মনে নেওয়া আর মেনে নেওয়া এক জিনিস না। যাকে মেনে নিতে হয়, সে ‘মনের মানুষ’ হয় না। সেই ধরনের মানহীন মানুষ অনেক সময় নানান কায়দায় হাতে-পায়ে পড়ায় দায় ঠেকে দুই নয়ন তাকে মনোনয়ন দেয়। মনের তাতে সায় থাকে না।
সিলেকশনধর্মী ইলেকশনের আশায় আওয়ামী লীগের অফিসে রাজনীতির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই এমন কাঁড়ি কাঁড়ি মনোনয়নকামীর স্লোগান ও মাত্রাছাড়া আছাড়িপিছাড়ি দেখা গেল।
কামলা থেকে সাবেক আমলা; পাতিনেতা থেকে অভিনেতা; লোকাল নেত্রী থেকে ফোকাল অভিনেত্রী; ‘স্বয়ং বেদিক’ থেকে সাংবাদিক; লেখোয়াড় থেকে খেলোয়াড়; ব্যারিস্টার থেকে ক্রিকেটার; উমেদার থেকে জমাদার—কে নেই?
যাঁর মনে চেয়েছে, তিনিই ‘সময় নাই অসময় নাই, বাবু একখান হাফ টিকিট!’ মার্কা মামাবাড়ির আবদার নিয়ে মনোনয়নপত্র কিনেছেন। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ সরগরম করে আওয়ামী প্রার্থী হতে ফরম কিনেছেন ৩ হাজার ৩৬২ জন। মানে, প্রতি আসনে পড়ে গড়ে ১১ জন। এর মধ্যে কতজন রাজনীতি করে আসা লোক, আর কতজন ‘এসে রাজনীতি করা’ লোক, তার তাল পাওয়া যাচ্ছে না।
এই লোকদের নমিনেশন কেনায় পাবলিকের নৈতিক পারমিশন আছে কি না, তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। ‘আঁতকা জনসেবক’ হতে চাওয়া এই ব্যক্তিদের মধ্যে অশ্রুসজল সামাজিক যাত্রাপালার লাস্যময়ী-হাস্যময়ী নায়িকা আছেন। সিনেমার পর্দায় কুংফুর এক ফুঁতে দশজনকে উড়িয়ে দেওয়া ড্যাশিং হিরো আছেন। প্যাকেজ নাটকে কাতুকুতু দিয়ে লোক হাসানো লোক আছেন। ফেসবুকের অদ্ভুত লুকের ভাইরাল মুখ আছেন। আলোচনায় তাঁরাই এগিয়ে।
আওয়ামী লীগের নমিনেশন পেপারের বিক্রিবাট্টা শেষ। জাতীয় পার্টি ওরফে জাপার পেপার বিক্রি এখনো চলছে। সেখানেও লোয়ার থেকে আপার ক্লাসের লোক মনোনয়ন চাচ্ছেন। আরও কিছু খুচরো-খাচরা দল ঝাঁপ খুলে বসে আছে। শুধুমাত্র নয়াপল্টনে তালা ঝুলছে। বিএনপির নেতা-কর্মীরা জেলে আছেন। দলটির ছেলেপেলে ছাত্রলীগ-যুবলীগের মতো হেসেখেলে দিন কাটানো দূরে থাক, ঘরে রাত কাটাতেও পারছে না। তাদের নয়ন এখন মনোনয়নের দিকে নেই।
সুতরাং মাঠ ফাঁকা। আওয়ামী লীগের টিকিট পেলে এমপি হওয়া ঠেকায় কে? যেহেতু সবার মাথায় ঢুকে গেছে, নেতা হতে ভোটে জেতা লাগে না; সেহেতু তাঁরা ভাবছেন, ‘আমরা সবাই নেতা’। তাঁরা ধরেই নিয়েছেন, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন মানে নিশ্চিত এমপিগিরি, নিশ্চিত ট্যাক্স ফ্রি গাড়ি, নিশ্চিত সরকারি প্লট, নিশ্চিত দরকারি ফ্ল্যাট।
