মাহফুজ আনাম বাংলাদেশের একজন সেরা সাংবাদিক ও সম্পাদক। একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের অত্যন্ত সফল ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার-এর প্রকাশক এবং ব্যবস্থাপনা পর্ষদের চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপকও। বাংলাদেশের অস্থির রাজনীতি এবং দুর্বল সংবাদমাধ্যমের পরিসরে এ দুইয়ের সমন্বয় দুর্লভ। আর বর্তমান সময়ে একটি সফল পত্রিকা গড়ে তোলার পেছনে এত ধরনের দায়িত্ব পালন করার মতো ব্যক্তির অভাব আমরা প্রতিনিয়ত অনুভব করি। সেখানে মাহফুজ আনাম একই সঙ্গে কয়েক প্রজন্মের সাংবাদিককে নিয়ে সামনে থেকে সফলতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আসলে যিনি একজন প্রকৃত সাংবাদিক ও সম্পাদক, তিনি নিজে নিয়মিত লিখবেন, সম্পাদনা-প্রকাশনায় যুক্ত থাকবেন, আবার একই সঙ্গে সংবাদপত্র-প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা ও ব্যবসা পরিচালনা করে সেটিকে সফলতার উচ্চপর্যায়ে নিয়ে যাবেন-বাংলাদেশের বিগত ৫০ বছরের ইতিহাসে এ এক বিরল উদাহরণ।
আমরা জানি, পাকিস্তান আমলে অত্যন্ত সফল দৈনিক ইত্তেফাক-এর পেছনে ছিল সম্পাদনা, ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনাসহ মূলতই তফাজ্জল হোসেনের (মানিক মিয়া, ১৯১১-১ জুন ১৯৬৯) নেতৃত্ব। সেই ষাটের দশকে এক ঐতিহাসিক কালের যুগোপযোগী নেতৃত্ব দিয়ে তিনি দৈনিক ইত্তেফাককে সফলতার উচ্চস্তরে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। আমরা দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার-এর (পরে দ্য বাংলাদেশ অবজারভার) কথাও এ প্রসঙ্গে স্মরণ করতে পারি। এই সফল ইংরেজি দৈনিক কাগজটির সম্পাদনা ও ব্যবস্থাপনার পেছনে ছিলেন মূলত আবদুস সালাম (২ আগস্ট ১৯১০-১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭)।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার দুই দশক পরে এসে প্রখ্যাত সাংবাদিক এসএম আলী (সৈয়দ মোহাম্মদ আলী, ৯ ডিসেম্বর ১৯২৮-১৭ অক্টোবর ১৯৯৩) এবং সে সময়ের তরুণ সাংবাদিক মাহফুজ আনাম যৌথ নেতৃত্বে ডেইলি স্টার প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সে সময় এটি ছিল অত্যন্ত সাহসী একটি উদ্যোগ। সময় তখন ছিল ১৯৯১ সাল। বাংলাদেশে নতুন করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটা সম্ভাবনাময় পরিবেশ তখন তৈরি হয়েছে। দ্য ডেইলি স্টার-এর মতো একটি সাহসী ও স্বাধীন পত্রিকা প্রকাশের জন্য ওই পরিবেশ-পরিস্থিতি অনেকটাই সহায়ক হয়েছিল। মানুষের মধ্যে তখন স্বাধীন সংবাদপত্রের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সত্তর ও আশির দশকের রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ঘটনাবলির পরে এ কারণে দ্রুতই দ্য ডেইলি স্টার মানুষের চাহিদা পূরণে সক্ষম হয়েছিল।
