ব্রিটেনের রানির মৃত্যুতে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালন করলো বাংলাদেশ। তাঁর শেষকৃত্যে এই রাষ্ট্রের সরকারপ্রধান পর্যন্ত উপস্থিত হন, কিন্তু পঞ্চগড়ের করতোয়ার পাড়ের লাশের মিছিল দেখেও কেউ দায় নিলেন না! এই দেশে গরিব মানুষকে কী চোখে দেখে ওপরতলার মানুষেরা, এটা তার একটা বড় উদাহরণ হয়ে থাকল। তাঁরা বুঝিয়ে দিলেন, সব মৃত্যু নয় সমান। অপমৃত্যুর যোগ্য সবাই হতে পারলেও শোকের যোগ্য সবাই নয়! আবেগী জাতি বলে আমরা খ্যাতনামা হলেও সেই আবেগের স্রোতও হিসেব করেই বয়। ফেসবুক থেকে রাষ্ট্রসভা কোথাও কোনো তেমন শোক ও প্রতিবাদ দেখা গেল না।
আমেরিকার চাইতেই–বা আমরা কম কিসে। আমেরিকায় ঘূর্ণিঝড় ইয়ান ৮৩ জন মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে। আর বাংলাদেশের পঞ্চগড়ের ছোট নদী করতোয়াতেই ঘটেছে ৭১ জন মানুষের করুণ মৃত্যু। এই মানুষগুলোর পরিবারে দুর্গাপূজার উৎসব নিমেষেই মাতমে পরিণত হয়েছে। বিধবারা সাদা শাড়ি গায়ে চড়িয়েছেন, সন্তানহারা অভিভাবক স্তব্ধ হয়ে গেছেন, পিতাহারা বালক মাথা কামিয়ে ফেলেছে। স্বজনেরা শূন্য চোখে এখনও লাশের খোঁজে নদীর পাড়ে ভীড় করেন। উন্নয়নের গর্বে গর্বিত সরকারি লোকজনের আগেই নদীতীরের মানুষেরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কে কার কে, কার কী ধর্ম, তা এ রকম মুহূর্তে মানুষেরা মনে রাখে না। জীবন বাঁচানোই তখন ফরজ।
পঞ্চগড়ের প্রশাসন কি জানত না যে প্রতিবছর বিপুল মানুষ এ ধর্মীয় উৎসবের সময় নদী পারাপার হয়? যদি জানত, তাহলে চলাচল নিরাপদ করার জন্য কী করা হয়েছিল, সেই প্রশ্ন আসবে। আর যদি বলি তাঁরা জানত না, তাহলে বলতে হয় তাহলে তাঁরা আছেন কেন?
আমেরিকায় এত মানুষের মৃত্যুর জন্য দরকার হয়েছিল শতাব্দীর সেরা এক ঘূর্ণিঝড়ের। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন বলছে, এত মারাত্মক ঘূর্ণিঝড় আমেরিকা গত ১০০ বছরে দেখেনি। কিন্তু বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় বা ভূমিকম্প লাগে না। অবহেলাজনিত আগুন কিংবা নৌকাডুবির ঘটনাই যথেষ্ট। আমাদের এক মন্ত্রী বলেছিলেন, আমরা নাকি করোনা মহামারির চেয়েও শক্তিশালী। তাঁর এই দাবির সত্যতা জনতা জীবন ও যন্ত্রণা দিয়ে বুঝেছে। তবে আমাদের কর্তৃপক্ষীয় অবহেলা যে ঘূর্ণিঝড়ের চেয়ে কম শক্তিশালী, তা পঞ্চগড়ের নৌকাডুবির ঘটনার পরে আর বলা যাবে না।
পঞ্চগড়ের প্রশাসন কি জানত না যে প্রতিবছর বিপুল মানুষ এ ধর্মীয় উৎসবের সময় নদী পারাপার হয়? যদি জানত, তাহলে চলাচল নিরাপদ করার জন্য কী করা হয়েছিল, সেই প্রশ্ন আসবে। আর যদি বলি তাঁরা জানত না, তাহলে বলতে হয় তাহলে তাঁরা আছেন কেন? রাষ্ট্র তো নাগরিকের জন্য। সরকার-প্রশাসন তো নাগরিকের জন্যই থাকার কথা। নাকি সরকার-প্রশাসন যেহেতু আছে সেহেতু নাগরিকদের তো থাকাই লাগে? না হলে কাদের জন্য তাঁরা বাণী বর্ষণ করবেন, কাদের জন্য রাতের ঘুম হারাম করবেন! কাদের সম্পদ শুষে ধনী হবেন ক্ষমতার কাছের লোকজনেরা?
রাষ্ট্র-সরকার-প্রশাসন আছে বটে, তারা দেশের মানুষকে মানুষ মনে করে না, নাগরিক মনে করে না। মানুষকে মনে করে খরচযোগ্য। গত বছর নারায়ণগঞ্জের হাশেম ফুডসের অবহেলাজনিত ও কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডে পুড়ে মারা গেল ৫৫ জন শ্রমিক…নাহ পরিসংখ্যান দিয়ে কী লাভ? যেখানে একজন মানুষের জীবন রক্ষা করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব, একজন মানুষের অপঘাতে মৃত্যুর জবাবদিহি করাও সরকারের দায়িত্ব, সেখানে শত-হাজার মানুষের প্রতি চরম অবহেলার কথা তুলে কী লাভ? যাদের কাছে সাধারণ মানুষের দাম নেই, তাদের কাছে ১ জনই–বা কী, ১০০ জনই–বা কী। যদি প্রতিটি মানুষকে সমান বলে মনে করা হতো, রাষ্ট্র যদি সবার জন্য হতো, তাহলে আলাদা করে এখানে বা সেখানে মানুষ বাঁচানোকে বিশেষ কাজ বলে মনে করা হতো না। মনে করা হতো, সেটাই স্বাভাবিক কর্তব্য। আমাদের একটি রাষ্ট্র আছে বটে, কিন্তু তা সম্ভবত নাগরিকদের দরকারে নয়। যখন একটা দেশের শাসকেরা নাগরিকদের জীবনকে তুচ্ছ মনে করে, তাদের মৃত্যুতে নির্বিকার থাকে, তখন তাকে আর রাষ্ট্র বলে না, তাকে বলে সিন্ডিকেট, তাকে বলে নৈরাজ্যের নৈরাষ্ট্র। এ অবস্থায় জনগণ আর অধিকারভোগী নাগরিক থাকতে পারে না, তারা হয়ে ওঠে নৈরাষ্ট্রের নৈনাগরিক।
এটা শুধু ধনী-গরিবের মধ্যে শোক ও দায়িত্বের বৈষম্যই না, এই বৈষ্যম্য গ্রাম-শহরেরও। ঢাকাকেন্দ্রিক গণমাধ্যমে শহরে অপঘাত, দুর্ঘটনা বা খুন-ধর্ষণ যতটা আলোচিত হয়, গ্রামের একই রকম ঘটনা ততটা মনোযোগের আলো পায় না। ঢাকার কাছের রূপগঞ্জের আগুন দেখাতে গণমাধ্যম ছুটে গিয়েছিল কিন্তু পঞ্চগড়ে আরও বেশি মানুষের মৃত্যু তেমন আগ্রহ পায়নি। পুলিশও তরিকা বুঝে গেছে। তারা ভোলায় বা মুন্সিগঞ্জে বা নারায়ণগঞ্জে গুলি করে বিএনপিকর্মী হত্যা করে; কিন্তু ঢাকায় গুলি করার আগে ভাবে। এসব দেখে দেখে কেউ যদি বলে যে জাতীয় গণমাধ্যম বলে কিছু নেই, সবই ঢাকার গণমাধ্যম। আরও যদি কেউ বলে যে আসলে জাতীয় সরকার, জাতীয় গণমাধ্যম, গণপ্রজাতন্ত্র এসব আসলে কিছু না, সবই আসলে ঢাকাকেন্দ্রিক অভিজাত ও ক্ষমতাবানদের রাষ্ট্র, সরকার ও মিডিয়া। বললে কি ভুল বলা হবে? যদিও স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়ে গেছে।
এ জন্যই বলা হয়, যেমন শাসক তেমনই জনগণ। এবং এটাও বলা হয়, দীর্ঘকালের নির্দয় শাসন জনগণকেও নির্দয় করে ফেলে। যে জাতি তার শাসক বদলাতে পারে না, সেই জাতিকে বদলে দেয় ওই শাসকেরাই। না হলে এমন নির্দয়তার আর কী ব্যাখ্যা থাকতে পারে? কারাগারে এমনও হয়। সেখানে বন্দীরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে, নিজেদের নিয়ে নিষ্ঠুর কৌতুক করে। মানুষের মৃত্যু সেখানে তুচ্ছ হয়ে দেখা দেয়।
কারাগারে এমন হয়। বন্দিদশা থেকে মুক্তি হওয়া অসম্ভব ভেবে কয়েদিরা বিশ্বাস করে যা চলছে তা-ই চলবে। কোনো বিকল্প তো নেই! বিকল্প না থাকার অসহায়ত্বে তারা সামান্য কিছু নিয়েও বিনোদনে মেতে উঠতে চায়। বিকল্প খোঁজার আলস্যের আষাঢ়-শ্রাবণে ভিডিও গীতগোবিন্দ উপভোগ করাই ডিজিটাল বন্দী মনের বিকল্প ও বিকার।
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও প্রতিচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক।
[email protected]