গত ৭ অক্টোবর হামাসের সন্ত্রাসী হামলা এবং এরপর গাজায় বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ভয়ংকর জবাবের প্রেক্ষাপটে বহুকাল ধরে অনুচ্চারিত কিছু বিষয় উচ্চারণ করা প্রয়োজন বলে মনে করি। প্রথমত, ইসরায়েল হামাসকে ধ্বংস করতে পারবে না, এমনকি গাজাকে ধুলার সঙ্গে মিশিয়ে দিলেও নয়।
ইসরায়েল হামাসকে সামরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে সক্ষম হয়েছে, তাদের টানেলগুলো গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি হামাস যোদ্ধারা পালাচ্ছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, হামাস হলো আন্দোলনের নাম, মতাদর্শের নাম। অন্যভাবে বলতে গেলে নেতানিয়াহুর উগ্রপন্থী আচরণ হামাসকে আরও এগিয়ে দিয়েছে।
ইসরায়েলের দক্ষিণপন্থী সরকার, এমনকি ইয়াসির আরাফাতের মধ্যপন্থী দল, ফাতাহর সঙ্গেও আলাপ-আলোচনায় বাধা দিয়েছে। দুই যুগের বেশি সময় আগে ২০০০ সালে ক্যাম্প ডেভিড সম্মেলনের পর থেকে তারা আর আলোচনার টেবিলে বসেনি।
ধারাবাহিকভাবে গাজার বাসিন্দাদের ওপর তারা নির্যাতন চালিয়ে গেছে, সার্বক্ষণিক অবরোধ জারি রেখেছে, ফলে যা হওয়ার তা–ই হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনিরা হতোদ্যম হয়ে চরমপন্থী হামাসে যুক্ত হবে, তাতে আশ্চর্য হওয়ারই–বা কী আছে?
আধুনিক যুগের সব যুদ্ধ-দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মূল কথা হলো শক্তিশালী পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে অনাচার রোধে ব্যর্থ হলে উগ্রপন্থার উত্থান ঘটে। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে উত্তর আয়ারল্যান্ডের একটি সংঘাতময় অতীত আছে। রাজনীতি যখন অকার্যকর হয়ে যায়, সহিংসতা তখন সেই শূন্যস্থান পূরণ করে।
যুক্তরাজ্য দশকের পর দশক গোঁ ধরে বসেছিল যে তারা আইআরএর সঙ্গে আলোচনায় বসবে না। কারণ, তারা সন্ত্রাসী সংগঠন। কিন্তু ১৯৯৮ সালে যখন তারা আলোচনায় বসল তখনই গুড ফ্রাইডে চুক্তি হলো। রাজতন্ত্রের প্রতি আজ্ঞাবহদের এই চুক্তি হজম করতে কষ্ট হচ্ছিল, তবুও এই চুক্তিকে সমর্থন দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ও ইইউ প্রেসিডেন্ট। তাঁদের উত্তরাধিকারীরা অবশ্য এই চুক্তির মূলভাব থেকে সরে এসেছেন, তাঁদের ওসব মনেই নেই।
এখন বৈশ্বিক উত্তরের দেশগুলো সমঝোতার টেবিলে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে বসাতে চাইছে। যে দলটি বহু আগেই জনপ্রিয়তা খুইয়েছে, সে দলের সঙ্গে আলোচনা কোনোভাবেই ফলপ্রসূ হতে পারে না। স্বাধীনতাকামী জনগণের ওপর বৈশ্বিক উত্তরের সরকারগুলো বরাবর তাদের পছন্দসই প্রার্থীকে বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু হামাসকে অবশ্যই এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হবে।
সর্বোপরি, সমাধানটা হতে হবে রাজনৈতিক। ফিলিস্তিনিরা যে বর্ণের হোক না কেন, ইসরায়েলকে সামরিকভাবে পরাজিত করতে পারবে না। আবার ইসরায়েলিরাও ফিলিস্তিনিদের যুদ্ধে পরাজিত করতে পারবে না। টনি ব্লেয়ারের সাবেক চিফ অব স্টাফ জোনাথন পাওয়েল ‘টকিং টু টেররিস্টস’ নামে একটি অসাধারণ বই লিখেছেন। তিনি বলেছেন, আলাপ-আলোচনা ছাড়া এ ধরনের সংঘাতের সমাধান হয় না। তা ছাড়া জনসমক্ষে নেতানিয়াহু, জো বাইডেন বা ঋষি সুনাক যা-ই বলুন না কেন, তাঁরা তো জিম্মি ও বন্দীর মুক্তি বিষয়ে হামাসের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন। যদিও মীমাংসার জন্য মাঝখানে কাতার থাকছে।
ইসরায়েলের দক্ষিণপন্থী নেতারা আলাপ-আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁরা বরং ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলোর ওপর দখলদারি কীভাবে আরোপ করা যায় এবং ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে তাঁদের পদাবনত করা যায়, সেই ছক আঁকতে ব্যস্ত। পশ্চিম তীর ও ছোটখাটো দ্বীপগুলো নামকাওয়াস্তে ফাতাহর শাসনে ছিল (ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত)। সেখানে এখনো প্রায় পাঁচ লাখ ইহুদির বসতি আছে।
পূর্ব জেরুজালেমে এখন প্রায় আড়াই লাখ ইসরায়েলি বসতি করেছেন। বৈশ্বিক উত্তরের নেতারা হাত ঘষছেন। তাঁরা মৃদু স্বরে বলে থাকেন, এসব বসতি অবৈধ কিন্তু কিছুই করেন না। তাঁরা বসতি স্থাপনকারীদের ক্রমেই দীর্ঘ হতে থাকা দখলদারি এবং গাজার প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াকে সয়ে নিয়েছেন।
এর বিনিময়ে ইসরায়েল কী পাচ্ছে? আরও বেশি নিরাপত্তা? না। কী হতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ৭ অক্টোবর। ইসরায়েলের দক্ষিণপন্থী শাসকেরা নিজস্ব জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। আর এখন যে নির্দয় তাণ্ডবলীলা গাজায় চালাচ্ছে, তা তাদের আরও বিপন্ন করে তুলবে।
ইসরায়েলে সাবেক লেবার সরকারের পরামর্শক ড্যানিয়েল লেভি সম্প্রতি এক টিভি সাক্ষাৎকারে যথার্থই বলেন, ‘যত দিন না ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত ইসরায়েলের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা যাবে না। অপর একটি জাতির ওপর আপনি কাঠামোগত নির্যাতন করে যাবেন, তাঁদের মৌলিক অধিকার বঞ্চিত করবেন এবং নিরাপদে থাকবেন— এভাবে হয় না। কারণ, আপনি যখন একটি জাতির ওপর নির্যাতন চালাবেন, তখন বুঝে নিতে হবে নির্যাতনের প্রত্যুত্তর পাওয়ার ইচ্ছা আছে আপনার। আপনি নিশ্চিন্তে রাতে ঘুমাতেও পারবেন না।’
অবশ্যই ইসরায়েলের বর্তমান মন্ত্রী পরিষদের ইচ্ছা হলো ফিলিস্তিনিদের তাঁদের মূল ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে জর্ডান ও মিসরে পাঠিয়ে দেওয়া। অল্প কিছুদিন আগে নেতানিয়াহুর রাষ্ট্রদূত যুক্তরাজ্যে সোজাসুজি বলে দিয়েছেন, দুই রাষ্ট্রভিত্তিক কোনো সমাধান তাঁরা চান না। ফলে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান হবে না। শুধু ইসরায়েলি দখলদারি অব্যাহত থাকবে আর ক্রমেই বাড়বে সহিংসতা ও আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা।
লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল ইসরায়েলের নিরাপত্তা ও ফিলিস্তিনিদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রত্যয়কে নিশ্চিত করা। যদি দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান কার্যকারিতা হারায়, তাহলে কনফেডারেশন হতে পারে না? যেখানে ফিলিস্তিনিরা তাঁদের নিজেদের শাসক নিজেরা বাছাই করে নেবে আর ইসরায়েলিরা নিরাপত্তা উপভোগ করবেন?
ওয়াশিংটন ডিসি, লন্ডন ও ইউরোপ ভয়াবহ পতনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরিবর্তে আঞ্চলিক সম্মেলনের আয়োজন করতে পারে। এই সম্মেলনে ইসরায়েল, মিসর, সৌদি আরব এবং জর্ডান, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে অবশ্যই ইরানকে রাখতে হবে। কারণ, সব পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করা না হলে এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আসবে না।
এক বছর ধরে চলা ব্যর্থ রাজনীতির পর আমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি যে নেতাদের ওপর নির্ভর করা চলে না। আশার কথা, আমাদের জন্য আমরা আছি।
বারাক ওবামার মেয়াদ ছাড়া এই অঞ্চলের সঙ্গে কখনোই গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক কার্যক্রম বা যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার কোনো চেষ্টা ছিল না। ওবামার প্রতিনিধি জন কেরি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘পররাষ্ট্রনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকার ঝুঁকি সম্পর্কে লেখা প্রায় হয়ই না। মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি আলোচনার বেলায় এই কথা সর্বৈব সত্য।’
আমি এই লেখা লিখছি কেপটাউন থেকে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব মানুষ বৈশ্বিক উত্তরের নেতাদের দ্বিচারিতায় ঘৃণা জানাচ্ছে। কারণ, তারা ইউক্রেনের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের কথা বলে, অন্যদিকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। গাজার এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য তারাও দায়ী। বৈশ্বিক দক্ষিণের সঙ্গে তাদের ভূরাজনীতিক সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পথে। এর খেসারত ওয়াশিংটন, লন্ডন ও ব্রাসেলসকে ভালোভাবেই পোহাতে হবে।
অন্যদিকে আমি ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি দুই পক্ষেরই বন্ধু। এর অর্থ কোনো একপক্ষে থাকা নয়, বরং বলা যে যদি তারা একত্রে থাকতে পারে, তাহলেই তাদের ভবিষ্যৎ আছে, নইলে কোনো ভবিষ্যতের যোগ্য নয় তারা।
লর্ড হাইন যুক্তরাজ্যের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সাবেক মন্ত্রী এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