দ্য ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক এসএম আলী এবং নির্বাহী সম্পাদক মাহফুজ আনামের সৌভাগ্য ছিল যে তাঁরা জনাব আজিমুর রহমান (১৯৩৫-২৩ অক্টোবর ২০০১), লতিফুর রহমান (২৮ আগস্ট ১৯৪৫-১ জুলাই ২০২০) ও আ. রউফ চৌধুরীর (২২ সেপ্টেম্বর ১৯৩৭-১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩) মতো উদ্যোক্তাদের সঙ্গে পেয়েছিলেন। তাঁরা নীতিগতভাবে গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন সংবাদপত্রের পক্ষে ছিলেন। ব্যবসায়িক বিষয়ের বাইরে পত্রিকার অন্য কোনো বিষয়ে তাঁরা কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেননি কিংবা নিজেদের সীমার বাইরে গিয়ে কোনো প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করেননি। জাতীয় রাজনৈতিক অনুকূল পরিবেশ এবং একটি আধুনিক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গির উদ্যোক্তা গোষ্ঠীর সহায়তায় স্বল্প সময়ের মধ্যে দ্য ডেইলি স্টার একটি সফল পত্রিকা হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল।
প্রকাশের দুই বছরের মধ্যেই এসএম আলীর প্রয়াণ ঘটে। তখন সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে পুরো পত্রিকার হাল ধরেন মাহফুজ আনাম। এরপর বিগত ত্রিশ বছর ধরে (১৯৯৩-২০২৩) তিনি পত্রিকাটির সম্পাদক।
এই ত্রিশ বছর সময়কালের মধ্যে মাহফুজ আনাম বাংলাদেশের রাজনীতির নানা উত্থান-পতন ও অভ্যুদয়ের ঘটনার মধ্য দিয়ে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে কাগজটি নিয়ে সামনে অগ্রসর হয়েছেন। এ সময় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর নানা চাপ, ভয়ভীতি ও বহু মামলা তাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে নানা সরকারের পক্ষ থেকে পত্রিকার প্রচারে বাধা সৃষ্টি করা, বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেওয়ার মতো নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এসব সত্ত্বেও বিগত ৩৩ বছরে শুধু ইংরেজি পত্রিকা হিসেবেই নয়, প্রচারসংখ্যার নিরিখে বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়েই ডেইলি স্টার নিজের অবস্থান প্রথম সারিতে ধরে রাখতে পেরেছে। আমাদের জন্য আরেকটি অত্যন্ত আনন্দের বিষয় এই যে শুধু বাংলাদেশেই নয়, ডেইলি স্টার ও মাহফুজ আনামের বিশেষ স্বীকৃতি ও সম্মান এই উপমহাদেশ তথা আন্তর্জাতিকভাবেই রয়েছে।
সাংবাদিকতা এবং দ্য ডেইলি স্টার-এর আয়-ব্যয়, ব্যবস্থাপনা, পরিচালনার পাশাপাশি মাহফুজ আনাম সব সময়ই কোনো না কোনো সাংগঠনিক উদ্যোগ নিয়েছেন। প্রায় দেড় দশক আগে তিনি সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নোয়াব (Newspaper Owners Association of Bangladesh) গঠনের উদ্যোগ নেন। তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। তাঁর উদ্যোগে সংবাদপত্র সম্পাদকদের দায়িত্ব পালনে অতি প্রয়োজনীয় সম্পাদক পরিষদও (Editors Council) গঠিত হয়। এখনো তিনি এই সংগঠনের সভাপতি।
এ ছাড়াও মাহফুজ আনাম এশিয়ার ২২টি দেশের প্রধান ২৪টি সংবাদপত্র নিয়ে গঠিত এশিয়ান নিউজ নেটওয়ার্কের (এএনএন) বর্তমান চেয়ারম্যান। তিনি ঐতিহ্যবাহী বিশ্ব সংবাদপত্র সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউটের (IPI) ভাইস-চেয়ারম্যান। এভাবে তিনি বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সংবাদপত্র-জগতেও নিজের একটি অবস্থান তৈরি করেছেন। বিষয়টি আমাদের জন্য গৌরবের। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বাংলাদেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন টিআইবি (Transparency International of Bangladesh) এবং ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের (Freedom Founfation) প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও উদ্যোক্তা।
দুই.
মাহফুজ আনামের সফল সাংবাদিকতা-জীবনের পটভূমিটি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর পিতা আবুল মনসুর আহমদ (৩ সেপ্টেম্বর ১৮৯৮-১৮ মার্চ ১৯৭৯) গত শতাব্দীর বিশের দশক থেকে কলকাতায় সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। এরপর ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাংবাদিক, কলাম লেখক, সাহিত্যিক সর্বোপরি সম্পাদক হিসেবে অবিভক্ত ভারতবর্ষের সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
আমরা জানি, আবুল মনসুর আহমদ একজন আইনজীবী ও রাজনীতিবিদও ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুক্ত ছিলেন সে সময়ের উদার ও গণতান্ত্রিক আদর্শের একটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে। ১৯৫৩ থেকে ’৫৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পর্যায়ে থেকে ১৯৫৪ সালে তিনি পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্য হন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রিত্বকালে ১৯৫৬-৫৭ সালে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে তিনি কারারুদ্ধ হন এবং ১৯৬২ সালে মুক্তি পান। এরপর সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন। রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ালেও বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ সব সময় ছিল। এ সময় আবুল মনসুর আহমদ ইত্তেফাকসহ বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত রাজনীতি-বিষয়ক কলাম লিখে স্বাধীন ও উদার গণতান্ত্রিক মতবাদের প্রবক্তা হিসেবে প্রমাণ নিজেকে করেছেন। আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছরসহ তাঁর বেশ কয়েকটি বই অত্যন্ত আলোচিত ও বহুল-চর্চিত।
এসব তথ্য এটাই প্রমাণ করে যে পারিবারিকভাবে মাহফুজ আনাম একটি উদার রাজনৈতিক আবহে বড় হয়েছেন এবং এসব তাঁর চিন্তার বিকাশকে সহায়তা করেছে। তাঁদের বাসভবনে সব সময় বহু রাজনৈতিক মানুষের সমাবেশ ছিল। বাবার রাজনৈতিক জীবন ও মন্ত্রিত্বকালে অনেক ঘটনাবলির তিনি সরাসরি প্রত্যক্ষদর্শী।
তিন
মাহফুজ আনাম সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও নটর ডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশে তখন ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন চলছে। বাংলাদেশের মানুষ স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের দাবিতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এ রকম এক উত্তপ্ত রাজনৈতিক আবহাওয়ায় মাহফুজ আনামের সঙ্গে আমার পরিচয়।
আমি তখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি সংসদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে। আমাদের ছিল সারা দেশে ছাত্র সংগঠন গড়ে তোলার বিশেষ একটি উদ্যোগ। সেই লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে ছাত্র ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিভিন্নমুখী কর্মসূচি সারা দেশে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হচ্ছে। সে সময় ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল ও সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল এবং পরে ঢাকা কলেজ ও নটর ডেম কলেজ থেকে শহিদুল্লাহ খান (বাদল), আব্দুল কাইয়ুম (মুকুল), মুজাহিদুল ইসলাম (সেলিম) এবং মাহফুজ আনামের মতো আরও অনেক সেরা ছাত্ররা এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন বিভাগে ভর্তি হয়। প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে তাঁরা ধীরে ধীরে যুক্ত হয়ে পড়েন। এই পরিবেশে আমাদের যোগাযোগ ঘটে এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়।
সেই দিনগুলোতে তরুণ মাহফুজ আনামের উপস্থিতি ছিল একজন সক্রিয় ও উদ্যোগী কর্মী হিসেবে। কর্মী হিসেবে তিনি রাস্তায় রাস্তায় এবং অফিসে অফিসে গিয়ে চাঁদা তুলেছেন। বক্তৃতা দেওয়াসহ সংগঠনের আরও নানা কর্মকাণ্ডে তিনি অংশ নেন। মাহফুজ আনাম আর তাঁর বন্ধুদের অনেকেই উৎকৃষ্ট বিতার্কিক ছিলেন। তবে মাহফুজ ছিলেন সেরা। তিনি তিনবার পাকিস্তানের সেরা বিতার্কিক নির্বাচিত হন এবং পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে যুগোস্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে বিশ্ব বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। এমন একজন তারকা ছাত্রকে পাওয়া সে সময়ে আমাদের জন্য ছিল বিশেষ প্রাপ্তি।
আমার মনে পড়ে, ১৯৬৭ সালে বা তার কিছু পরে আমি ও মাহফুজ আনাম সিলেট সফরে গিয়েছিলাম। অংশ নিয়েছিলাম আমরা সিলেট শহর ও হবিগঞ্জের একাধিক ছাত্রসভায়। এভাবে আমাদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হতে থাকে। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হল ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী হিসেবে মাহফুজ আনাম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই প্যানেলে সম্ভবত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন থেকে একমাত্র তিনিই নির্বাচিত হয়েছিলেন। একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি সংসদেরও সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন মাহফুজ আনাম, সভাপতি ছিলেন আমাদের বন্ধু আবুল হাসনাত। এই সংগঠনের বড় বড় অনুষ্ঠানসহ বহুমুখী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মাহফুজ ও বন্ধুরা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এসবের ধারাবাহিকতায় মাহফুজ আনাম তাতে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম প্রশিক্ষণার্থী ব্যাচের সদস্য। এভাবে একদিকে পরিবারের রাজনৈতিক প্রভাব, অন্যদিকে প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন-এই দুই ধারার এক মিলিত প্রভাব মাহফুজ আনামের রাজনৈতিক এবং ভবিষ্যৎ সাংবাদিকতার চেতনা তৈরিতে সাহায্য করেছিল।
চার
স্বাধীনতার পর মাহফুজ আনাম সচেতনভাবে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে সাংবাদিক হিসেবে যুক্ত হন ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভার-এর সম্পাদকীয় বিভাগে। পরে ইউনেসকোর (UNESCO-The United Nations Educational, Scientific, and Cultural Organization) তথ্য বিভাগে চাকরি নিয়ে প্যারিসে চলে যান। সেখান থেকে ইউনেসকোর সদর দপ্তর নিউইয়র্কে কাজ করে আশির দশকে ব্যাংককে আসেন। সেখানে ইউনেসকোর আঞ্চলিক দপ্তরে তথ্য ও প্রচার বিভাগের দায়িত্ব নেন। ১৪ বছর আন্তর্জাতিক সংগঠনে কাজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তাঁর মধ্যে আবার দেশে ফিরে সাংবাদিকতায় ফিরে যাওয়ার গভীর আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়।
বিদেশ থেকে ঢাকায় এলে প্রতিবার না হলেও অন্ততপক্ষে কয়েকবার মাহফুজ আনামের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। আমরা দেশ, দেশের রাজনীতি আর সাংবাদিকতা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতাম। তখন আমি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে থেকে নানা কাজ করছি। সাপ্তাহিক একতার সম্পাদক হিসেবেও কাজ করছি একই সঙ্গে। আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে ব্যাংককে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় প্রখ্যাত সাংবাদিক এসএম আলীর। ভবিষ্যতের সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা নিয়ে এসএম আলীর সঙ্গে মাহফুজ আনামের আলোচনা হয়। দুজনে মিলে ঢাকায় একটি ইংরেজি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের ব্যাপারে তাঁরা একমত হন।
এসব আলোচনার মধ্যেই এসএম আলী ঢাকায় চলে এসে কিছুদিন ডেইলি বাংলাদেশ অবজারভার-এ বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেন। এসএম আলী ও মাহফুজ আনামের সে সময়ে দীর্ঘ আলোচনার মধ্য দিয়ে ১৯৯১ সালের ১৪ জানুয়ারি দ্য ডেইলি স্টার প্রকাশিত হয়। আমি বলব, মাহফুজ আনাম সাহস করে নিজের ব্যক্তি বা কর্মজীবনের খুব বড় ও ঝুঁকিপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁর সেই সাহসী উদ্যোগ একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পত্রিকা হিসেবে ডেইলি স্টার এবং সম্পাদক মাহফুজ আনামকে দেশের ভেতরে-বাইরে সম্মান এনে দিয়েছে। বাংলাদেশের মতো সাংবাদিকতাবৈরী দেশে একটি সত্যিকার অর্থে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ইংরেজি সংবাদপত্র যে হতে পারে এবং টিকেও থাকতে পারে, তিনি সেটা প্রমাণ করেছেন। সে বিচারে ডেইলি স্টার-এর সমস্ত সফলতার পেছনে আমরা মাহফুজ আনামের একটি বড় ভূমিকা সব সময় স্মরণ করব। একই সঙ্গে এ পত্রিকার সংবাদকর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন জানাই।
কিন্তু মাহফুজ আনাম সেখানেই থেমে থাকেননি। ১৯৯৮ সালে আমি যখন ভোরের কাগজ পত্রিকাটি নিয়ে অনেকটা হতাশ এবং কাগজটি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সে সময় মাহফুজ আনাম আমাকে একটি নতুন দৈনিক বাংলা পত্রিকা করার প্রস্তাব দেন। বলা যায় বুঝে না-বুঝে একটি অনিশ্চিত অবস্থায় তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হই। প্রথম আলোর উদ্যোক্তা লতিফুর রহমানের সঙ্গে মাহফুজ আনাম ও আমি বেশ কয়েকবার বৈঠক করি এবং ১৯৯৮ সালের আগস্ট মাসে একটি দৈনিক বাংলা পত্রিকা শুরু করার বিষয়ে একমত হই। এরপর দ্রুততার সঙ্গে নভেম্বরের ৪ তারিখ আমরা প্রথম আলো প্রকাশ করি। এর পরিকল্পনা, প্রকাশনা ও ব্যবস্থাপনাসহ সব কাজের সঙ্গেই মাহফুজ আনাম ও লতিফুর রহমান অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। এই দুজনের একান্ত ও পূর্ণ সাহায্য-সমর্থন ছাড়া প্রথম আলো বের করা সম্ভব হতো না। প্রথম আলোকে সফল পত্রিকা হিসেবে দাঁড় করানোও অসম্ভব হতো।
প্রকাশের পর প্রথম দশ বছর প্রথম আলোর প্রকাশক ছিলেন মাহফুজ আনাম। সে সময়ে পত্রিকাটির বহু ভালোর সঙ্গে তাঁকে অনেক ঝামেলাও নিতে হয়েছে। প্রকাশক হিসেবে বছরের পর বছর অনেক মামলায় শুধু ঢাকার আদালতেই নয়, চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়িসহ বহু আদালতে তাঁকে যেতে হয়। অনেক কষ্টের মধ্যেও আমরা দুজন আবার এভাবে একসঙ্গে ভালো সময় কাটানোর সুযোগও পেয়েছি।
মাহফুজ আনাম এখনো প্রথম আলোর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। পত্রিকার সমস্ত ভালো-মন্দে আমরা সব সময় তাঁকে পাশে পাই। আমাদের সব দুঃখ-কষ্ট-বেদনার সময়ে তিনি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, আমাদের পাশে থাকেন। প্রথম আলোর যেকোনো সাফল্যের খবরে তিনি খুবই আনন্দিত ও উচ্ছ্বসিত হন। শুধু নিজেই উৎসাহিত হন না, আমাদেরও উৎসাহ দেন।
আজ ১ নভেম্বর দ্য ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক হিসেবে মাহফুজ আনামের ত্রিশ বছর পূর্ণ হচ্ছে। আমরা দিনটি আনন্দের সঙ্গে উদ্যাপন করছি। আশা করি, তাঁর নেতৃত্বে ডেইলি স্টার তার স্বাধীন, সাহসী ও নিরপেক্ষ অবস্থান অব্যাহত রেখে আরও নতুন নতুন সফলতা অর্জন করবে। অতীতের মতো মাহফুজ আনামের ভবিষ্যৎ জীবনেও আমরা আরও অনেক সফলতা কামনা করি।
মতিউর রহমান প্রথম আলোর সম্পাদক