মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পাবলিক পরীক্ষাকে সামনে রেখে কোচিং সেন্টারগুলো হরেক রকম মডেল টেস্টের আয়োজন করে। প্রত্যেকে তাদের মডেল টেস্টকে সেরা বলে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের আকৃষ্ট করতে সচেষ্ট থাকে। তাদের এই প্রচারকাজ অনেকটাই সফল। ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি কোচিং সেন্টারে পাবলিক পরীক্ষা বা ভর্তি পরীক্ষার আগে শিক্ষার্থীদের প্রচণ্ড ভিড় থাকে।
কোচিং সেন্টারের মডেল টেস্টের মতো জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনেও নানা রকম মডেল টেস্টের কথা শোনা যায়। দেশবাসী প্রথম মডেল টেস্টের মুখোমুখি হলো ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে; কোথাও বিরোধী দলের প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে না দিয়ে, কোথাও ব্যালট বাক্স হেলিকপ্টারে ঢাকায় এনে ফলাফল গণনা করে সরকারদলীয় প্রার্থীকে (তাঁদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রের অন্যতম খলনায়ক খন্দকার মোশতাক আহমদও ছিলেন) বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল।
এরপর আরেক মডেল টেস্ট নিয়ে এলেন দুই সামরিক শাসক, যার নাম গণভোট। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খান প্রবর্তিত গণভোট স্বাধীন বাংলাদেশের দুই সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। সেই গণভোটে কোথাও ৯৯ শতাংশ ভোট পড়া এবং কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে ফলাফল ঘোষণারও নজির আছে।
জিয়াউর রহমানের আমলে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদের নির্বাচন হয়, যাতে কয়েক মাস আগে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল পেয়েছিল ২০৭টি আসন। আর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ মাত্র ৩৯টি। তবে এই নির্বাচনে জিয়াউর রহমান ডান-বাম কাউকে বিমুখ করেননি। ছোট দলগুলোকেও একটি–দুটি করে আসন দেওয়া হয়েছিল।
সেই সংসদ মেয়াদ পূরণ করার আগেই হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সেনাশাসন জারি করেন। এরপর সব সেনা শাসনের আমলে যা হয়ে থাকে, বিভিন্ন দল থেকে লোক ভাগিয়ে এনে নতুন দল করা, তিনিও তা করলেন। এরশাদের আমলে দুটি নির্বাচন হয় যথাক্রমে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে। এতে ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টি পায় যথাক্রমে ১৫৩ ও ২৫১ আসন। তৃতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি ও ৫ দলীয় বাম জোট বর্জন করলেও আওয়ামী লীগ অংশ নিয়ে ৭৬টি আসন পায়। বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাতীয় পার্টির যে রাজনৈতিক সখ্য, তার শুরু ছিয়াশিতেই। সে সময় জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগকে বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে, এখন আওয়ামী লীগ বিএনপির বিরুদ্ধে জাতীয় পার্টিকে কাজে লাগাচ্ছে।
সেনাশাসক এরশাদের ক্ষমতাচ্যুতির পর ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে যে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়, তাতে অনেকের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণ করে বিএনপি জয়ী হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সূক্ষ্ম কারচুপির কথা বললেও মানুষ বিশ্বাস করেনি। আবার ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে পরাজিত বিএনপি স্থূল কারচুপির কথা বললেও দেশি–বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা ফলাফলকে ন্যায্য বলে অভিহিত করেছেন।
আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রধান সমস্যা হলো নিজের বিপক্ষে গেলে সেই ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করা। তাঁরা জনগণকে নিয়ে রাজনীতি করলেও জনগণের রায় মানতে পারেন না। জনগণ যাতে নির্ভয়ে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে না পারেন, সে জন্য জবরদস্তি করে থাকে।
বিএনপি এক মাগুরা মডেল উপনির্বাচন করায় বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ পাল্টে গিয়েছিল। এর পর থেকে নির্বাচনের মডেল পাল্টাতে থাকে। অতি সম্প্রতি আরেক মডেলের নির্বাচন প্রত্যক্ষ করেছে দেশবাসী ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেখানে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য উকিল আবদুস সাত্তারের ছেড়ে দেওয়া আসনে উপনির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে তিনিও প্রার্থী হন। নামে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও সরকারি দল আওয়ামী লীগ তাঁকে জিতিয়ে আনতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। প্রশাসনও উকিল আবদুস সাত্তারের পক্ষে কাজ করেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ও ঢাকা থেকে যেসব সাংবাদিক নির্বাচনের খবর সংগ্রহ করতে সেখানে গিয়েছিলেন, তাঁরা। এটিও বাংলাদেশি নির্বাচনের আরেক মডেল।
জাতীয় রাজনীতিতে যা–ই হোক না কেন, স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনগুলো সব সময়ই জমজমাট হতো। কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক নন, এমন মানুষও নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসতেন। আবার দলের লোকেরাও নির্বাচিত হতেন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দলীয় পরিচয় যা–ই থাকুক না কেন, তাঁরা স্থানীয় সরকার সংস্থা, সেটি হোক ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ কিংবা সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা, তাঁদের কাছে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানই অধিক গুরুত্ব পেত। বিএনপি সরকারের আমলে বড় দুটি সিটি করপোরেশনে যেমন আওয়ামী লীগ সমর্থক মেয়র ছিলেন, তেমনি আওয়ামী লীগ আমলেও অনেকগুলো সিটি করপোরেশন বিএনপির সমর্থক মেয়র দায়িত্ব পালন করেছেন। এর মাধ্যমে রাজনীতিতে ক্ষমতার ভারসাম্য ছিল।
কিন্তু আওয়ামী লীগ দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এসব সংস্থা প্রায় দলীয় প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। এখন সেখানে কে নির্বাচিত হলেন, সেটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো কোন দল ক্ষমতায় আছে। এটাও আমাদের গণতন্ত্র ও নির্বাচনী ব্যবস্থার আরেক মডেল।
ক্ষমতাসীন দল থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের মডেল হিসেবে রংপুর সিটি করপোরেশনের উদাহরণ দেওয়া হয়। সেখানে সরকারদলীয় প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও জাতীয় পার্টির প্রার্থী জিতেছেন। কিন্তু যে নির্বাচনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাই নেই, সেই নির্বাচন কীভাবে মডেল নির্বাচন হয়, আমাদের মাথায় আসে না। দিনাজপুর পৌরসভায় এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সমর্থক ও মনোনীত কোনো মেয়র বা চেয়ারম্যান জয়ী হননি। এর অর্থ এই নয় যে সেখানে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে আরেকটি মডেল নির্বাচন করতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন মানে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন।
আমরা মাগুরা মডেলের নির্বাচন দেখেছি। রংপুর মডেলের নির্বাচনও দেখেছি। হালে আরও কয়েকটি ‘মডেল নির্বাচন’ দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কথা আমরা আগেই বলেছি। বাকি পাঁচটি আসনে কীভাবে ভোট হয়েছে, কতভাগ মানুষ ভোট দিয়েছেন, কত ভাগ অনুপস্থিত থেকেছেন, তা–ও সবার জানা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেই বলেছেন, ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। এর অর্থ ৭৫ থেকে ৮৫ শতাংশ ভোটার অনুপস্থিত ছিলেন।
এখন প্রশ্ন হলো আগামী জাতীয় নির্বাচনটি কোন মডেলে হবে? সব দলের অংশগ্রহণে হলে রাজনৈতিক সমঝোতায় আসতে হবে। আলোচনা করতে হবে। আর ব্রাহ্মণবাড়িয়া মডেলে হলে সরকার ও সরকারি দলই ঠিক করবে কে কোথায় প্রার্থী হবেন, কে হবেন না। কার ভোটকেন্দ্রে আসার প্রয়োজন আছে, কার নেই।
আর রংপুর মডেলে হলে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে বাদ দিয়েই নির্বাচন হবে। তবে সেই মডেলকে মানুষ ১৫ ফেব্রুয়ারির (১৯৯৬) মডেল বলে আখ্যায়িত করবে। ওই নির্বাচনে বিএনপির দাবি ২০ শতাংশ এবং আওয়ামী লীগের দাবি ৩ শতাংশ ভোট পড়েছিল।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি