হাবিবুল আউয়াল কমিশন এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি বিতর্কিত ও পক্ষপাতদুষ্ট কর্মকাণ্ড করেছে। কমিশনের একটি সাম্প্রতিক বিতর্কিত কর্মকাণ্ড হলো অনেক সক্রিয় রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়ে নামসর্বস্ব কয়েকটি দলকে নিবন্ধন প্রদান, যেগুলোকে যথার্থভাবেই ‘কিংস পার্টি’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।
কমিশনের আরও একটি অতি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত হলো, নির্বাচনবিরোধী রাজনৈতিক সভা–সমাবেশ নিষিদ্ধ করার ঘোষণা। এটি বিরোধী দলগুলোর অধিকার হরণের অপচেষ্টা। কেননা শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন বর্জনের করার প্রচেষ্টা নাগরিকের সংবিধান-স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। কমিশনের সবশেষ বিতর্কিত সিদ্ধান্ত হলো হলফনামায় তথ্য গোপনের অভিযোগে ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের প্রার্থিতা বাতিলের আবেদন খারিজ করে দেওয়া।
গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন থেকে এটি পাঠকদের জানা যে ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর (বীর উত্তম) কয়েক সপ্তাহ আগেও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। এর আগে তিনি বিএনপি সরকারের আইন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।
গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ডিএমপির রমনা ও নিউমার্কেট থানায় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী ও অজ্ঞাতনামা আরও অনেক আসামির বিরুদ্ধে ককটেল বিস্ফোরণ ও বাস–গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগে একাধিক মামলা রজু হয়, যাতে ব্যারিস্টার ওমর ছিলেন একজন আসামি।
তিনি গত ৪ নভেম্বর গ্রেপ্তার হন। পরবর্তী সময় আদালত থেকে জামিন পেয়ে ২৯ নভেম্বর ব্যারিস্টার ওমর করামুক্ত হন, যদিও অন্য কাউকেই এসব মামলায় জামিন দেওয়া হয়নি। এরই মধ্যে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং ঝালকাঠি-১ আসন থেকে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করার জন্য ৩০ নভেম্বর রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তরে মনোনয়নপত্র জমা দেন।
স্মরণ করা যেতে পারে যে ২০০৫ সালে বিচারপতি এম এ মতিন ও বিচারপতি এ এফ এম আব্দুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীদের হলফনামার মাধ্যমে তাঁদের অপরাধের বিবরণী; শিক্ষাগত যোগ্যতা; অতীতের ও বর্তমান মামলার বিবরণী; নিজেদের এবং নির্ভরশীলদের আয়, সম্পদ, দায়–দেনাসহ আট ধরনের তথ্য মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করে [আবদুল মতিন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ, ৬৬ডিএলআর (২০০৪)]।
পরবর্তীকালে আদালতের এ নির্দেশ হলফনামার মাধ্যমে আট ধরনের তথ্য মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়ার বিধান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর ১২(৩)(খ) ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত হলফনামার ছকে (সংযুক্ত) অপরাধের বিস্তারিত বিবরণীর জন্য টেবিলসহ দুটি বিষয় (২ ও ৩) যুক্ত করা হয়েছে।
ব্যারিস্টার ওমর তাঁর মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দাখিল করা হলফনামার ছকে অতীতের ফৌজদারি মামলার বিবরণী দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমান মামলা সম্পর্কে তিনি কোনো তথ্য দেননি, বরং ‘অভিযুক্ত নথি’র স্থানে তিনি টিক চিহ্ন দিয়েছেন। অর্থাৎ সাম্প্রতিক কালে ডিএমপির অধীন তাঁর বিরুদ্ধে রজু করা মামলা–সম্পর্কিত তথ্য আইনের কোন ধারায় মামলা করা হয়েছে, মামলার নম্বর, যে আদালত মামলাটি আমলে নিয়েছেন, মামলার বর্তমান অবস্থা তিনি গোপন করেছেন।
এ ছাড়া ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের হলফনামায় প্রদত্ত অস্থাবর সম্পদের তথ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় জমা দেওয়া হলফনামায় তাঁর এবং তাঁর স্ত্রীর নামে কৃষি ও অকৃষি জমির দাম দেখানো হয়েছিল ৪৫ লাখ ৮৭ হাজার ৭৬১ টাকা। বরিশাল ও রাজাপুরে মোট ৩টি বাড়ি ও পাকা ভবনের দাম দেখানো হয়েছিল ১ কোটি ৭৮ লাখ ৭০ হাজার ৫০৮ টাকা। এ ছাড়া ঢাকায় একটি খামারের দাম দেখানো হয়েছিল ৪৮ লাখ ২৪ হাজার ৫০৮ টাকা। তবে এবার কোনো স্থাবর সম্পদের হিসাব তিনি তাঁর হলফনামায় দেননি, যদিও তিনি বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া বাবদ ১৯ লাখ ৪৫ হাজার ২৭৭ টাকা আয় দেখিয়েছেন।
নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা ম্যানুয়েলে’ বলা আছে, ‘৩। হলফনামায় ভুল তথ্য প্রদান: গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ অনুসারে হলফনামার মাধ্যমে কোনো প্রার্থী তথ্য প্রদান না করলে অথবা দাখিলকৃত হলফনামায় কোনো অসত্য তথ্য প্রদান করলে...রিটার্নিং অফিসার স্বীয় উদ্যোগে, অথবা...কোনো ব্যক্তি কর্তৃক উত্থাপিত আপত্তির প্রেক্ষিতে তৎ বিবেচনায় সংক্ষিপ্ত তদন্ত পরিচালনা করতে পারবেন এবং কোনো মনোনয়নপত্র বাতিল করতে পারবেন,’ পৃ. ৩৪। অর্থাৎ বর্তমানে রজু করা মামলার তথ্য গোপনের কারণে রিটার্নিং কর্মকর্তার পক্ষ থেকে ব্যারিস্টার ওমরের মনোনয়নপত্র বাতিল করা উচিত ছিল।
কিন্তু রিটার্নিং কর্মকর্তা তথ্য গোপনের কারণে ব্যারিস্টার ওমরের মনোনয়নপত্র তো বাতিল করেনইনি, বরং একটি অভিনব যুক্তি দিয়ে তা বৈধ করেছেন। রিটার্নিং কর্মকর্তা তাঁর সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন যে ‘কোনো মামলায় অভিযুক্ত ও সন্দিগ্ধ শব্দটির মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের চাহিত তথ্য মতে উক্ত মামলায় অভিযুক্ত না হওয়ায় তাঁর মনোনয়নপত্র বিবেচনা করা হলো।’
কিন্তু ব্যারিস্টার ওমরের বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয়েছে এবং যাতে তিনি গ্রেপ্তার হয়ে জামিনে বেরিয়ে এসেছেন, বিচারিক প্রক্রিয়ায় ফলাফল যা–ই হোক না কেন, সে মামলা হলফনামায় রিপোর্ট করা তাঁর জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। অর্থাৎ বর্তমানে করা মামলার বিস্তারিত বিবরণ গোপন করার কারণে ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের মনোনয়নপত্র বাতিল না করে, রিটার্নিং কর্মকর্তা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা করে তাঁর পক্ষে সাফাই গেয়েছেন।
উল্লেখ্য, সারা দেশে রিটার্নিং কর্মকর্তা কর্তৃক মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের পর যে ২ হাজার ৭২০ জন প্রার্থীর তালিকা পাওয়া যায়, তার মধ্যে হলফনামাসংক্রান্ত জটিলতার কারণে ৭৩ জনের প্রার্থিতা বাতিল হয়। কারও কারও প্রার্থিতা বাতিল হয় মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামা জমা না দেওয়ায় কিংবা হলফনামায় স্বাক্ষর না করার অভিযোগে। এর মধ্যে ১৮ জনের প্রার্থিতা বাতিল হয় হলফনামায় অসম্পূর্ণ, অসত্য বা ভুল তথ্য প্রদানের বা তথ্য গোপনের কারণে। আর ২০ জনের প্রার্থিতা বাতিল হয় মামলার তথ্য গোপনের অভিযোগ।
কিন্তু প্রশ্নাতীতভাবে মামলার (এবং সম্ভাব্য সম্পদের) তথ্য গোপন করা সত্ত্বেও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের প্রার্থিতা বৈধ করা হয়, যদিও অন্য ৭২ জনের, যাঁরা তাঁর মতো ভাগ্যবান ছিলেন না, তাঁদের হলফনামায় ত্রুটির কারণে মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নির্বাচন কমিশন ব্যারিস্টার ওমরের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করার কারণটি কি এ দেশের জনগণকে জানাবেন, যা জানার অধিকার তাঁদের রয়েছে?
বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুজন–সুশাসনের জন্য নাগরিক