গেল শতকের পঞ্চাশের দশকে যাঁরা কেবল জীবিকা নয়, জীবনব্রত হিসেবে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন, তাঁদের একজন ছিলেন তোয়াব খান। সে সময় পত্রিকায় মাস শেষে বেতন-ভাতা পাওয়ার নিশ্চয়তা ছিল না (এখনো অনেক পত্রিকায় নেই)।
তারপরও ভাষা আন্দোলন থেকে নব উত্থিত বাঙালি চেতনা ও মানবমুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে তোয়াব খান ও তাঁর সহযাত্রীরা সাংবাদিকতা পেশাই বরণ করে নিয়েছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ নিষিদ্ধঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন, অন্যরা সরাসরি রাজনীতি না করলেও বামপন্থার প্রতি অনুরাগ ছিল। এ দেশের সাংবাদিকতায় তাঁরাই আমাদের পথিকৃৎ।
তোয়াব খানের সাংবাদিকতা শুরু ১৯৫৩ সালে জনতার মাধ্যমে। এরপর ১৯৫৫ সালে বাম ঘরানার সংবাদ-এ যোগ দেন। এই পত্রিকার বার্তা সম্পাদকও ছিলেন তিনি। সংবাদ-এ তখন ছিলেন শহীদুল্লা কায়সার, রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, সন্তোষ গুপ্তের মতো সাংবাদিক, যাঁদের মাঝেমধ্যেই আইয়ুব-মোনায়েম খানের আতিথ্য নিতে কারাগারে যেতে হতো। বংশাল থেকে উর্দু রোড বেশি দূরে নয়।
১৯৬৪ সালে দৈনিক পাকিস্তান প্রকাশিত হলে তোয়াব খান সংবাদ ছেড়ে সেখানে বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। দৈনিক পাকিস্তান ছিল পাকিস্তান প্রেস ট্রাস্টের পত্রিকা। কিন্তু সেখানে যাঁরা চাকরি করতেন, তাঁদের বেশির ভাগ ছিলেন বামপন্থী—আহমেদ হুমায়ুন, হাসান হাফিজুর রহমান, নির্মল সেন, ফওজুল করিম, আলী আশরাফ প্রমুখ। ছিলেন শামসুর রাহমান ও আহসান হাবীবের মতো খ্যাতনামা কবিও।
দৈনিক পাকিস্তান-এর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি যা-ই হোক না কেন, এর সংবাদ পরিবেশনা ও উপস্থাপনায় নতুনত্ব ছিল। দৈনিক পাকিস্তানই প্রথম চলতি ভাষায় খবর পরিবেশন করে। এর আগে সব পত্রিকা সাধু ভাষা ব্যবহার করত। সত্তরের ঘূর্ণিঝড়ের পর দৈনিক পাকিস্তান–এ সেখানকার জনজীবন নিয়ে ফিচারধর্মী লেখা পাঠককে দারুণভাবে আলোড়িত করত। যেই পত্রিকাটির অফিস উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় মানুষ পুড়িয়ে দিয়েছিল, সেই পত্রিকাই দ্রুত পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে বার্তা সম্পাদক হিসেবে তোয়াব খানের কৃতিত্বই বেশি ছিল ধারণা করি।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধেও তোয়াব খানকে আমরা সাংবাদিক হিসেবে সক্রিয় ভূমিকায় পাই। তাঁর লেখা ‘পিণ্ডির প্রলাপ’ কথিকাটি নিয়মিত প্রচারিত হতো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। পাকিস্তানে অবস্থানরত সুহৃদদের কাছ থেকে তিনি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করতেন। স্বাধীনতার পর তোয়াব খান তাঁর ভাষায় পুরোনো কর্মস্থল দৈনিক বাংলায় (দৈনিক পাকিস্তান–এর পরিবর্তিত নাম) ফিরে আসেন সম্পাদক হিসেবে।
সরকারি পত্রিকার সীমাবদ্ধতার কথা জেনেও তিনি সংবাদ পরিবেশনে বস্তুনিষ্ঠ থাকার চেষ্টা করেছেন। সে সময় দৈনিক বাংলা মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা তথ্য, রাজনৈতিক নেতা ও সম্মুখসারির মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনি ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরেছে, যা আমাদের ইতিহাসের মূল্যবান উপাদান হিসেবে স্বীকৃত। পরবর্তীকালে জনকণ্ঠ–এ এবং নব্বই দশকে বছরখানেক দৈনিক বাংলায়ও তিনি সৃজনশীল সাংবাদিকতার ছাপ রেখেছেন।
১৯৭৩ সালের ২ জানুয়ারি ছাত্র ইউনিয়নের ইউসিস অফিস ঘেরাওকে কেন্দ্র করে পুলিশের গুলিতে দুই ছাত্র নিহত হলে গোটা শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। দৈনিক বাংলা বিশেষ টেলিগ্রাম বের করে পুলিশি হত্যার নিন্দা জানিয়ে। এরপর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি হাসান হাফিজুর রহমান ও সম্পাদক তোয়াব খান চাকরি হারান। পরে তোয়াব খান সাংবাদিকতায় ফিরে এলেও হাসান হাফিজুর রহমানের আর ফেরা হয়নি। তাঁকে মস্কোয় পাঠানো হয় প্রেস মিনিস্টার করে।
দৈনিক বাংলা থেকে চাকরি চলে যাওয়ার পর ১৯৭৩ সালের মে মাসে তোয়াব খান বঙ্গবন্ধুর প্রেস সচিব হন। এ কারণে পরবর্তী সরকার তাঁকে ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে সরিয়ে দেয়। তিনি কখনো প্রধান তথ্য কর্মকর্তা, কখনো পিআইবির ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এরশাদ ক্ষমতায় এলে তোয়াব খান ফের প্রেস সচিবের দায়িত্ব পান। খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের আমলে তিনি দৈনিক বাংলার সম্পাদক পদে ফিরে এলেও বেশি দিন থাকতে পারেননি তাঁর পুরোনো সহযাত্রীদের বিরোধিতার কারণে। ১৯৯৩ সালে জনকণ্ঠ প্রকাশিত হলে তোয়াব খান এর উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শুরুতে পত্রিকাটি অসংকোচ চিত্তে সত্য প্রকাশ করে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। দেশের চারটি স্থান থেকে একই সঙ্গে পত্রিকা ছাপা শুরুও করে জনকণ্ঠ। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলের পর জনকণ্ঠ–এর সম্পাদকীয় নীতি বদলে যায়, জনপ্রিয়তাও কমতে থাকে।
তোয়াব খানের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আমার হয়নি। তবে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁরা তাঁর সময়ানুবর্তিতা, সংবাদ পরিবেশনা ও উপস্থপনার নিজস্ব ভঙ্গির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। অসুস্থ হওয়ার আগপর্যন্ত তিনি সময় ধরে অফিসে আসতেন, রাতে প্রথম সংস্করণ বের করে বাড়িতে যেতেন। বাড়িতে গিয়েও কোন খবরে কী পরিমার্জন আনতে হবে, সে বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। প্রতিবেদন তৈরি থেকে সম্পাদনার কাজে তিনি কনিষ্ঠ সহকর্মীদের হাতে-কলমে শিখিয়েছেন। বিপদে-আপদে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, যদিও সব সময় মালিকের বা সরকারের সঙ্গে পেরে ওঠেননি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি বেসরকারি মালিকানায় পরিচালিত দৈনিক বাংলার সম্পাদক হয়েছিলেন। সে–ও কি তাঁর সেই অতৃপ্তিবোধ থেকে?
পুরো পাকিস্তান আমল ও গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশে পেশাদার সাংবাদিকদের যে কতটা ঝুঁকি ও বৈরিতার মধ্যে কাজ করতে হয়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ তোয়াব খান। সাংবাদিকতা ছিল তাঁর ধ্যান ও জ্ঞান। কিন্তু সাংবাদিকতায় স্থিত থাকতে পারেননি। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত প্রায় ২০ বছর সাংবাদিকতা থেকে নির্বাসিত ছিলেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই আমলেই সরকারি পত্রিকা থেকে তাঁকে বিদায় নিতে হয়েছে।
তোয়াব খান একাধিক পত্রিকার সম্পাদক ও বার্তা সম্পাদক ছিলেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ছিলেন। যখন যে দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়েছে, সুচারুভাবে পালন করেছেন, অন্যদেরও কর্তব্যনিষ্ঠ হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি কখনো কারও সঙ্গে বিরোধে জড়াননি।
প্রায় তিন দশক জনকণ্ঠ–এর উপদেষ্টা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করার পর সেই পত্রিকা থেকে বিদায় নিতে হয়েছে অপমানজনকভাবে। এটি যে কেবল তোয়াব খানের ক্ষেত্রে ঘটেছে, তা-ই নয়। আমাদের অগ্রজ ও সহযাত্রী অনেক সাংবাদিকের জীবনেই ঘটেছে।
তোয়াব খান দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। তারপরও মনে হতো তিনি আমাদের সঙ্গে আছেন। এখন আর সেটি ভাবার সুযোগ নেই।
তোয়াব খানের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি