বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের সংজ্ঞাটি বেশ সহজই বলতে হয়। একটি জনসংখ্যাবহুল দরিদ্র দেশে অধিকতর বিনিয়োগের মাধ্যমে অধিকতর কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দ্রুত দারিদ্র্য হ্রাস।
বিনিয়োগ বলতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ যেমন বোঝায়, অন্যদিকে বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আবার প্রযুক্তি হস্তান্তরও ঘটায়। সেই সঙ্গে বিশ্বায়নের যুগে উন্নয়ন অর্থায়নের জন্য বৈদেশিক মুদ্রার অতি আকাঙ্ক্ষিত তারল্য বৃদ্ধিতেও সহায়তা করে।
তবে গত কয়েক বছর আমাদের এখানে সরাসরি বিনিয়োগের চিত্রটি সুখকর নয়। ২০২৩ সালে এফডিআই আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৪ শতাংশ কমেছে। এ বছর মোট এফডিআই এসেছে ৩০০ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার সমান। ২০২২ সালে ৩৪৮ কোটি ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল এবং আগের বছরের চেয়ে বেড়েছিল প্রায় ২০ শতাংশ।
দেশে বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল চালু হওয়ার পরও বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়াকে অনেকেই উদ্বেগজনক মনে করছেন। গত বৃহস্পতিবার প্রকাশিত জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের বিশ্ব বিনিয়োগ প্রতিবেদনে দেশওয়ারি বিদেশি বিনিয়োগ আসার এবং অন্য দেশে বিনিয়োগের ২০২৩ সাল পর্যন্ত পরিসংখ্যান রয়েছে। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে আঙ্কটাড ‘ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২৪’ নামে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
আঙ্কটাডের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে ৩০০ কোটি ৪০ লাখ ডলার বিনিয়োগ এলেও বাংলাদেশে বছর শেষে মোট বিদেশি বিনিয়োগ থাকার পরিমাণ বা স্থিতি কমে গেছে। ২০২২ সালেও আগের বছরের চেয়ে এফডিআই স্থিতি কমে যায়। এর মানে বাংলাদেশ থেকে গত দুই বছরে উল্লেখযোগ্য অঙ্কের বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহার হয়েছে।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশে ২০২৩ সাল শেষে বিদেশি বিনিয়োগের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৫ কোটি ডলার। আগের বছর যা ছিল ২ হাজার ৭৫ কোটি ডলার। ২০২১ সালে ছিল ২ হাজার ১৫৮ কোটি ডলার। ২০২১ সাল পর্যন্ত আগের কয়েক বছর এফডিআই স্থিতি বাড়ছিল। ২০১৮ সালে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ৩৬১ কোটি ডলারের সর্বাধিক বিনিয়োগ এসেছিল। এর মূল কারণ ছিল সুইজারল্যান্ডভিত্তিক জাপান টোব্যাকো ইন্টারন্যাশনাল (জেটিআই) ওই বছর বাংলাদেশের আকিজ গ্রুপের সিগারেটের ব্যবসা ইউনাইটেড টোব্যাকো কিনে নেয়।
আঙ্কটাডের পরিসংখ্যানমতে, শুধু বাংলাদেশে বিদেশিদের নয়, বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের দেশের বাইরে বিনিয়োগও গত বছর কমেছে। কমার হার প্রায় ৪৩ শতাংশ। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বিদেশে বৈধভাবে ৩ কোটি ডলার বা প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশের বাইরে বিনিয়োগ করেছেন। ২০২২ সালে যার পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আর ২০২১ সালে ছিল ৯ কোটি ২০ লাখ ডলার। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ডলার-সংকটের কারণে বাংলাদেশের ব্যক্তি খাত এখন দেশের বাইরে বিনিয়োগ করার মতো জুতসই অবস্থানে নেই।
বাংলাদেশে অবশ্য ২০২৩ সালে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের (গ্রিনফিল্ড ইনভেস্টমেন্ট) জন্য অর্থের ঘোষণার পরিমাণ বেড়েছে, যা ভবিষ্যতে প্রকৃত বিনিয়োগ বাড়ার ইঙ্গিত দেয়। ঘোষিত অর্থের পরিমাণ ২৮৯ কোটি ডলার। ২০২২ সালে যা ছিল মাত্র ৬৫ কোটি ডলার। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্যমতে, বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা স্থাপনে বিনিয়োগের ঘোষণা আগের চেয়ে গত বছর বেড়েছে।
আমরা জানি, বাংলাদেশ সরকার ২০১৫ সালে ১৫ বছরের মধ্যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার কার্যক্রম শুরু করে। এর মধ্যে অন্তত ১০টি অঞ্চলে উৎপাদন শুরু হয়েছে। বাস্তবায়নে ধীরগতি থাকায় ১০০টি অঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষ্যমাত্রা পিছিয়ে ২০৪১ সাল পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে দেশের বাইরে বিনিয়োগ উন্মুক্ত নয়। একটি নীতিমালার আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটি শর্তসাপেক্ষে উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি দিয়ে থাকে। কিছু প্রতিষ্ঠানের দেশের বাইরে বিনিয়োগ রয়েছে, যার মধ্যে রপ্তানিকারকের সংখ্যা বেশি। রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণে সাধারণত এ ধরনের অনুমোদন দেয় সরকার। আঙ্কটাডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল শেষে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ ছিল ৩৮ কোটি ৫০ লাখ ডলার। ২০২২ সাল শেষে যা ছিল ৪০ কোটি ডলার। ২০২১ সাল শেষে অঙ্কটি ৩৯ কোটি ডলার ছিল।
আইন ও নীতির ধারাবাহিকতার অভাব বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বাড়িয়েছে। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতায় আমরা অনেকেই জানি, বিনিয়োগ আকর্ষণে শুধু প্রণোদনা দিলে হবে না, প্রয়োজনীয় সংস্কারও করতে হবে। কৌশলগত অবস্থান দৃঢ় থাকতে হবে। কারণ, সব দেশই বিদেশি বিনিয়োগ চায়। প্রতিযোগিতা করে বিনিয়োগ আনতে হলে কৌশলগত পদক্ষেপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অপরাপর প্রতিযোগী দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এফডিআই আগে থেকেই নিম্নস্তরে রয়েছে। বাংলাদেশের মতো প্রায় একই পরিমাণ জিডিপির দেশ ভিয়েতনামে ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে গড়ে এফডিআই এসেছে ১৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার, যা তাদের জিডিপির ৪ দশমিক ১ শতাংশের সমান।
যেকোনো দেশের জন্য শক্তিশালী এফডিআই আকর্ষণে তিনটি বৈশিষ্ট্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমত, ব্যবসায় বিশ্বাসযোগ্যতা থাকতে হবে। একটি দেশের বিশ্বাসযোগ্যতা তখনই স্থাপিত হয়, যখন ট্রেডমার্ক, আইপিআর (ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটস বা বুদ্ধিভিত্তিক সম্পদ অধিকার) ও এডিআর-সংক্রান্ত (অলটারনেটিভ ডিসপিউট রেজল্যুশন বা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) নিয়মকানুন ন্যায়সংগত ও কার্যকরভাবে পরিচালিত হয়; আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয় এবং কোম্পানিগুলো তাদের পরিষেবার বিপরীতে নির্বিঘ্নে অর্থপ্রাপ্তি ও মুনাফা প্রত্যাবর্তনের সুযোগ পায়।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা নিয়ে বিশ্বব্যাংক কিংবা অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীরা বেশ সোচ্চার, তা হলো নীতির ধারাবাহিকতা। এমন একধরনের নীতি থাকতে হবে, যা আকস্মিক পরিবর্তন হয় না। কারও জন্যই প্রতিশ্রুত করছাড় বা আমদানি-রপ্তানি সুবিধা হঠাৎ বাতিল হয় না। শুল্ক ও অশুল্ক বাধা আরোপ করা হয় না এবং যেকোনো প্রণোদনা বৈষম্য ছাড়াই সমানভাবে প্রয়োগ করা হয়।
তৃতীয় বিষয়টি হলো, ব্যবসায়ের সামর্থ্য বৃদ্ধি অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের ব্যবসা শুরু করতে সাহায্য করা, তাদের যত্ন নেওয়া এবং ভ্যাট কাঠামো সহজ করে তোলা, পরোক্ষ করের চেয়ে প্রত্যক্ষ করের ওপর অধিক জোর দেওয়া, কার্যকর আয়কর কম রাখা এবং একটি ব্যবসাবান্ধব কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স পদ্ধতি চালুকরণ।
কমে যাওয়ার পেছনে অবশ্য রয়েছে দীর্ঘদিনের বিনিয়োগ পরিবেশের দুর্বলতা। কিছু মান্ধাতা আমলের আইনকানুনের এখনো সংস্কার করা হয়নি। এ ছাড়া গত দুই বছরে সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেসব চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়, বিশেষত মুদ্রার বিনিময় হারে অস্থিরতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ কিছু কারণ বিদেশি বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করেছে।
আইন ও নীতির ধারাবাহিকতার অভাব বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বাড়িয়েছে। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতায় আমরা অনেকেই জানি, বিনিয়োগ আকর্ষণে শুধু প্রণোদনা দিলে হবে না, প্রয়োজনীয় সংস্কারও করতে হবে। কৌশলগত অবস্থান দৃঢ় থাকতে হবে। কারণ, সব দেশই বিদেশি বিনিয়োগ চায়। প্রতিযোগিতা করে বিনিয়োগ আনতে হলে কৌশলগত পদক্ষেপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আঙ্কটাডের উপরিউক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের সব দেশ ২০২৩ সালে এফডিআই পেয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি ডলার, আগের বছরের চেয়ে যা ২ শতাংশ কম। বিশ্ব অর্থনীতিতে ধীরগতি এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে বিনিয়োগ কম হয়েছে বলে মনে করছে সংস্থাটি। গত বছর দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের কারণে সার্বিকভাবে এফডিআই কমেছে ৩৮ শতাংশ।
আমাদের বুঝতে হবে, বিদেশি বিনিয়োগ প্রবাহ ও বিনিয়োগ স্থিতি দুটিই কমে যাওয়া উদ্বেগজনক। এর মানে নতুন বিনিয়োগকারী আকর্ষণ এবং যারা আছে তাদেরও ধরে রাখার ক্ষেত্রে সাফল্য কম।
কমে যাওয়ার পেছনে অবশ্য রয়েছে দীর্ঘদিনের বিনিয়োগ পরিবেশের দুর্বলতা। কিছু মান্ধাতা আমলের আইনকানুনের এখনো সংস্কার করা হয়নি। এ ছাড়া গত দুই বছরে সামষ্টিক অর্থনীতিতে যেসব চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়, বিশেষত মুদ্রার বিনিময় হারে অস্থিরতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ কিছু কারণ বিদেশি বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করেছে।
আইন ও নীতির ধারাবাহিকতার অভাব বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বাড়িয়েছে। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতায় আমরা অনেকেই জানি, বিনিয়োগ আকর্ষণে শুধু প্রণোদনা দিলে হবে না, প্রয়োজনীয় সংস্কারও করতে হবে। কৌশলগত অবস্থান দৃঢ় থাকতে হবে। কারণ, সব দেশই বিদেশি বিনিয়োগ চায়। প্রতিযোগিতা করে বিনিয়োগ আনতে হলে কৌশলগত পদক্ষেপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আঙ্কটাডের উপরিউক্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের সব দেশ ২০২৩ সালে এফডিআই পেয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি ডলার, আগের বছরের চেয়ে যা ২ শতাংশ কম। বিশ্ব অর্থনীতিতে ধীরগতি এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে বিনিয়োগ কম হয়েছে বলে মনে করছে সংস্থাটি। গত বছর দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের কারণে সার্বিকভাবে এফডিআই কমেছে ৩৮ শতাংশ।
দক্ষিণ এশিয়ায় বিনিয়োগ এসেছে ৩ হাজার ৫৯৭ কোটি ডলার। ২০২২ সালে এসেছিল ৫ হাজার ৭৫২ কোটি ডলার। ভারতে গত বছর এফডিআই এসেছে ২ হাজার ৮১৬ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ৪৩ শতাংশ কম। অন্যদিকে কম্বোডিয়া কিংবা ভিয়েতনামের মতো দেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে। এমনকি অনেকের মধ্যে প্রশ্ন থাকা দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায়ও প্রাগ্রসর নীতির কারণে ধীরে ধীরে আবার বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিদেশি বিনিয়োগের দুটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়কের মধ্যে একটি হলো, স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা। বাজারে স্থানীয়, বিশেষ করে বিদেশি মুদ্রার তারল্য বৃদ্ধি, ব্যবসার প্রক্রিয়া সহজীকরণ, করহারের যৌক্তিককরণ এবং নীতির স্পষ্টতা বিশেষ করে নীতির দীর্ঘকালীন ধারাবাহিকতা রক্ষা। সেই সঙ্গে এই কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত সব অংশীজনের মধ্যে পরিবর্তনের পক্ষে, নতুন বিদেশি বিনিয়োগের পক্ষে একটি জোরালো প্রণোদনা সৃষ্টি করা। তা না হলে বিনিয়োগ সম্ভাব্য অর্থ অন্য কোনো প্রতিযোগী দেশে চলে যাবে, আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথ হবে পিচ্ছিল ও ঝুঁকিপূর্ণ।
মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক।