ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছে গণতন্ত্র মানে ভোট ও ভাতের অধিকার। জাতীয় সংসদসহ সভা-সমাবেশে এই কথা বহুবার শুনেছি আমরা।
আরও শুনেছি, ‘জনগণের জীবনমান উন্নয়ন এবং আশা–আকাঙ্ক্ষার সফল বাস্তবায়নে সংসদীয় গণতন্ত্র সুসংহত হবে, শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে, সবার জন্য সাম্য ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে, সংবিধানের অঙ্গীকার পূরণ হবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
সংসদের বাইরে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কাছে গণতন্ত্র মানে এখন নির্বাচন এবং গায়েবি মামলামুক্ত থাকা। এই সেদিনও ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের (ডিআই) একটা অনুষ্ঠানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘দেখুন কী রকম প্রতারণার কথা বলে যাচ্ছে, আপনারা তো সবাই টেলিভিশন দেখেন, শোনেন। মনে হয় যেন একজন ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির…আমরাই ভালো নির্বাচন করি, আমরাই সত্যিকারের নির্বাচন করি, আমরাই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আর দেখেন, সবার আগে আমাদের অ্যারেস্ট করে তারপরে তারা নির্বাচন করে…ফাঁকা মাঠে করে।’
দুই দল যা-ই বলুক না কেন, দেশের ৯১ শতাংশ মানুষ নাকি বলেছেন গণতান্ত্রিকভাবে শাসিত একটি দেশে বাস করা তাঁদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন নামের একটি অলাভজনক সংস্থার জরিপে এই খবর ছাপা হয়েছে।
এর পরপরই ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক সহিংসতা, দুর্নীতি, বাক্স্বাধীনতায় বাধা, যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের একচেটিয়া ছাত্ররাজনীতি, রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থার অভাব এবং ভোট দিতে না পারার অক্ষমতার কারণে তরুণেরা রাজনীতিবিমুখ। গণতন্ত্রের চর্চার জন্য তরুণদের সোচ্চার হতে হবে।
এসব বয়ানের বাইরে সাধারণ মানুষ কী বলে? ঢাকার একজন গাড়িচালকের কাছে প্রশ্ন ছিল তিনটি। গণতন্ত্র কী? দেশের কী অবস্থা? কী করা যায়? তাঁর জবাব ছিল এমন, নিজের অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারা, ভোট দেওয়া হলো গণতন্ত্র।
দেশে গণতন্ত্রের কী হাল এমন প্রশ্নে বলেছেন, সরকারের বাইরের লোকজনের এসব নিয়ে কথা বলা এখন উচিত না। সমস্যা আছে। তবে ২০০৮ সালে ক্ষমতাসীন দলকে ভোট দিলেও, পরে আর দিতে পারেননি, এ নিয়ে গভীর দুঃখ আছে ভদ্রলোকের। তাঁর মতে, ভোট সুষ্ঠু হলে, কথা বলতে পারলে, গণতন্ত্র আছে, নইলে না।
এই একই প্রশ্নে সরকারি আমলা, বেসরকারি চাকরিজীবী, শিক্ষক ও একজন মুরগি বিক্রেতা একমত হয়েছেন ‘গণতন্ত্র’ জিনিসটা ভালো। যদিও তাঁদের একেকজনের কাছে সংজ্ঞা একেক রকম।
সরকারি আমলা বলেছেন, সব রাজনৈতিক দলের সমান অংশগ্রহণ। দেশে গণতন্ত্র আছে কি না, এমন প্রশ্নে তিনি একটু ঘুরিয়ে জবাব দিয়েছেন। তাঁর মতে, আমাদের সংস্কৃতিতে গণতন্ত্র নেই। পুরো ব্যবস্থাই পিতৃতান্ত্রিক। তার একটা প্রভাব আমরা দেখতে পাই। উত্তরণের পথ শিক্ষা।
বেসরকারি চাকরিজীবীর মতে, গণতন্ত্র নেই। সবাই যদি সব সুযোগে সমান অধিকার পায়, তাহলে গণতন্ত্র হতো। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের মতে, ভোটাধিকার আছে, এমন সবাই ভোট দিয়ে সরকার গঠন করতে পারলে সেটা গণতন্ত্র। দেশে একরকম গণতন্ত্র আছে, তবে উন্নতির সুযোগ আছে। যেমন নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে কাজ করা দরকার। মুরগি বিক্রেতা বলেছেন, গণতন্ত্র মানে ভোট। দেশে গণতন্ত্র নেই। এক দল, এক দফা। ভোট হলে ভালো হয়। এর আগে ভোট দিতে গেছেন। গিয়ে দেখেছেন, ‘ভোট আর কেউ নিছে গা।’
সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথোপকথনের ভিত্তিতে দেখা যাক, দেশে গণতন্ত্রের অবস্থা কী। নিউইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার স্টিভেন লেভিটস্কি ও ড্যানিয়েল যিবলাট ‘হাউ ডেমোক্রেসিস ডাই’ (গণতন্ত্র কীভাবে মরে) এ দেশে গণতন্ত্র গোল্লায় গেছে কি না, বোঝার জন্য কিছু শর্তের কথা বলা হয়েছে। চলুন মিলিয়ে দেখি।
শর্ত নম্বর ১: গণতন্ত্রের শর্ত পূরণে অনীহি। যেমন:
ক. তারা কি সংবিধানকে প্রত্যাখ্যান করছে, অথবা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে?
খ. তারা কি অগণতান্ত্রিক পন্থাকে বেশি পছন্দ করছে? যেমন নির্বাচন না হতে দেওয়া, সংবিধানকে এড়িয়ে যাওয়া বা স্থগিত রাখা, কিছু সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা অথবা নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা?
গ. তারা কি সংবিধানবহির্ভূতভাবে, সহিংস অভ্যুত্থান বা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করতে চায়? ঘ. তারা কি সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত ভোটের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন তোলে?
শর্ত নম্বর ২: বিরোধী দলের বৈধতা অস্বীকার করা। যেমন:
ক. তারা কি বিরোধী দল ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত বলে দাবি করে?
খ. বিরোধী দল দেশের অস্তিত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা বা জনজীবনকে হুমকিতে ফেলছে বলে প্রচার চালায়?
গ. ভিত্তিহীনভাবে তারা কি বিরোধী দলকে অপরাধী, আইনভঙ্গকারী বলে দাবি করে এবং এভাবে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধা সৃষ্টি করে?
ঘ. তথ্য–প্রমাণ ছাড়া বিরোধী পক্ষকে বিদেশি শক্তির প্রতিনিধি অভিযুক্ত করে?
শর্ত নম্বর ৩: অসহিষ্ণুতা অথবা সন্ত্রাসে উসকানি। যেমন:
ক. তাদের কি অস্ত্রধারী লোকজন, আধা সামরিক বাহিনী ইত্যাদির সঙ্গে ওঠবস আছে?
খ. এই দল ও তাদের মিত্ররা কি বিরোধী শক্তির ওপর হামলায় উসকানি দেয়?
গ. তারা কি বিরোধী দলের ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা জানানো বা শাস্তি নিশ্চিত করার ব্যাপারে মৌন থাকে?
ঘ. তারা কি দেশের ভেতরে বা বাইরে অতীতে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক সহিংসতার প্রশংসা করে কথা বলে?
শর্ত নম্বর ৪: ভিন্নমত দমনে নাগরিক অধিকার, বিশেষ করে সংবাদমাধ্যমের অধিকার ক্ষুণ্ন করে। যেমন:
ক. তারা কি এমন আইন ও নীতি পছন্দ করে, যা নাগরিক অধিকারকে সংকুচিত করে, যেমন মানহানিসংক্রান্ত আইনের পরিসর বাড়ানো বা এমন কোনো আইন করা, যা প্রতিবাদ কর্মসূচি, সরকারের সমালোচনা অথবা নাগরিক ও রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে?
খ. তারা কি সমালোচনার কারণে বিরোধী দল, নাগরিক সমাজ ও সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছে বা মামলা করেছে?
গ. তারা কি সরকারের দেশের ভেতরে বা বাইরের নিপীড়নমূলক কাজকে বাহবা দেয়?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে মনের মধ্যে রেখে দিন। কারণ, যে পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলে দেশের গণতন্ত্রের হালহকিকত বোঝার চেষ্টা করি, তাঁদের কেউই নাম প্রকাশ করতে চাননি ভিন্ন ভিন্ন কারণে।
তো এই অবস্থা জারি রাখতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের রাষ্ট্রনায়কেরা কী করেছেন, তার একটা খোঁজ করা যাক। ব্রুস বুয়েন ডি মেসকুয়েটা ও অ্যালেসটেয়ার স্মিথের দ্য ডিক্টেটরস হ্যান্ডবুকে এর বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যেতে পারে।
বইটিতে আছে, একজন নেতা তিন ধরনের জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করেন। প্রথম দলে আছেন আম সমর্থক। তাঁরা নির্বাচনে ভূমিকা রাখেন, তবে এই পক্ষটি কমজোরি। দ্বিতীয় দলে আছেন, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যাঁদের বলা যায় সংসদ সদস্য। তাঁরা প্রভাবশালী। তবে তাঁদের ওপরেও আরেক দল আছে। তাঁরা নেতাকে জিতিয়ে আনেন, ক্ষমতায় রাখেন। নেতার জন্য এই দলটি অপরিহার্য। সফল নেতা এই তিন দলকে চোখের ইশারায় নিয়ন্ত্রণ করেন। এ জন্য কিছু শর্ত মানেন।
যেমন অপরিহার্যদের জোট হতে হবে ছোট। আর আম সমর্থক হবে বিশাল। যেন কেউ একটু ত্যাড়ামি করলেই তাঁকে বাদ দিয়ে আর কাউকে সামনে আনা যায়।
টাকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কে খাবেন, কে খাবেন না, সেটা নেতা নির্ধারণ করে দেবেন। নেতাকে খুশি করতে হবে ‘অপরিহার্য’ অংশকে। এত খুশি যেন অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের কাছে গিয়ে তারা ঘুরঘুর করতে না পারে। এ জন্য রবার্ট মুগাবের জীবনী পড়তে হবে। আর সবশেষ কথা হলো, সমর্থকদের পকেট থেকে টাকা নিয়ে সাধারণের মধ্যে বিলানো যাবে না। কারণ, ভুখা মানুষ বিপ্লব করতে পারে না।
এবার মনে মনে নিজ নিজ নেতার কথা ভাবুন, মিলিয়ে নিন তিনি সফল কিনা।
শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ই–মেইল: [email protected]