একবার ভেবে দেখুন, আমাদের চারপাশে কিন্তু চিন্তার অনেক উপকরণ ছড়ানো। করোনার প্রভাবে নাকাল বিশ্ব অর্থনীতি। বিশ্বজুড়ে চলছে খাদ্যসংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নিষ্পত্তি হচ্ছে না, কড়া নাড়ছে বৈশ্বিক মন্দা। এর ফলে যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তা আমাদের রাতের ঘুম হারাম হওয়ার জন্য যথেষ্ট। পুরোনো লোডশেডিং নতুন করে ফিরে এসেছে, বিদ্যুৎ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারি অফিস-আদালতে নতুন সময়সূচি ঘোষণা করা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করা হয়েছে, জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা চারদিকে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আকাশ ছুঁয়েছে।
এই যে এত এত চিন্তার ইস্যু তার কোনো কিছুই যেন একটি সুবিশাল জনগোষ্ঠীকে স্পর্শ করে না। তাদের চিন্তাভাবনার দিগন্ত যেন একটি প্রান্তেই আটকে গেছে; আর সেটি হলো নারীর পোশাকের প্রান্ত। নারী কী পোশাক পরল, কেন পরল, কোথায় পরল, কীভাবে পরল, পোশাকের কার্যকারণ ও ফলাফল ইত্যাদি নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে করতে তাদের হাঁসফাঁস অবস্থা। নারীর পোশাক নিয়ে ভীষণ চিন্তিত এই জনগোষ্ঠী সংখ্যায় দিন দিন বাড়ছে। নারীর পোশাক নিয়ে তাদের যত চিন্তা তার কিয়দংশ যদি জাতীয় সমস্যার সমাধান নিয়ে থাকত, তাহলে টার্গেটের অনেক আগেই ‘উন্নত দেশ’ হিসেবে হয়তো স্বীকৃতি পেত বাংলাদেশ।
প্রগতিশীলতার আড়ালে নারীর পণ্যরূপ কিংবা নিরাপত্তার অজুহাতে জোরপূর্বক নারীর মোড়কবন্দী রূপ—দুটোই নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথকে সংকীর্ণ করে দেয়। ঠুলি পরে থাকা সমাজের চোখে পোশাক নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি চলছে, চলবে। তাই সম্মান জানাই সব তর্কবিতর্ককে পায়ে ঠেলে সামনে এগিয়ে চলা প্রতিটি আত্মপ্রত্যয়ী নারীকে। নারীর সক্ষমতা আর আত্মপ্রত্যয় একদিন সব ষড়যন্ত্রের অবসান ঘটাবে নিশ্চয়ই।
মনে পড়ে কয়েক মাস আগে অফিসের কাজে সিলেট গিয়েছিলাম। সঙ্গে ছিলেন কয়েকজন নারী সহকর্মী। এক বিকেলে সেখানকার একটি রেস্টুরেন্টে চা-নাশতা করতে বসেছিলাম। কোনো একটা জরুরি প্রয়োজনে খাওয়া শেষ না করেই অন্যদের রেস্টুরেন্টে রেখে হোটেলে ফিরতে হয়েছিল আমাকে। পরে শুনলাম, রেস্টুরেন্টে খেতে বসা বেশ কিছু পুরুষ আপত্তি তোলায় নাকি আমার নারী সহকর্মীদের বসার স্থানটি পর্দা টেনে আড়াল করা হয়েছিল। যদিও আমার সঙ্গে থাকা নারীরা সবাই ছিলেন অন্য ধর্মের অনুসারী।
পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বাধীনতা তো বটেই, অনেক ক্ষেত্রে অন্য ধর্মের অস্তিত্ব এবং ভিন্ন জীবন দর্শনকেও ভুলে যাই আমরা। যাঁরা বাংলাদেশে রেস্টুরেন্টে বসে পাশের টেবিলের নারীদের পোশাক নিয়ে আপত্তি তোলেন এবং তাদের দৃষ্টিসীমার আড়াল করতে চান, তাঁরা পশ্চিমের কোনো দেশে গেলে সেটি করতে পারবেন তো?
প্রকৃতপক্ষে, জবরদস্তি তখনই করা যায়, যখন জবরদস্তিকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয় সমাজ, কিংবা জবরদস্তিকারীকে সমর্থন এবং আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার মতো প্রভাবশালীরা থাকেন সমাজে। এই প্রভাবশালীদের চিন্তাচেতনার প্রতিফলন ঘটে পাঠ্যবইয়ের প্রচ্ছদে-অলংকরণে কিংবা নারী চরিত্র নির্ধারণ ও তার বর্ণনায়। এই প্রভাবশালীদের খুঁজে পাওয়া যায় আদালতের রায়ের বর্ণনায়, সংসদের বক্তব্যে, মন্ত্রণালয় ও সচিবালয়ের নানা সিদ্ধান্তে, জনসমাবেশের বক্তব্যে, স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কোনো কোনো শিক্ষকের বক্তব্যে ও আচরণে।
ধর্মীয় মূল্যবোধ মেনে চলা হোক বা পোশাকে নিরাপত্তা খোঁজার চেষ্টার কারণে হোক, দেশে নারীদের মধ্যে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে পোশাক পরার প্রবণতা বেড়েছে। পোশাক নারীকে নিরাপত্তা দেয়—তাঁদের এমন যুক্তি যদি মেনে নিই, তাহলে বলতে হয়, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে পোশাক পরার ফলে তো কমার কথা ছিল যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো ঘটনাগুলো। কিন্তু পরিসংখ্যান বলে, জ্যামিতিক হারে শুধু বেড়েই চলেছে এ ধরনের সহিংসতা। কিছুতেই কমছে না ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের ঘটনা।
বাস্তবতা হলো, আজ পর্যন্ত নারীর জন্য এমন কোনো পোশাকের আবির্ভাব হয়নি, যা নারীকে মূল্যায়নের ঊর্ধ্বে রেখেছে কিংবা তাকে নিরাপত্তা দিয়েছে। কারণ, পোশাক কখনোই নারীকে নিরাপত্তা দেয় না, অতীতেও দেয়নি, আর ভবিষ্যতেও দেবে না। যে কারণে শিশুদের পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হতে দেখি আমরা। তাহলে নারীর নিরাপত্তা সরাসরি তার পোশাকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলা যায় কি? এটি বরং পুরোপুরি সম্পর্কযুক্ত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর; যা ধারক ও বাহক নারী-পুরুষ উভয়ই।
প্রায়ই লক্ষ করি, পোশাকের ধরন কীভাবে নারীর গতিবিধি ও আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। শাড়ি বা যে কোনো লম্বা পোশাকে যে নারী রোজ রাজপথে হাঁটেন, তাঁর লম্বা পোশাকের ঝুলটি মাটিতে লুটোপুটি খায়, তিনি চাইলেই দৌড়ে বাসে উঠতে পারেন না। তাঁর ভারী পোশাকের নানা অংশ আটকে যায় বাসের দরজায়, সিঁড়িতে কিংবা সিটের অমসৃণ হাতলে। ঢিলেঢালা পোশাকের আবরণের মধ্যেও সামান্য বাতাসে সরে যাওয়া কাপড় ক্ষিপ্রগতিতে ঠিক করে মাতৃত্বের চিহ্ন ঢাকতে দেখেছি অনেক অন্তঃসত্ত্বা মাকে। শাড়ি, হিজাব, বোরকা, সালোয়ার-কামিজ, জিনস-টপস কিংবা প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের কোনো পোশাকই আজ পর্যন্ত নিরাপত্তার সনদ এনে দিতে পারেনি নারীকে। এ যদি হয় বাস্তবতা তবে কী লাভ নারীর পোশাক নিয়ে এত তর্কবিতর্ক করে।
একবার গণপরিবহনে নারীর প্রতি যৌন হয়রানিবিষয়ক এক গবেষণার অংশ হয়েছিলাম। তখন কথা হয়েছিল বিভিন্ন ধরনের পোশাক ব্যবহারকারী নারীর সঙ্গে। সেই গবেষণায় আমি একজন নারীকেও খুঁজে পাইনি, যিনি পোশাক নিয়ে কখনো বিব্রতকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হননি। নারীর পোশাক বিতর্ক কিন্তু শুধু পোশাক নিয়ে কথা বলে না। বরং নারীর পোশাকের আলোচনার গভীরে থাকে পুরুষতন্ত্রের রাজনীতি; যা নিয়ন্ত্রণ করে নারীর শরীর, নারীর চলাচল ও স্বাধীনতা। সেই রাজনীতির গন্তব্য একটাই; তা হলো পুরুষের আধিপত্য, কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ। নারীর কাপড় সামান্য সরে গেলেই যে চোখগুলো ছি ছি করে, সেই একই চোখগুলো রোজ পথের ধারে অগুনতি পুরুষের মূত্রত্যাগের কুরুচিপূর্ণ দৃশ্য দেখে নির্লিপ্ত থাকে। যে পুরুষ মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে লুঙ্গি ঝাড়তে ঝাড়তে গিঁট মারে তা কতটুকু শ্লীল, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না। কারণ, পুরুষতন্ত্রের কাছে মাথা নত করা সমাজের চোখে এসবই স্বাভাবিক ও প্রশ্নাতীত।
প্রগতিশীলতার আড়ালে নারীর পণ্যরূপ কিংবা নিরাপত্তার অজুহাতে জোরপূর্বক নারীর মোড়কবন্দী রূপ—দুটোই নারীর এগিয়ে যাওয়ার পথকে সংকীর্ণ করে দেয়। ঠুলি পরে থাকা সমাজের চোখে পোশাক নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি চলছে, চলবে। তাই সম্মান জানাই সব তর্কবিতর্ককে পায়ে ঠেলে সামনে এগিয়ে চলা প্রতিটি আত্মপ্রত্যয়ী নারীকে। নারীর সক্ষমতা আর আত্মপ্রত্যয় একদিন সব ষড়যন্ত্রের অবসান ঘটাবে নিশ্চয়ই।
নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী।
ই-মেইল: [email protected]