একজন ব্যক্তিকে তাঁর এলাকার লোক যখন জনসেবক হিসেবে চেনেন, তখন তাঁরা তাঁকে নেতা হিসেবে চান। তখন তাঁরা তাঁকে ভোট দিতে চান। জনসমর্থন পেয়ে তখন তিনি কোনো একটি দলের মনোনয়ন চান। কিন্তু আলোচ্য নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা, ডাক্তার-মাস্টার, উমেদার-জমাদার যখন বোঝেন এ দেশে এখন এমপি হতে আর জনসমর্থন লাগে না; লাগে দলের মনোনয়ন; তখন তাঁরা ‘আঁতকা নেতা’ হয়ে যান।
যখন তাঁরা দেখেন রাজনীতির সঙ্গে কোনোকালে কোনো সম্পর্ক ছিল না, এমন লোকেরা দিব্যি এমপি হয়ে পাক্কা রাজনীতিক বনে গিয়ে রাজপথ দাপিয়ে এলাকা কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন; তখন তাঁরা ভাবেন, নোট ছড়ালে ভোটের অভাব হয় না। পরবর্তীতে এই নোট ছড়ানো লোকই ঘোঁট পাকানো নেতা বনে যান। এই কারণে ঠোঁটকাটা লোকের নিন্দা তাঁরা গায়ে মাখান না।
ফেসবুকের এক বন্ধু গতকাল এক ‘মিউচুয়াল ফ্রেন্ডের’ পোস্ট মেনশন করেছিল। সেই পোস্ট পড়ে টেনশনে পড়ে গেছি। দেখি, সেই মিউচুয়াল ফ্রেন্ড আওয়ামী লীগের নমিনেশন পেপার কিনেছেন। দোয়া চেয়েছেন। যে আসন থেকে তিনি মনোনয়ন চান, তিনি সেই আসনের ভোটারদের দুই নয়ন—এই মর্মে একটি ভার্চ্যুয়াল পোস্টারও ইতিমধ্যে তিনি ফেসবুকে বুস্ট করেছেন। অথচ ওই এলাকার এক শ জন মানুষ তাঁকে চেনেন কি না সন্দেহ আছে।
‘জার্নি বাই বোট’ রচনা মুখস্থ করে নৌকার হাল ধরতে চাওয়া এই আঁতকা রাজনীতিকদের অতর্কিত এমপি হওয়ার খায়েশে আঁতকে উঠতে হচ্ছে।
এই সব মৌসুমি রাজনীতিকের মূল মোক্ষ মনোনয়ন। স্পষ্টতই তাঁরা ভোটারের মন কিংবা ভোট—কোনোটাই চান না। এই ভোটবিরোধী ঘোঁট পাকানো রাজনীতিই এখন আসল রাজনীতি হয়ে উঠছে। অনেকে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ‘মনোনয়ন নিতে বাসা থেকে চাপ দিচ্ছে’। এই সব স্ট্যাটাস পড়েটড়ে বাসার ‘তিনি’ বলেই ফেলেছেন, ‘কত লোক মনোনয়নপত্র কিনল। তুমি করলা কী?’
একটি দলের মনোনয়ন কিনেছেন, এমন একজন মৌসুমি রাজনীতিকের ঘনিষ্ঠ সহচরকে বলতে শুনেছি, ‘সিল মারব এখানে, ভোট পড়বে ব্যালটে।’ সুতরাং ভোটে বিএনপির আসা না আসা, এমনকি ভোটকেন্দ্রে ভোটারের আসা না আসা নিয়ে তাঁর কোনো টেনশন নেই। তাঁর কাছে ভোটের খাতিরেও ভোটারের কোনো গুরুত্ব নেই।
এই সব মৌসুমি রাজনীতিকের মূল মোক্ষ মনোনয়ন। স্পষ্টতই তাঁরা ভোটারের মন কিংবা ভোট—কোনোটাই চান না। এই ভোটবিরোধী ঘোঁট পাকানো রাজনীতিই এখন আসল রাজনীতি হয়ে উঠছে। অনেকে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, ‘মনোনয়ন নিতে বাসা থেকে চাপ দিচ্ছে’। এই সব স্ট্যাটাস পড়েটড়ে বাসার ‘তিনি’ বলেই ফেলেছেন, ‘কত লোক মনোনয়নপত্র কিনল। তুমি করলা কী?’
● সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক