর আগে গ্রামে গিয়ে হঠাৎ শুনলাম এই মাঠ নিয়ে একটি উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে এসেছেন এই গ্রামের কৃতী সন্তান একজন সরকারি কর্মকর্তা। শুনলাম, ওই মাঠের আরও উন্নয়নে এই অর্থ ব্যয় হবে। তখন বুঝতে পারিনি এর পরিণতি। দুই বছর পর আবার যখন গ্রামে গেছি, তখন যথারীতি গেলাম ওই মাঠে বটের ধারে। কিন্তু তার কাছে গিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। পুরো মাঠটা দেয়াল দিয়ে ঘিরে ফেলে একটি উঁচু গেট লাগানো হয়েছে। যে কেউ ইচ্ছা করলেই এখানে আর ঢুকতে পারবে না। গরু, ছাগল, মহিষ, কুকুর, বিড়াল, হাঁস–মুরগি তো নয়ই। এবং অবিশ্বাসের সঙ্গে দেখলাম, সেই বটগাছের জায়গায় শীর্ণ এক কাঠামো, চারদিকে ছড়িয়ে থাকা বিশাল বটগাছ কেটে ছেঁটে একটা লম্বা গাছের রূপ দেওয়া হয়েছে।
মনে হয় বটের ডালপালা, ছায়া, বাতাস, পাখি তাদের খুবই অপছন্দ! সর্বজনের অর্থ খরচ করে এ রকম উন্নয়ন প্রকল্পের কী ব্যাখ্যা, তা জানার চেষ্টা করলাম। শুনলাম, ঈদগাহ মাঠের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কে কার রক্ষণাবেক্ষণ করবে? ছায়া–বাতাসে ভরা সর্বজনের খোলা প্রান্তর কি এত দিন ঝুঁকির মুখে ছিল? বটবৃক্ষ ছেঁটে একটা খোলা জায়গা দেয়ালবন্দী করে, মানুষ, পশুপাখিদের আনন্দ, অবসর, শান্তি, বিনোদন থেকে বঞ্চিত করে রক্ষণাবেক্ষণ বা উন্নয়ন কার জন্য?
সরকারের বাণী উচ্চরবে প্রচারিত হয়, ‘পরিবেশ ধ্বংস করে কোনো প্রকল্প নয়’। আর দেখি তার চোখের সামনে, পৃষ্ঠপোষকতায় খুন হয় নদী, খুন হয় বন, সর্ব প্রাণ। ভারতের বাঁধ, দেশের উন্নয়ন প্রকল্প আর ক্ষমতাবানদের নদী দখল উৎসব সব সমন্বিতভাবে চলতে থাকে। বন উজাড়, পাহাড় কাটা, নদী বিনাশ অবশ্যই জিডিপি বাড়ায়, কিছু লোককে খুবই মোটাতাজা করে, কিন্তু আমাদের জন্য ঘন হতে থাকে সর্বনাশ!
এ রকম উন্নয়ন প্রকল্পে কেউ কেউ কিছু অর্থ পেয়েছেন, কিন্তু শুধু অর্থের লোভেই এ কাজ হয়নি। এটা হয়েছে উন্নয়ন সম্পর্কে একটা ভয়াবহ জনবিদ্বেষী প্রাণবিদ্বেষী ধ্যানধারণার আধিপত্যের কারণে। চারদিকে তাকালে এ রকম বহু উন্নয়ন প্রকল্পের আমরা দেখা পাই, সেখানে মানুষকে বিপন্ন করে নানা কাঠামো বানানো হয়েছে, প্রাণহরণ করে জৌলুশ লাগানো হয়েছে।
উন্নয়নের নামে খোলা জায়গা ইজারা দিয়ে বদ্ধ ‘পার্ক’ বানিয়ে, তা বাণিজ্যিক ব্যবস্থায় পরিচালনার বহু দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। ফয়’স লেক এর অন্যতম। আর সুন্দরবনের মতো বিশাল মহাপ্রাণ নষ্ট করে কয়লাবিদ্যুৎ, সিমেন্ট, এলপিজি প্ল্যান্ট এ দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রকাশ! মাতারবাড়ী, পায়রা, বাঁশখালী, রূপপুরের মতো মেগা প্রকল্প তো আছেই।
একদিন পত্রিকায় খবর দেখলাম মন্ত্রী বলছেন, বাংলাদেশে নদীগুলো অনেক প্রশস্ত। এত প্রশস্ত নদী বিশ্বের কোথাও নেই, দরকারও নেই, অনেক সমস্যা হয়। তাই প্রস্থ কমিয়ে সেখানে রিসোর্ট বানাতে হবে, কৃষিজমি বানাতে হবে। প্রথমে ভাবলাম যে এ রকম নির্বোধের মতো কথা ক্ষমতাবানেরা বিভিন্ন সময়ে বলেই থাকেন। এগুলোকে গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। কয় দিনও পার হয়নি, জানলাম মন্ত্রীর এ কথা আকস্মিক ব্যক্তি–নির্বোধ উক্তি নয়। নদী কেটে সরু করা একাধিক মেগা প্রকল্পের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারিত।
খুন, জখম হওয়ার পর দেশে নদীর সংখ্যা কত আছে, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। সরকারের বিভিন্ন দলিলে বিভিন্ন রকম। গড় হিসাবে বোঝা যায়, দুই–তৃতীয়াংশ নদীই এখন নেই। দেশে বহু সেতু কালভার্ট আছে, যেগুলোর নিচে কোনো নদী বা পানিপ্রবাহ নেই, এতটুকু বোঝা যায় এখানে এককালে নদী বা এর কোনো শাখা ছিল। নৌপথও তাই এখন এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। ভারতে উজানে বিভিন্ন বাঁধ প্রকল্প ছাড়াও নদী নিয়ে দেশে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের বড় অবদান আছে এর পেছনে।
১৯৬৪ সালে ন্যাশনাল ওয়াটার প্ল্যানিংয়ের আওতায় পোল্ডার বা পাকা ঘেরাওয়ের বন্দোবস্ত হয়েছিল, যার ফলে দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলে এখন জলাবদ্ধতা। ৮০ দশকে ন্যাশনাল ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান হয়েছে, যা ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে সেচ প্রসারের ব্যবস্থা জোরদার করেছে।
আশি দশকেই এসেছিল বিশ্বব্যাংক ঋণে ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান। কর্ডন বা পুরো দেশে কংক্রিট ঘেরাও করে বন্যা নিয়ন্ত্রণের পথ দেখিয়েছিল তারা। এই নামে কাজ হয়নি প্রবল প্রতিরোধের করণে, কিন্তু ভিন্ন নামে একই কাজ অব্যাহত থেকেছে। একই ধারায় তৈরি হয়েছে নদী নিয়ে শতবর্ষের ব্যাপক ব্যয়বহুল বহু ‘ডেলটা প্ল্যান ২১০০’। এর ব্যাপক ত্রুটি ও ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন ও প্রবাসী বিশেষজ্ঞদের সংগঠন বেন থেকে সুনির্দিষ্ট সমালোচনা হাজির করলেও কোনো বিকার নেই।
এর পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক এডিবি ঋণে নেওয়া হয়েছে রিভার ব্যাংক ইমপ্রুভমেন্ট প্ল্যান (২০১৫-২৩)। ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা রক্ষার নামে এই প্রকল্পে প্রস্তাব করা হয়েছে নদীর প্রস্থ কমিয়ে জমি উদ্ধারের। নৌপথে ভারতের ট্রানজিট সহজ করার জন্য নদী ড্রেজিং এবং গভীর চ্যানেল তৈরির কাজ চলছে। উজানে ভারতের একাধিক বাঁধের কারণে তিস্তা নদী আক্রান্ত। সেই বিষয় ফয়সালা না করে এখন অবশিষ্ট পানির তিস্তা নদী নিয়ে চীনা ঋণে এক মহাপরিকল্পনায় এই নদী সরু করে দুই পারে রাস্তা, রিসোর্ট ইত্যাদির প্রকল্প তৈরি হয়েছে। এর বাইরে আছে বড় নদীগুলো নিয়ে ‘সাসটেইনেবল রিভার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান’।
এসব প্রকল্পই বিদেশি ঋণে। কনসালট্যান্ট, আমলা, প্রকৌশলী, নির্মাণ কোম্পানি সবার জন্যই দীর্ঘ সময়ের আয়–উপার্জনের ব্যবস্থা। কিন্তু যাদের নদী, সেসব মানুষ এগুলো সম্পর্কে কিছুই জানে না। এসব প্রকল্প নিয়ে প্রয়োজনীয় সমীক্ষা, জনমত, জনসম্মতি নিছক লোকদেখানো। সব প্রকল্প ইংরেজি ভাষায়, সুবিধাভোগী আমলা, মন্ত্রী, কনসালট্যান্টরা এগুলো মধুর করে বলেন, বিজ্ঞাপনী প্রচার থাকে। ফলাফলের দায় কেউ নেয় না। সরকার বদলায়, কিন্তু তার পাটাতনে এসব সর্বনাশা প্রকল্প বদলায় না।
সরকারের বাণী উচ্চরবে প্রচারিত হয়, ‘পরিবেশ ধ্বংস করে কোনো প্রকল্প নয়’। আর দেখি তার চোখের সামনে, পৃষ্ঠপোষকতায় খুন হয় নদী, খুন হয় বন, সর্ব প্রাণ। ভারতের বাঁধ, দেশের উন্নয়ন প্রকল্প আর ক্ষমতাবানদের নদী দখল উৎসব সব সমন্বিতভাবে চলতে থাকে। বন উজাড়, পাহাড় কাটা, নদী বিনাশ অবশ্যই জিডিপি বাড়ায়, কিছু লোককে খুবই মোটাতাজা করে, কিন্তু আমাদের জন্য ঘন হতে থাকে সর্বনাশ!
আনু মুহাম্মদ অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সর্বজনকথা পত্রিকার সম্পাদক