এবার যারা এসএসসি পাস করল, করোনার কারণে তারাই সবচেয়ে বেশি স্কুলবঞ্চিত হয়েছে। তারা ২০২০ সালে নবম শ্রেণিতে উঠে আড়াই মাস ক্লাস করে। তারপর ১৮ মাস বন্ধ থাকার পর ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর যখন স্কুল খুলল, তখনো তারা পুরোদমে ক্লাস করতে পারেনি। এরপর আবার স্কুল বন্ধ হয়। প্রথম দিকে এদের মূল ভরসা ছিল টেলিভিশন (৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ), রেডিও (০ দশমিক ৬ শতাংশ), কম্পিউটার (৭ দশমিক ০ শতাংশ) ও ইন্টারনেট (৪৯ দশমিক ০ শতাংশ)। অংশগ্রহণের শতকরা হারই বলে দিচ্ছে, এই সুযোগ সবাই নিতে পারেনি। কিন্তু পরে যখন অ্যাসাইনমেন্ট (৭১ দশমিক ৭ শতাংশ) ও বাড়ির কাজ (২০ শতাংশ) শুরু হয়, তখন এসব সুযোগবঞ্চিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা আশানুরূপভাবে কমে যায়।
অর্থাৎ শিখন-শেখানো পদ্ধতিতে করোনা একটা বড় পরিবর্তন নিয়ে আসে। যে কেউ একটু খেয়াল করলেই বুঝবেন যে সে সময় পরিস্থিতির চাপেই প্রথাগত শিক্ষককেন্দ্রিক শিখন-শেখানো পদ্ধতিটা অনেকাংশে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিখন-শেখানো পদ্ধতিতে পরিণত হয়। বিবিএস-ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুযায়ী স্বশিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হওয়া শিক্ষার্থীর হার ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ। হয়তো এ কারণেই এই রিপোর্ট অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের পড়ার অভ্যাস করোনার আগের সময়ের তুলনায় করোনার পরে বেড়েছে (৯৩ দশমিক ৩ শতাংশ, ২০১৯— ৯৫ দশমিক ২ শতাংশ, ২০২১)। তবে বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের (বেডু) গবেষণা অনুযায়ী সেটা আরও বেশি। সেখানে বলা হচ্ছে, অ্যাসাইনমেন্টে শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। ৭২ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থী, ৮৭ দশমিক ৬ শতাংশ অভিভাবক এবং ৯১ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষক বলেছেন, অ্যাসাইনমেন্ট শিক্ষার্থীদের স্বশিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করেছে। একইভাবে ৭৮ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী, ৮৬ দশমিক ৯ শতাংশ অভিভাবক এবং ৮৪ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষক বলেছেন, অ্যাসাইনমেন্ট শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় আরও বেশি মনোযোগী করেছে। এসব পরিসংখ্যান যদি সত্যি হয় এবং আমাদের শিক্ষার্থীরা যদি সত্যিই স্বশিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়, তাহলে এবারের এসএসসিতে তাদের ভালো ফলাফলটা অপ্রত্যাশিত নয়।
তবে ফলাফলটি আমাদের মধ্যে আশা জাগালেও একই সঙ্গে একটা আশঙ্কাও তৈরি করে। অসাম্য তৈরি হওয়ার আশঙ্কা। একজন শিক্ষার্থীও পাস করেনি, এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা গত বছর ছিল ১৮টি আর এবার সেই সংখ্যা অনেক বেড়ে ৫০ হয়েছে। অন্যদিকে, শতভাগ পাস করেছে, এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা গতবার ছিল ৫ হাজার ৪৯৪ আর এবার সেটা মাত্র ২ হাজার ৯৭৫। বিপরীত দিকে, যারা করোনার সময় পেয়ে যাওয়া সুবিধাগুলো অর্থাৎ টিভি ক্লাস, অনলাইন ক্লাস ও অ্যাসাইনমেন্টকে কাজে লাগাতে পেরেছে, তারা আগের চেয়ে অনেক ভালো করেছে। আগের চেয়ে এবার বেশি বিষয়ে পরীক্ষা দেওয়া সত্ত্বেও সব বোর্ড মিলিয়ে জিপিএ ৫ পেয়েছে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন, যা গতবার ছিল ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন। কঠিন বিষয় বলে পরিচিত ইংরেজি (৯৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ) এবং গণিতেও (৯৫ শতাংশ) পাসের হার বেশি। ছাত্র (৮৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ) এবং ছাত্রীর (৮৮ দশমিক ৪২ শতাংশ) ক্ষেত্রে সাম্য ধরে রাখতে পারলেও শহর-গ্রাম, ধনী-দরিদ্র, সমতল-চর/হাওর/পাহাড়/চা-বাগানের ভেতর অসমতা বেড়েছে।
আসন্ন শিক্ষাক্রম বা গুণগত শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য স্কুলে স্কুলে সাম্য প্রতিষ্ঠার কাজটি খুব জরুরি। এ ক্ষেত্রে আগেও আমরা খুব একটা ভালো অবস্থায় ছিলাম না। কিন্তু করোনার কারণে যে আরও পিছিয়ে গেছি, এবারের এসএসসির ফলাফল সেটা প্রমাণ করল। এই অসাম্যকে আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। ভালো ফলাফলে খুশি হলে অসুবিধা নেই, কিন্তু মন্দ ইঙ্গিতটাও ঠাওর করতে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নিতে হবে।
এই অসাম্য প্রমাণ করে, আমরা যে ডিজিটাল ডিভাইডের আশঙ্কা করেছিলাম, তা কিছুটা হলেও সত্য হয়েছে। সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হলো, নতুন শিক্ষাক্রমের যাত্রাপথে এই অসাম্য বৃদ্ধি একটা বিপরীত স্রোত হয়ে বাধার সৃষ্টি করবে। কারণ গুণগত শিক্ষা লাভের একটি অত্যাবশ্যকীয় পূর্বশর্ত হচ্ছে সাম্য। শিক্ষায় অসাম্য থাকলে কী সমস্যা হয়, সেটা একটু ব্যাখ্যা করা যাক।
অসাম্য থাকলে যারা তুলনামূলক ভালো অবস্থায় থাকে, তাদেরও ক্ষতি হয়। যেমন আমাদের গড় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত যে খুব বেশি, তা নয়। কিন্তু আপনি যদি খুব নামকরা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যান তো দেখবেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী সেখানে ঠিকমতো বসারই জায়গা পায় না। অর্থাৎ এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত গুণগত শিক্ষার অনুকূল নয়। অন্যদিকে পিছিয়ে পড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই অনুপাত অনেক কম, কারণ সেখানে কেউ তাঁদের সন্তানদের পাঠাতে চান না। মোদ্দাকথা হচ্ছে, স্কুলে স্কুলে সাম্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা না করে কেবল শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ালে কাঙ্ক্ষিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতে পৌঁছানো যাবে না।
স্কুলে স্কুলে সাম্য না থাকলে আরেকটা যে সমস্যা হয় সেটা হচ্ছে, শুধু একাডেমিক অর্থে মেধাবী কিছু ভালো শিক্ষার্থী গুটিকয় স্কুলে কেন্দ্রীভূত হয়। গুণগত শিক্ষার জন্য বিভিন্ন অর্থে মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে মিথস্ক্রিয়া প্রয়োজন, সেটা হয় না। গুণগত শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের সব ধরনের মেধা (ভাষিক, সাংগীতিক, গাণিতিক, স্থানিক, কাইনেস্থেটিক, প্রকৃতিবাদী, অন্তঃসম্পর্কীয় ও আন্তঃসম্পর্কীয়) বিকাশের ব্যবস্থা করে দেওয়া। শুধু একাডেমিক অর্থে ভালো কিছু প্রতিষ্ঠান দিয়ে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়।
এ রকম আরও বহু কারণ আছে, যে কারণে আসন্ন শিক্ষাক্রম বা গুণগত শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য স্কুলে স্কুলে সাম্য প্রতিষ্ঠার কাজটি খুব জরুরি। এ ক্ষেত্রে আগেও আমরা খুব একটা ভালো অবস্থায় ছিলাম না। কিন্তু করোনার কারণে যে আরও পিছিয়ে গেছি, এবারের এসএসসির ফলাফল সেটা প্রমাণ করল। এই অসাম্যকে আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। ভালো ফলাফলে খুশি হলে অসুবিধা নেই, কিন্তু মন্দ ইঙ্গিতটাও ঠাওর করতে হবে এবং যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নিতে হবে।
সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক
মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক