গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর দেশের মানুষ একটি টেকসই সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা দেখতে চায়। চায় এমন ব্যবস্থা, যেখানে কোন দল অথবা দলীয় প্রধান স্বৈরাচারী হয়ে উঠবে না। যেখানে জনগণের দেওয়া রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভাগাভাগি করা থাকবে। ফলে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকবে। কেউ বাড়াবাড়ি করলে অন্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রিত হবে। যেমন আইনসভা কোন অসাংবিধানিক সিদ্ধান্ত নিলে সেটি বিচার বিভাগের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে।
সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের সব কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে সংসদে। সংসদই হবে সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। সমাধান সংসদীয় ফোরামে হলে সেটি রাজপথে আসে না। রাজপথ যদি রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের প্ল্যাটফর্ম হয়, তাহলে রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের ওপর জনগণের আস্থা থাকে না।
এই নিবন্ধের মূল উদ্দেশ্য হলো, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু হলে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কী সমস্যা হতে পারে, সেই বিষয়ে আলোকপাত করা।
সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থা চালু করা হলে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলগুলো নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করবে। এর মোদ্দাকথা হলো, জনগণ কোনো নির্দিষ্ট প্রার্থীর পরিবর্তে দলীয় প্রতীকে ভোট দেবেন। একটি দল শতকরা যত শতাংশ ভোট পাবে, সেই অনুসারে সংসদে আসন পাবে। অর্থাৎ ৩০০ আসনের মধ্যে এককভাবে সরকার গঠন করতে একটি দলকে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেতে হবে, যা হবে কঠিন। জনগণ চাইলে হতেই পারে। কিন্তু অতীত নির্বাচন দেখলে সেটি সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। যেমন সর্বশেষ সব দলের কাছে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছিল ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন দল নিয়ে যৌথভাবে নির্বাচন করে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৩০টি আসন জিতলেও ভোটের হিসাবে পেয়েছে ৪৮ শতাংশ ভোট।
তাত্ত্বিকভাবে এবং খোলা চোখে সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থা চালু হলে দলগুলোর স্বৈরাচারী ব্যবস্থা কমে আসবে। কিন্তু প্রায়োগিক দিক থেকে সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে আরও জটিল করে তুলতে পারে। প্রশ্ন হলো কীভাবে? উত্তর খুব সহজ। তখন সংসদ সদস্য হতে আর জনগণের কাছে যাবেন না সম্ভাব্য প্রার্থীরা। যাবেন দলের নেতার কাছে। আগে থেকেই টাকা নিয়ে হাজির হবেন। দলের প্রধানরা মোটামুটি নিলামে তুলে প্রতিটি আসনের বিপরীতে টাকা নিয়ে নেবেন। তারপর হবেন সংসদ সদস্য। যেমনটি দেখা গেছে বাংলাদেশে বিদ্যমান সংরক্ষিত নারী আসনের ক্ষেত্রে। এই ব্যবস্থার অন্ধকার দিক অনুসন্ধানের সুযোগ আছে।
২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরের ঘটনা। এ বছর জানুয়ারি মাসের কথা। সংসদের অধিবেশন তখনো বসেনি। আমরা কয়েকজন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর কার্যালয়ে। স্পিকারের চেম্বারে এলেন জাতীয় পার্টির সাবেক একজন সংসদ সদস্য, যিনি সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে ২০১৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত সংসদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এসেছিলেন নিজের জন্য তদবির করে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে আবার নির্বাচিত হতে। তিনি কক্ষে ঢুকেই কী একটা গিফট আইটেম দিতে গেলে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বললেন, ‘দরকার নেই। বলুন।’
বর্তমান নির্বাচনী আসনব্যবস্থার সঙ্গে দেশের মানুষ পরিচিত। রাতারাতি সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে তা দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থা প্রচলনের আগে এর ভালোমন্দ, দেশের প্রেক্ষাপট সবকিছু বিচার–বিশ্লেষণ করেই করা দরকার।
এরপর তিনি স্পিকার মহোদয়ের সঙ্গে গোপনে কথা বলতে চাইলেন। স্পিকার বললেন, ‘আপনি এখানেই বলুন।’ আমাদের দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওরা সাংবাদিক। বলুন, উনাদের সামনেই বলুন। কোনো সমস্যা নেই।’ তদবিরকারী নারী কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে স্পিকার মহোদয়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে কথা বলতে লাগলেন। কিন্তু তিনি যেভাবে কথা বলছিলেন, তাতে আমরা সবাই তাঁর কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। হয়তো বয়সের কারণে তিনি আস্তে কথা বলতে গেলেও জোরে হয়ে যায়, বোঝেন না।
‘আপা, আপনার কাছে এসেছি, আমার জন্য কিছু করা যায় কি না?’ স্পিকার মহোদয় বললেন, ‘আপনি তো জাতীয় পার্টির এমপি হতে চান। সেখানে যান।’ তিনি বললেন, ‘সব কেনাবেচা শেষ। …একজন তো ২৫ কোটি টাকা দিয়ে একটি আসন কিনে নিয়েছে। আমার তো অত টাকা নাই। আমি আট কোটি টাকা পর্যন্ত দিতে পারব। আপনি একটু দেখেন না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যদি আমার ব্যাপারে বলতেন, তাহলে সুবিধা হতো।’ তিনি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘দেখুন, এখানে আমারও কিছু করার নেই। সবকিছুই আপনার দলের ওপর নির্ভর করছে। আপনি কত খরচ করতে পারবেন, সেটি সেখানে বলুন।’ হতাশ হয়ে সেই নারী চলে গেলেন। কিন্তু জানিয়ে গেলেন একটি সত্য কথা।
যদি সাধারণ নির্বাচনও সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থায় করা হয়, তাহলে এমন পরিণতি হতে পারে সে বিষয়ে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু হলে রাজনৈতিক দলগুলো আরও স্বৈরাচারী হয়ে পড়বে। প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণের ওপরে বসে যাবে রাজনৈতিক দলগুলো। এই ব্যবস্থা চালু হলে টাকা এবং নেতার পছন্দের ব্যক্তিরা সংসদ সদস্য হবেন। দেখা যাবে, কোনো জেলা থেকে একাধিক সংসদ সদস্য রয়েছেন। অন্যদিকে কোনো কোনো জেলার কোনো প্রতিনিধি নেই।
সব জেলার প্রতিনিধিত্ব দরকার আছে। একেক জেলার, একেক অঞ্চলের সমস্যা প্রেক্ষাপট একেক রকম, যা স্থানীয় সরকারব্যবস্থা দিয়ে সমাধান করা যাবে না। যেগুলো সমাধানে জাতীয়ভাবে নীতির হস্তক্ষেপ দরকার। সে জন্য সংসদীয় ফোরামে আলোচনা অত্যাবশ্যক। জাতীয়ভাবে আলোচনা দরকার।
বর্তমানে জনগণের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে ৩০০ সংসদ সদস্য নির্বাচনের যে বিধান রয়েছে, সেটির মাধ্যমে প্রতিটি আসনে মনোনয়নের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা হয় এবং এর মাধ্যমে স্থানীয় নেতৃত্ব তৈরি হয়। কিছু নেতা তৈরি হয়। জনগণের ভোট পেতে হলে তাঁদের স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মিশতে হয়। কথা বলতে হয়।
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা চালু হলে জনগণের কোনো সংসদ সদস্য থাকবে না। থাকবে দলীয় প্রধানের আনুগত্য, পোষা সংসদ সদস্য, যাঁদের আনুগত্য থাকবে কেবল দলীয় প্রধানের কাছে। সংসদ হবে দলীয় ক্লাব।
সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে দেখা দেবে আরেক সমস্যা। যদি কোনো সরকারের শতকরা ৫০ ভাগের বেশি আসন না থাকে তাহলে দেখা যাবে, সরকার বাজেটসহ বিভিন্ন আইন পাস করতে পারছে না। আইন পাসের জন্য অন্য দলের শরণাপন্ন হতে হবে। সে সব দল সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন সুবিধা আদায় করে নেবে। উন্মোচিত হবে নতুন দুর্নীতির ক্ষেত্র। এ ছাড়া ছোট দলগুলো কারণে-অকারণে সরকারকে ফেলে দিতে চাইবে এবং কোন সরকারই সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে না।
বর্তমান নির্বাচনী আসনব্যবস্থার সঙ্গে দেশের মানুষ পরিচিত। রাতারাতি সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে তা দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থা প্রচলনের আগে এর ভালোমন্দ, দেশের প্রেক্ষাপট সবকিছু বিচার–বিশ্লেষণ করেই করা দরকার।
কামরান রেজা চৌধুরী সাংবাদিক ও লেখক